সত্যের সন্ধানে ইতিহাস, বাংলাদেশ তার অতীতকে নতুন করে উন্মোচন করছে
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১১ পিএম | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩২ পিএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু হওয়া ছাত্র বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় গত বছরের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই সময় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বিকৃত করে, যার মুখে লাল রঙ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেকে তাকে জাতির পিতা হিসেবে শ্রদ্ধা করলেও, কিছু তরুণ তাকে ‘ফ্যাসিবাদের প্রতীক’ বলেও উল্লেখ করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতনের ছয় মাস পর, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ইতিহাস পুনর্লিখনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংস্কারের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকার নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এবং তার চারপাশে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র এবং বিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী মোহাম্মদ আবু বকর মজুমদার বলেন, “আমরা ইতিহাসকে নতুন করে লিখছি না, বরং ভুলগুলো সংশোধন করছি। আওয়ামী লীগ একটি বিকৃত মুজিববাদী আদর্শ তৈরি করেছিল, যা গল্প, কবিতা এবং শিল্পকর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা ইতিহাসকে নির্ভুল ও বাস্তবসম্মত করতে চাই।”
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এসেছে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি উভয়েই ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীকে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক চেতনা পুরনো রাজনৈতিক আখ্যান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে নতুন পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে একক মর্যাদার পরিবর্তে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ছবি ও উক্তি যেখানে পূর্ববর্তী বইয়ের প্রচ্ছদে ছিল, সেখানে এখন তার পতনের সময়ের গ্রাফিতির চিত্র সংযোজন করা হয়েছে।
এই ইতিহাস পুনর্লিখন প্রক্রিয়া নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ইস্যু এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চ্যালেঞ্জের অংশ। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি ক্রমশ জোরদার হচ্ছে, এবং ইউনূসের সমালোচকরা অভিযোগ করছেন, তার উপদেষ্টারা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করছেন।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাতের দাবি, “অধ্যাপক ইউনূস ইতিহাসকে বিকৃত করছেন এবং পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছেন। শেখ মুজিব ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নেতা, কিন্তু তারা তাকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে না পারায় অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে রেখেছেন।
বিএনপি-ও এই ইতিহাস সংশোধনের প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং নতুন পাঠ্যপুস্তকে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তকে তার চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে এটি শেখ মুজিবের পক্ষে করা হয়েছিল বলে স্পষ্ট করা হয়েছে।
নতুন পাঠ্যপুস্তকের মূল নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ইউনূসের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, “আমার নির্দেশনা ছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণ না করা। এটি বিরল ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন যা এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে, নইলে সুযোগ হারিয়ে যাবে।”
পাঠ্যপুস্তকে ভারতের ভূমিকা নিয়েও পরিবর্তন আনা হয়েছে। পূর্ববর্তী বইগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক সহায়তা, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং শরণার্থী সঙ্কট মোকাবিলায় ভারতের অবদানের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। তবে নতুন সংস্করণে এসবের উল্লেখ কমিয়ে আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন শেখ মুজিবের শাসনামলের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তার নেতৃত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেখ হাসিনার শাসনামলে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক শাফকাত মুনির বলেন, “তরুণরা বলছে, ইতিহাসকে ১৯৭১ সালের মতো দেখতে হবে, কিন্তু ২০২৪ সালকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একজন ব্যক্তির গল্প নয়।”
এখন পাঠ্যপুস্তকে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি নারী-নেতৃত্বাধীন সংগঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যা জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে কাজ করছে। ২০১৪ সালে গঠিত এই সংগঠন নিখোঁজদের সন্ধান ও বিচারের দাবি তোলে।
বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, “গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে, এখন তা প্রকাশ্যে আসছে। গুম, গোপন নির্যাতন সেল, মানুষ হত্যা এবং লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা এখন সামনে আসছে। বাংলাদেশের জনগণ এখন সেই সত্যগুলো জানতে পারছে।” তথ্যসূত্র : ফিনান্সিয়াল টাইমস
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও





আরও পড়ুন

আলেমসমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশকে ঠেকাতে পারবেনা: এ এম এম বাহাউদ্দীন

অযথা কালক্ষেপণ করে ক্ষমতায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা সরকারের নেই: আইন উপদেষ্টা

শ্রীলঙ্কাকে হোয়াইটওয়াশের খুব কাছে অস্ট্রেলিয়া

ডিআইজিসহ পুলিশের ৪ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা আটক

ভারতে বসে নতুন চক্রান্ত শুরু করেছে হাসিনা: মির্জা ফখরুল

ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে দুবাই যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

বাবার মতোই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হবেন কেজরিকে হারানো পরভেশ?

বগুড়ায় ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল চালু করল রিভো

সৌদি আরব ও আমিরাত সফরে গেলেন বিমান বাহিনী প্রধান

কতটা নির্লজ্জ হলে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয় - আতাউর রহমান

মুসলমানদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট সিঙ্গাপুরের, বাংলাদেশ কত নম্বরে?

ময়মনসিংহে ‘মাইক্লো বাংলাদেশ’র যাত্রা শুরু

টিএমএসএস পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত

আমরা ক্ষমতায় গেলে বাদলেসের দাবি পূরণ করবো-খায়রুল কবির খোকন

তিন রাকাত বিশিষ্ট নামাজের প্রথম বৈঠক না করে ইমাম সাহেবের দাঁড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে।

মনোহরগঞ্জে অবৈধভাবে পরিচালিত দুটি ইটভাটা বন্ধ ঘোষণা

লক্ষ্মীপুরে হত্যা মামলায় দুই আসামি গ্রেপ্তার

বই পড়ায় অনাগ্রহ বাড়ছে

চাটমোহরে ১৭ আসামি গ্রেফতার