‘ভাওয়াইয়া একাডেমী’ এখন ‘ভাওয়াইয়া জাদুঘর’

কুড়িগ্রামে স্থান সংকটে নষ্ট হচ্ছে দুর্লভ ঐতিহ্য ও লোকজ উপকরণ

Daily Inqilab কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু

১৪ জুন ২০২৫, ০১:১৯ পিএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫, ০১:১৯ পিএম

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্রান্তিক এক কোণে, এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে ‘ভাওয়াইয়া একাডেমী’। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের পরিক্রমায় এটি এখন রূপ নিয়েছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক স্থাপনায়—‘ভাওয়াইয়া জাদুঘর’-এ। এই জাদুঘরের নামকরণ করা হয়েছে ‘কছিম উদ্দিন লোকশিল্প জাদুঘর’—কুড়িগ্রামের প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পীর নামে, যিনি এই গানের সুর বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন।

 

জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত হয়েছে গ্রামীণ বাংলার প্রায় দুই হাজার বিলুপ্তপ্রায় বা বিলুপ্তির মুখে থাকা লোকজ উপকরণ—যেগুলো এক সময় ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে স্থান সংকটের কারণে অনেক মূল্যবান উপকরণ অগোছালোভাবে বারান্দায় পড়ে আছে। অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবুও দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন এসব দুর্লভ ঐতিহ্য একনজর দেখতে।

 

এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে একশ’রও বেশি দুষ্প্রাপ্য উপকরণ। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কাঠের যুঁত, লাঙ্গল, কুরসি, গরু চালানোর পেন্টি লাঠি, করাইল কুড়াল, বাকুয়া (কাঁধে বহনের বাঁশি দণ্ড), চাষির বাঁশের টুপি ‘টোপা’, ধান ঝাড়ার কুলা-ঝাঁপি, ভার বহনের পেঁষ্টা। এছাড়াও আছে ধান প্রসেস করার ‘উরুণ-গাইন’ ও ‘পাট’। মাছ ধরার পুরনো দিনের বার্ষি, ডারকি, দেরু, পালো, চাক, মাছ রাখার খলাই ও জিনা—এসবই যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের জীবন্ত দলিল। আছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, সারিন্দা, ঢোল, বাঁশি, দোতারা এবং খড়ম—সবকিছুই যা ভাওয়াইয়া গানে এসেছে উত্তরবঙ্গীয় নামেই।

 

এই বিশাল সংগ্রহের নেপথ্য নায়ক একজন—ভূপতি ভূষণ বর্মা। উলিপুরের দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক একজন খ্যাতিমান ভাওয়াইয়া শিল্পী ও গবেষক। ১৯৯৩ সাল থেকে একক প্রচেষ্টায় তিনি সংগ্রহ করে চলেছেন গ্রামীণ বাংলার হারিয়ে যাওয়া অতীত। দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন মঞ্চে ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন উত্তর বাংলার সুর বিশ্বের দরজায়।

 

ভূপতি মনে করেন, আধুনিক প্রজন্মকে শিকড়ে ফেরাতে হবে গান ও ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন ঘটিয়ে। তার ভাষায়, “এইসব উপকরণ কেবল সংগ্রহ নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। আমরা চাই, মানুষ গান শুনুক, কিন্তু তার সঙ্গে দেখে-জানুক—কী ছিল এই গানের পেছনের বাস্তবতা।”

ভাওয়াইয়া জাদুঘরের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা কছিম উদ্দিনের জন্য কিছুই করতে পারিনি। অথচ তিনি এই গানকে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি। তার স্মরণেই আমরা এই জাদুঘরকে তার নামে উৎসর্গ করেছি—এটাই আমাদের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।”

তবে সব অর্জনের মাঝেও বড় প্রতিবন্ধকতা স্থান সংকট। ভূপতির কণ্ঠে আক্ষেপ—“জাদুঘরের সংগ্রহগুলো আমরা বকেটি কক্ষে ও বারান্দায় রেখেছি। অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের একটি বহুতল ভবন প্রয়োজন। কিন্তু নিজস্ব কোনো আর্থিক সামর্থ্য নেই।’

 

জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, দুর্গাপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলেপ উদ্দিন সরকারের দানকৃত পাঁচ শতক জমির মাধ্যমে। এরপর টিনশেডের একটি ভবন নির্মাণ করা হয় স্থানীয় ও কিছু সরকারি সহায়তায়। এখানেই চালু হয় ‘ভাওয়াইয়া একাডেমী’। এখানে বিনামূল্যে পাঁচটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়—ভাওয়াইয়া গান, দোতারা, সারিন্দা, ঢোল ও বাঁশি। ভূপতিসহ আটজন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক এই সেবায় নিয়োজিত। প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিকেলে ক্লাস হয়। বর্তমানে ৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত অংশ নিচ্ছে, আর এই একাডেমী থেকে ইতোমধ্যে উপকৃত হয়েছেন দুই হাজার পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী।

 

ভাওয়াইয়া শিল্পীরা জানান, কালের বিবর্তনে যেসব ধ্বংস হতে বসেছে, এই জাদুঘর যেন তা সংরক্ষণের এক নিবেদিত মঞ্চ। যদি স্থান সংকট দূর হয়, তবে এটি উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাস সংরক্ষণের একটি অনন্য নিদর্শনে পরিণত হতে পারে।

 


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফের লর্ডস টেস্টে হাসল রাহুলের ব্যাট,তিন দিন শেষে সমানে সমান ভারত-ইংল্যান্ড

ফের লর্ডস টেস্টে হাসল রাহুলের ব্যাট,তিন দিন শেষে সমানে সমান ভারত-ইংল্যান্ড

যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট রহস্যজনকভাবে সেই মূল তিন আসামীকে বাদ দেয়া হয়েছে :যুবদল সভাপতি

যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট রহস্যজনকভাবে সেই মূল তিন আসামীকে বাদ দেয়া হয়েছে :যুবদল সভাপতি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অবশ্যই ‘সঠিক পথ’ খুঁজে বের করতে হবে

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অবশ্যই ‘সঠিক পথ’ খুঁজে বের করতে হবে

বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার জঘন্য পরিণতি সোহাগ হত্যাকাণ্ড :বিভিন্ন ইসলামী দলের তীব্র প্রতিবাদ

বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার জঘন্য পরিণতি সোহাগ হত্যাকাণ্ড :বিভিন্ন ইসলামী দলের তীব্র প্রতিবাদ

অমীমাংসিত কিছু বিষয়, শুল্কছাড় নিয়ে আবার আলোচনায় বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ

অমীমাংসিত কিছু বিষয়, শুল্কছাড় নিয়ে আবার আলোচনায় বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে চাই -স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে চাই -স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মূল্য যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন

মূল্য যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন

রূপগঞ্জে ৩৪ বছর পর মসজিদের ওয়াকফকৃত ৪১ শতক জমি উদ্ধার করল গ্রামবাসী

রূপগঞ্জে ৩৪ বছর পর মসজিদের ওয়াকফকৃত ৪১ শতক জমি উদ্ধার করল গ্রামবাসী

বন্দরে বিএনপি নেতাদের চাঁদা না দেয়ায় মসজিদের বালু ভরাট কাজ বন্ধ

বন্দরে বিএনপি নেতাদের চাঁদা না দেয়ায় মসজিদের বালু ভরাট কাজ বন্ধ

পাল্টা শুল্কের শঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ পিছিয়েছে ওয়ালমার্ট

পাল্টা শুল্কের শঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ পিছিয়েছে ওয়ালমার্ট

দুই হত্যার প্রাপ্ত টাকা মসজিদে দান করে দেয় র‌্যাব কর্মকর্তা

দুই হত্যার প্রাপ্ত টাকা মসজিদে দান করে দেয় র‌্যাব কর্মকর্তা

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মেশিনারি মেলায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মেশিনারি মেলায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ

টাকা পয়সার সঙ্গে জামা জুতাও নিয়ে যায় ছিনতাইকারী

টাকা পয়সার সঙ্গে জামা জুতাও নিয়ে যায় ছিনতাইকারী

সউদী আরবে সম্পত্তি কিনতে পারবেন বিদেশিরা

সউদী আরবে সম্পত্তি কিনতে পারবেন বিদেশিরা

বাজার মূলধনে যোগ হলো আরো ১০ হাজার কোটি টাকা

বাজার মূলধনে যোগ হলো আরো ১০ হাজার কোটি টাকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন

সুনামগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত

সুনামগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত

মামলা তুলে নিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম : প্রেসিডেন্ট বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও গণপদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা

মামলা তুলে নিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম : প্রেসিডেন্ট বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও গণপদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচনই একমাত্র সমাধান :গোলটেবিল বৈঠকে পীর সাহেব চরমোনাই

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচনই একমাত্র সমাধান :গোলটেবিল বৈঠকে পীর সাহেব চরমোনাই