তরবারির জোরে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

৩১ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৭ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১২ পিএম

ভারতে বঞ্চিত, দলিত, অত্যাচারিত এবং মানুষ হিসেবে অপাংতেয় শ্রেণিই কেবল ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের ধন্য ও মর্যাদাবান করেনি, রাজা, ধর্মগুরু, প্রভাবশালী ও উচ্চবর্ণের মানুষও ইসলামে মোহিত হয়ে তা গ্রহণ করেছে। ইসলামের সেই শুরুর কালে মালাবারের একজন রাজার ইসলাম গ্রহণের কথা ইতিহাস গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কেরলের পেরুমল বংশের শেষ রাজা। নাম চেরমান। তিনি মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব ও ইসলাম সম্পর্কে অবগত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। রাজা নিজে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি প্রজাদের মধ্যেও ইসলাম প্রচারে সচেষ্ট হন। তিনি রাজত্ব তার উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করে আরব দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।

এখনো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা ধর্মের মানুষ ইসলামে দীক্ষা নিচ্ছে স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাদের মধ্যে রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, পুরোহিত-ধর্মযাজকসহ বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার বিখ্যাত ব্যক্তি থেকে শুর করে সাধারণ মানুষ শামিল রয়েছে। বিশ্বে এখন ইসলাম দ্রুত সম্প্রসারণশীল একটি ধর্ম হিসেবে গণ্য। বিশ্বে মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এসব রাষ্ট্রের কোথাও জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগে অথবা প্রলোভন দেখিয়ে কাউকে ধর্মান্তর করা হয়েছে, এমন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ বইয়ে বলেছেন : দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে সেথায়ই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়তা আজও বর্তমান। বলাবাহুল্য, ভারতের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। মুসলিম শাসকরা ভারতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু স্থানীয়দের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতীয়ত্বের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এত দীর্ঘ সময় ভারতে মুসলমানদের শাসন কায়েম থাকলেও তারা বরাবরই সংখ্যালঘু থেকেছে। তাদের উদারতা, সহিষ্ণুতা, মানবিকতা এবং বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব হতো না। মুসলিম শাসকরা যদি জবরদস্তি ও প্রলোভনে ধর্মান্তরের নীতি গ্রহণ করতেন, অন্য ধর্ম-সম্প্রদায় না থাক, এটা চাইতেন, তাহলে আজ ভারতে একজন অমুসলমানও হয়তো খুঁজে পাওয় যেতো না।
আমরা দেখেছি, ভারতে ইসলাম প্রথম এসেছে দক্ষিণ ভারতের মালাবারে। আরব বণিকরা তা এনেছেন। কেরলে অবস্থিত তাদের বস্তিতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাদের এ দেশীয় কর্মচারীদের অনেকে ইসলামের মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আরব বণিকদের পথ ধরেই ইসলাম প্রচারকদল ইসলাম প্রচারে ভারতে এসেছে। তাদের অনুসরণে আওলিয়া-দরবেশ ও সুফীরা এসেছে। সবাই ভারতে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আওলিয়া-দরবেশ, পীর-ফকির ও সুফীরা তাদের চরিত্র-মাধুর্য, সদগুণাবলী, সাদাসিদা জীবনযাপন, উচ্চনৈতিক মান, ইসলাম সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান, মানবসেবার অনবদ্য নিষ্ঠা ইত্যাদির কারণে সহজেই স্থানীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মানুষ দলে দলে তাদের সান্নিধ্যে এসেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের ধন্য করেছে। সুরজিৎ দাশগুপ্তের মতে, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে প্রথম যিনি এসেছিলেন তার নাম শেখ ইসমাইল। তার পরে এসেছেন শেখ আলী উসমান আল হুজাইরি ওরফে দাতা গঞ্জবখশ। এরা দু’জনেই সাধনার স্থান হিসেবে লাহোরকে নির্বাচন করেছিলেন। শেখ ইসমাইল ও দাতা গঞ্জবখশ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়। তাদের কবর লাহোরেই অবস্থিত। উভয়ের কবর জিয়ারতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ হাজির হয়। অতঃপর গজনী থেকে ১১৬১ সালে আসেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী। তিনিও প্রথমে লাহোরে আসেন এবং কিছুকাল দাতা গঞ্জ বখশের মাজারে অবস্থান করেন। তারপর মুলতান ও দিল্লী হয়ে অবশেষে আজমীরে স্থিত হন। তাঁর সাধনাস্থল ও খানকাহ হিসেবে আজমীর বিখ্যাত এবং তার কবরও সেখানে অবস্থিত। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর দরগাহ ও মাজার হিন্দু-মুসলমানসহ অন্যান্য সম্প্রদায়েরও পরম শ্রদ্ধেয়। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীকে ভারতের আধ্যাত্মিক সম্রাট হিসেবে গণ্য করা হয়। তার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়। অতঃপর খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী, শেখ ফরিদউদ্দীন গঞ্জে শকর, নিজামউদ্দীন আওলিয়া প্রমুখ সাধক ও পীর-আওলিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়, যারা ভারতের সর্বত্র ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের সেই ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালে এবং এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ভারতের প্রতিটি প্রান্তে, গ্রামে ও জনপদে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন কত যে আওলিয়া, দরবেশ, পীর-ফকির ও সূফী সাধক তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মুসলিম শাসকদের অধিকাংশই ব্যস্ত থেকেছেন যুদ্ধ ও রাজ্যশাসনে, ইসলাম প্রচার-প্রতিষ্ঠার কাজে তারা পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেননি। এই কাজটি করেছেন আওলিয়া-দরবেশ, পীর-ফকিররা। লক্ষ করার বিষয়, দিল্লী শত শত বছর মুসলিম সুলতান-সম্রাটদের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র বা রাজধানী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। অথচ, দিল্লীতে বরাবরই মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। শাসকরা তরবারি নয়, ইঙ্গিত দিলেই দিল্লীর অমুসলিমরা তাদের স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলামন হয়ে যেতো। তাই তরবারির জোরে মুসলমান অভিযানকারী ও শাসকরা ভারতে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছেন, এ কথা মোটেই সত্য নয়।

দিল্লীতে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জনপদে মুসলমানরা বরাবরই সংখ্যালঘু থেকে গেছে। অথচ, বাংলা, বিহার, সিন্ধু, পাঞ্জাব প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, যা দিল্লী থেকে অনেক দূরে। ষোড়শ শতকেই পুর্তগীজ পর্যটক দুয়ার্তে বারবোসা বাংলাভাষীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ করেছিলেন। এর চার-পাঁচশ’ বছর পরে দেখা গেছে বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। উল্লেখিত অন্য এলাকাগুলোতেও এমনটাই দেখা গেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। এ ক্ষেত্রে অমুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি অনুরাগ যেমন কাজ করেছে, তেমনি প্রচারক দলের ভূমিকাসহ আওলিয়া-দরবেশ, পীর-ফকিরদের অবদানও রয়েছে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জহির উদ্দীন বাবর দিগি¦জয়ের বাঘ-১৩
জহির উদ্দীন বাবর দিগি¦জয়ের বাঘ-১২
জহির উদ্দীন বাবর দিগ্বিজয়ের বাঘ-১১
জহির উদ্দীন বাবর : দিগ্বিজয়ের বাঘ-১০
জহির উদ্দীন বাবর দিগ্বিজয়ের বাঘ-৯
আরও

আরও পড়ুন

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে  রুখে দিতে হবে

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে রুখে দিতে হবে

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

টাকার বিছানায় ঘুম

টাকার বিছানায় ঘুম

চশমার যাদুঘর

চশমার যাদুঘর

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

গ্রেফতার সেই কুমির

গ্রেফতার সেই কুমির

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?