ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান-৪

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৬ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৪ পিএম

ওদিকে ঐতিহাসিকের বর্ণনায় এসেছে, সোমনাথে বিপুল সংখ্যক হিন্দু প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ নিহত হয়েছিল। হিন্দু বলে নয়, যোদ্ধা হিসেবেই তারা নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ আবিষ্কার করা অবান্তর। সুলতান মাহমুদ হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। স্যার ডব্লিউ হেইগের মতে, তার ধর্মনীতি ছিল সহিষ্ণুতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার উৎসাহ যথেষ্ট ছিল, তথাপি তিনি এক বিরাট হিন্দু সেনাদল পোষণ করতেন। এ কথা বিশ্বাস করার কোনো হেতু নেই যে, ধর্মান্তর তাদের চাকরির শর্ত ছিল। বলা আবশ্যক, সুলতান মাহমুদের সেনাবাহিনীতে তুর্কি, আরব ও আফগানদের সঙ্গে হিন্দুরাও সমমর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করত। তিনি গজনীতে হিন্দুদের বসবাসের জন্য স্বতন্ত্র বসতির ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা সেখানে ইচ্ছানুযায়ী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। তিনি হিন্দুদের বহু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। গজনীর সমর বিভাগে উচ্চ পদাধিকারী তিলক রায়, হাজারী রায় প্রমুখের নাম জানা যায়। সুলতান মাহমুদ গজনীতে হিন্দু সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রসারে কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।

সুলতান মাহমুদ তার কালের শ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন। বিজেতা হিসেবে তাকে হিন্দু স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা ও বিশাল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে তুলনা করে ইতিহাসবেত্তারা বলেছেন, তার চেয়েও বিজেতা হিসেবে সুলতান মাহমুদ সফল ছিলেন। ইতিহাসবিদ গিবন বলেছেন, সুলতান মাহমুদ বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের চেয়েও বিজেতা ও দেশনায়ক হিসেবে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি একটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে সুসংহত ও সুশাসিত সা¤্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল। তার রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা সবসময় বিরাজমান ছিল। তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারক। তার ন্যায়বিচার সম্পর্কে অনেক কাহিনী ইতিহাস গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে।

সুলতান মাহমুদ সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পকলা, সঙ্গীত ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার উদার পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই তৎকালীন বিখ্যাত জ্ঞানীগুণীরা তার রাজসভায় অতুল্য সম্মানের অধিকার অর্জন করেছিলেন। বহুশাস্ত্রবিদ ও ভারত বিশেষজ্ঞ আল বিরুনী, ঐতিহাসিক উতবি, দার্শনিক ফারাবি ও বাইহাকির কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। মহাকবি ফেরদৌসীসহ উনসুরি, ফররুখি, আসজুদি প্রমুখ সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলন। সুলতান মাহমুদ প্রচুর ধনসম্পদ ও অর্থের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু সেই অর্থ-সম্পদ তিনি নিজের সুখ বা বিলাসের জন্য ব্যয় করেননি। রাজ্যের বস্তুগত উন্নয়ন, শিক্ষা-সংস্কৃতিক বিকাশ ও জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি এ অর্থ ব্যয় করেছিলেন।

ভারতবর্ষ ও ইসলাম গ্রন্থের লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার মর্মকথা হলো: স্থানবাচক হিন্দু শব্দটি মনুষ্য বাচক হিসেবে সুলতান মাহমুদই প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি আরো বলতে চেয়েছেন, আর্যাবর্ত চেতনায় বুদ হিন্দুদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সুলতান মাহমুদের ভূমিকা প্রধান। তিনি লিখেছেন: সুলতান মাহমুদ ভারতে নিজে কোনো সা¤্রাজ্য স্থাপন না করলেও নিজের অজ্ঞাতেই আর্যবর্ত চেতনার মধ্যে অবরুদ্ধ ভারতবাসীদের বহির্বিশ্ব চেতনাতে মুক্তি দিয়ে নতুন জনগোষ্ঠী তথা ধর্ম প্রসারণের আবশ্যক পূর্বাবস্থা সৃষ্টি করে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনাকারী হিসেবে অমীয় পরাক্রমশালী ও নৃশংস হত্যাকারী(!) ভারতীয় জ্ঞান ও সাহিত্য গ্রিসের দর্শন ও ইসলামের তত্ত্বে সুপ-িত, স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতির গুণগ্রাহী গজনীর মাহমুদকে স্বীকার করে নেয়াই সমীচীন।

পরিশেষে ড. ঈশ্বরী প্রসাদের একটি বক্তব্য দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করেছি। তিনি লিখেছেন: ইতিহাসে মাহমুদের স্থান নির্বাচন করা কঠিন নয়। সমসাময়িক মুসলমানরা তাকে গাজী ও ইসলাম নেতা বলে মানতেন। হিন্দুরা অনেকে আজ পর্যন্ত তাকে নিষ্ঠুর অত্যাচারী আদি হুণ, মন্দির ও মূর্তিভঙ্গকারী বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু যিনি সে যুগের খবর রাখেন, তিনি ভিন্নমত পোষণ করতে বাধ্য। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের চোখে সুলতান মাহমুদ একজন শ্রেষ্ঠ জননেতা, ন্যায়পরায়ণ সুলতান, সাহসী ও প্রভাবশালী সেনাপতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলার উৎসাহদাতা ছিলেন। তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা-বাদশাদের এক আসনে বসার সমকক্ষ। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সিরাজ সভাপতি ইকবাল সেক্রেটারি নির্বাচিত

সিরাজ সভাপতি ইকবাল সেক্রেটারি নির্বাচিত

ফুলবাড়ীতে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ শেষে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করলেন মুসল্লিরা

ফুলবাড়ীতে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ শেষে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করলেন মুসল্লিরা

চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস; অসহ্য তীব্র তাপপ্রবাহে অস্থির জেলাবাসী

চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস; অসহ্য তীব্র তাপপ্রবাহে অস্থির জেলাবাসী

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছে ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন যুদ্ধবিরোধী শিক্ষার্থীদের দমন করতে পারছে না প্রশাসন

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছে ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন যুদ্ধবিরোধী শিক্ষার্থীদের দমন করতে পারছে না প্রশাসন

কেশবপুরে এক ট্রাকের পেছনে অপর ট্রাকের ধাক্কায় নিহত-১

কেশবপুরে এক ট্রাকের পেছনে অপর ট্রাকের ধাক্কায় নিহত-১

বিএনপি যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে: ওবায়দুল কাদের

বিএনপি যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে: ওবায়দুল কাদের

ভোলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি

ভোলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি

লালমনিরহাটে বৃষ্টি চেয়ে অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা

লালমনিরহাটে বৃষ্টি চেয়ে অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা

কত বছর বয়সী ছাগল সদকা করতে হয় প্রসঙ্গে।

কত বছর বয়সী ছাগল সদকা করতে হয় প্রসঙ্গে।

জিআই পণ্যের গুণগত মান ও টেকসই সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী

জিআই পণ্যের গুণগত মান ও টেকসই সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী

কুষ্টিয়ার খোকসায় দেওয়াল চাপাই শিশুর মৃত্যু

কুষ্টিয়ার খোকসায় দেওয়াল চাপাই শিশুর মৃত্যু

ফটো সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় মানুষের অসহায়ত্বের ছবি তুলে- সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন

ফটো সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় মানুষের অসহায়ত্বের ছবি তুলে- সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন

তিন দেশে আমিরের সফর থেকে কাতার কী পেতে চাইছে?

তিন দেশে আমিরের সফর থেকে কাতার কী পেতে চাইছে?

সারাদেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও সমানতালে উন্নয়নের গতিধারা এগিয়ে চলছে : পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী

সারাদেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও সমানতালে উন্নয়নের গতিধারা এগিয়ে চলছে : পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী

সংসদ সদস্য তমা-কে আ'লীগের বরণ-দিলেন নানা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি

সংসদ সদস্য তমা-কে আ'লীগের বরণ-দিলেন নানা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি

হিটস্ট্রোকে স্কুলের শিক্ষার্থীর মৃত্যু

হিটস্ট্রোকে স্কুলের শিক্ষার্থীর মৃত্যু

দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীর সংখ্যা বাড়ছে

দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীর সংখ্যা বাড়ছে

চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার নির্দেশ গণপূর্তমন্ত্রীর

চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার নির্দেশ গণপূর্তমন্ত্রীর

ফের মার্কিন ও ইসরাইলি জাহাজে হামলা হুথিদের

ফের মার্কিন ও ইসরাইলি জাহাজে হামলা হুথিদের

ঢাবিতে অনুমতি মেলেনি সালাতুল ইসতিসকার

ঢাবিতে অনুমতি মেলেনি সালাতুল ইসতিসকার