যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির প্রভাব
২৬ মে ২০২৩, ০৭:৫৮ পিএম | আপডেট: ২৭ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

বেশ কয়েক মাস ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে একটা শঙ্কা ও গুঞ্জণ রাজনৈতিক অঙ্গণ থেকে শুরু করে সর্বত্র ছিল। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে ৩০ মে’র মধ্যে স্যাংশন আসতে পারে এমন একটা খবরও একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়। দেখা গেছে, তার আগেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের ভিসা দেবে না বলে জানিয়ে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যাদের ভিসা দেবে না বলে জানানো হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি এমন এক নীতি যা, স্যাংশনের চেয়েও বিপজ্জনক এবং বিস্তৃত। কারণ, স্যাংশন দিলে তা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর দেয়া হয়, যেমনটি দেয়া হয়েছিল র্যাব ও পুলিশের সাত কর্মকর্তার ওপর। এই ভিসানীতির কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে, অমুক ব্যক্তিকে ভিসা দেয়া যাবে না, তাহলে তা সে নির্দ্বিধায় করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভিসানীতি নিয়ে বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে’ এই নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে, ‘যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে সমর্থন দেয়া’। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এ নিয়ে উদ্বেগ বা শঙ্কার কিছু নেই। তবে বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতিকে নজিরবিহীন এবং দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগে গত ১৫ মে নাইজেরিয়ার নির্বাচনের ব্যাপারে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে উগান্ডার নির্বাচনের পর দেশটির কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়। তবে এসবই নির্বাচনের পরে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নির্বাচনের আগে আগে এতো বিস্তৃত আকারে নেয়া হয়নি।
র্যাব ও পুলিশের সাত সদস্যের ওপর যখন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দেয়, তখন এ নিয়ে সরকারের সতর্ক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা আমরা বহুবার বলেছি। পরিতাপের বিষয়, সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে খুব একটা আমলে না নিয়ে উল্টো বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন। গুরুত্বসহকারে নেননি। এখন যুক্তরাষ্ট্র যেসব কারণ দেখিয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তার প্রতিক্রিয়া ও ব্যাপ্তি যে বিস্তৃত হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও প্রকারন্তরে কবুল করেছেন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি একে স্বাগত জানিয়েছে বটে, তবে তার নেতাকর্মীরাও এ ভিসানীতির বাইরে নন। অবশ্য বড় রকমের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। এমনকি যেসব শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছে, তাদের মধ্যেও আতঙ্ক ও সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ হচ্ছে, ভিসানীতি একান্তই যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, তাদের ওপর এ নীতি প্রয়োগ করতে পারে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো যদি তা অনুসরণ করে, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে একটি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে। এর জন্য যে কারণগুলো যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে তার প্রায় সবই সরকার সৃষ্ট। বহু বছর ধরেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা, সুশীল সমাজ একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে তাকিদ দিয়ে আসছিল। সরকার বরাবরই তাদের এই তাকিদ অস্বীকার করে এসেছে। শুধু তাই নয়, দেশে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগও করা হয়েছে। সরকার এসব বিষয় তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয়কে ভিত্তি ধরেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার যদি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা চালু এবং অনুকূল পরিস্থিতি বজায় রাখত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করার প্রয়োজনই হতো না। এ নিয়ে আলোচনারও দরকার পড়ত না। এদিকে, যেদিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেছে, তার পরদিনই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে। ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। কোথাও তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যে যাই বলুক, যুক্তরাষ্ট্রের এ ভিসা নিষেধাজ্ঞা যে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এর প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও যতই দিন যাবে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এটি শুধু সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও এক ধরনের সংকোচপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা এমন কোনো পরিস্থিতিতে নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্রদেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারব। সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে যতই তিরস্কার করুক না কেন, এখনও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় রফতানির বাজার। দেশটিতে বছরে ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয় এবং সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ওপেন সিক্রেট। কোনো দেশের লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বাইরে খুব একটা যায় না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্র দেশগুলোর সাথে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং এগিয়ে নেয়াই উত্তম।
যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা সহজে পরিবর্তন হয় না। আমরা দেখেছি, ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন জিএসপি সুবিধা বাতিল করে, তা পরবর্তীতে বহু দেনদরবার করেও ফেরত পাওয়া যায়নি। অনুরূপভাবে র্যাব ও পুলিশের সাত সদস্যর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তাও প্রত্যাহার করা হয়নি। নতুন যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা বেশ জোরালোভাবেই দেয়া হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে সরকারের ভুল নীতির কারণে এটি খড়গ হয়ে এসেছে। এ থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া দুরহ। যুক্তরাষ্ট্র যদিও বলেছে, এটি বাংলাদেশের জন্য তার ‘সিগন্যাল’। তারপরও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারের উচিৎ যেসব কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তা দৃশ্যমান সমাধান করার পথে অগ্রসর হওয়া, যাতে দেশটির কাছে প্রতীয়মান হয়, সরকার সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরও এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না দেয়া, যা দেশকে আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের যেসব কর্মকর্তা রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, তাদেরও শুধরে দলীয় পরিচয়ে নয়, পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করতে হবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ও বিরোধীদলের পারস্পরিক সমঝোতা অপরিহার্য। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করাসহ, গণতন্ত্রের উন্নয়ন, গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধীদলের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে এখন জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার বিকল্প নেই।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

বিদায়ী ম্যাচ গোলে রাঙালেন বেনজেমা,গোলরক্ষক বীরত্বে হার এড়াল রিয়াল

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট রিজিওনাল কনফারেন্স (পিএমআরসি) অনুষ্ঠিত

এডিস মশা কামড় দেয়ার সময় চিনবেনা কে মেয়র-কাউন্সিলর ইমাম-খতিব: ডিএনসিসি মেয়র

প্রাচীন ধর্ম সনাতকে শুধু শ্রদ্ধা নয় এ সম্পর্কে জানতে হবে, ইসকনের অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বান

সাংহাই উৎসবে লড়বে যেসব ইরানি ছবি

এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মেধাস্বত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : শাহরিয়ার

১০-১৫ দিনের মধ্যে বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা চলছে : নসরুল

গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে আজমত উল্লা খান

আগামীকাল থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বা আইপি দেয়া হবে

বাজেট সম্পর্কে আলোচনায় ডিব্রিফিং সেশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে : স্পিকার

প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য : প্রধানমন্ত্রী

দুর্বিষহ জনজীবন

পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে : প্রধানমন্ত্রী

গত অর্থবছরে বিমান লাভ করেছে ৪৩৬ কোটি টাকা : বিমান প্রতিমন্ত্রী

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ইওয়ামা কিমিনোরি ও জিএম কাদেরের সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠক

নালিতাবাড়ীতে বিদ্যুত স্পৃষ্ট হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করবেন নির্বাচনকালীন ছোট সরকার গঠন করবেন : আইনমন্ত্রী

লোডশেডিং আরো দুই সপ্তাহ

সাগরে ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরা ঠেকাবে