একাত্তরের চেতনায় চব্বিশকে ধারণ করতে হবে
১১ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৫ এএম | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৫ এএম

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রাণের অফুরন্ত বিজয়। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে এ বিজয়ের চূড়ান্ত সফলতা অর্জিত হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন। ঠিক একইভাবে বায়ন্ন ও একাত্তরের চেতনায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সফলতা বাঙালি জাতিকে নতুনভাবে দেশ গড়ার কাজে উজ্জীবিত করবে। এ চেতনা ধারণ করেই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব। অতি সম্প্রতি ভারতভিত্তিক স্বাধীন সাংবাদিক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর অর্ক দেব কর্তৃক গৃহীত বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। সেখানে একাত্তরের চেতনার কথা বলা হয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাদামাটা আলাপ-আলোচনা করেন প্রফেসর অর্ক দেব। তার আলোচনার মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব হিসাব-নিকাশ চলছে সে বিষয়ে তিনি সরাসরি কথা বলতে চেষ্টা করেছেন সাক্ষাৎকারে। বর্তমান রাজনৈতিক ইস্যুতে ইসলামী রক্ষণশীল দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী ও তার কর্মকান্ডের ব্যাপারেও মি. অর্ক দেব খোলামেলা ইতিবাচক আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। অর্ক দেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় স্বাধীন অনলাইন গণমাধ্যম ইনস্ক্রিপ্ট ডটমি। সাক্ষাৎকারটি ঐ গণমাধ্যম যা প্রকাশ করেছে তার কিছু অংশ বিশ্লেষণসহ সম্মানিত পাঠক মহলের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
ঐ গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও ইচ্ছা করেই জামায়াত ইস্যুটা প্রাসঙ্গিক করে রাখা হয়েছে। যে কোনো বিরোধিতা বা আন্দোলনকেই জামায়াত-শিবির ট্যাগ দেয়ার প্রবণতা ছিল। তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। জামায়াতের নেতৃত্ব এখন মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেই তাদের বক্তব্য দিচ্ছে। চব্বিশের সফল গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়ার সুবাদে জামায়াতের কাফফারা আদায় হয়েছে। কিন্তু জামায়াতকে সত্যিকার অর্থে অঙ্গীকার করতে হবে যে, একাত্তর একটি মীমাংসিত বিষয়। এ বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে তারা কোনো রাজনৈতিক বিরোধিতা করবে না। একাত্তর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করবে না। এমন একটি নিশ্চয়তা তাদের দিতে হবে। বর্তমান সময়ের মূল নেতৃত্ব একাত্তর নিয়ে কথা বলছে না এটি একেবারেই সঠিক। কিন্তু অনলাইন কর্মীরা নানা কথাবার্তা জনস্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও বাকযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, নতুন করে বিভাজনের যে রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা দেশবাসী চায় না।’
আমাদের জানা থাকা উচিত বৈকি, একাত্তরের চেতনার মূল উৎস ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের মাধ্যমে একাত্তরের ভিত্তি রচিত হয়েছিল একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আবার একাত্তরের চেতনায় নব্বই এবং তৎপরবর্তীকালে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে তাতেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। একাত্তর আমাদের ভিত্তি। তাই একাত্তরের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে বিতর্ক নির্মাণের রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা পঞ্চাশ বছর পার করে চুয়ান্নতে রাইড করে ফেলেছি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে কিছু বিচার হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, জামায়াত অনুসারীদের একাত্তরে বিরোধিতার জন্য বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো করেছে, এখনো তো তাদের বিচার হয়নি। অর্ক দেব নাহিদ ইসলামকে প্রশ্ন করেন যে, ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের সুযোগ, না নিষিদ্ধ?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ বলেন, কাদের সঙ্গে সংলাপ করব, তার তো একটা সীমারেখা আছে। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ সেই ফ্রেমওয়ার্কেই আসে না। তারা তো বাকশাল কায়েম করেছে, জুলাই-২০২৪ এর মতো বড় ধরনের গণহত্যা ঘটিয়েছে। অথচ, এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কোনো অনুশোচনা নেই। তারা জুলাই বিপ্লবকে স্বীকৃতি দেয়নি। নাহিদ বলেন, আমরা কিন্তু শুরুতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কথা বলিনি। কিন্তু ছাত্রলীগ মিছিল ও গুপ্তহত্যা শুরু করেছে। শহীদ পরিবারের ওপর হামলা করেছিল ওরা। এটা এখন জননিরাপত্তার বিষয়। আমরা বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। দল হিসেবে ওদের ভূমিকা প্রমাণিত হতো এর মাধ্যমে। আমরা চাইলে ৮ আগষ্টেই নিষিদ্ধ করে দিতে পারতাম ছাত্রলীগকে। কিন্তু ওরা এ সুযোগে সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চাইছে। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে নাহিদ বলেন, আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের মতাদর্শ ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ। এ মতাদর্শ বাংলাদেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ মতাদর্শকে আর সামনে আসার সুযোগ দেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে গ্রহণ করবে না। নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের দেখতে হবে, বিরোধী হলেই যেন আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে দেয়া না হয়, যেমন আগে বিপক্ষে কথা বললেই জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দেয়া হতো। আমরা চাই, যারা নির্দোষ তারা সমাজে শান্তিতে বসবাসের অধিকার পাক।
নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, ভারত সরকার শেখ হাসিনা এবং বেশ কিছু আওয়ামী নেতাকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা একটা ব্যাখ্যা আমাদের দিয়েছে। তারা বলেছে, শেখ হাসিনাকে কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করতে দেয়া হবে না। সেই প্রতিশ্রুতি যথাযথ রক্ষা হচ্ছে না। বিচার হওয়ার আগে হাসিনার সব সক্রিয়তার ব্যাপারে আমরা ভারত সরকারকেই প্রশ্ন করব। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা বারবার মানুষকে সংযত থাকতে বলেছি। মানুষ আমাদের কথা মেনে নিয়েছে। সেই সময় সরকার ছিল না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু পরিস্থিতি অন্যদিকে যেতে পারত। বহু আওয়ামী লীগ নেতা পালিয়ে গিয়েছে। অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে আছে; তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। যারা নির্যাতন করেছে, নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এ ক্ষোভ থাকবে যতদিন নির্বাচন না হয়। ধানমন্ডির ঘটনা এ বিক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি হোক।
সরকার বা উপদেষ্টারা ‘মব জাস্টিস’ সমর্থন করছেন কি না-এমন একটি প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, না করছি না। আপনাকে বুঝতে হবে, এটা অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি। এ সময় মানুষের মধ্যে সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা থাকে। তাদের সেবাশুশ্রূষা করা দরকার হয়। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। আমরা কোনো ঘটনাকে প্রশ্রয় দিইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, আমরা জড়িতদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করেছি। আমরা সবাইকে সচেতন হতে অনুরোধ করেছি। আরেকটা কথা মাথায় রাখবেন, বাংলাদেশে পুলিশ ব্যবস্থা এখনো সক্রিয় নয়, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক নয়।
অতএব, অধ্যাপক অর্ক দেব কর্তৃক গৃহীত এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা পরিস্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারি যে, জামায়াত ইস্যুতে বিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যেসব জবাব দিয়েছেন, তা সময়ের সাথে সমন্বয় করেই জবাব দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ জামায়াতকে বিরোধিতার সুবাদে যে যাই বলুন না কেন, ইতোমধ্যেই জামায়াত একটি উদারপন্থী দল হিসেবে নিজেদেরকে জনগণের নিকট প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটলেই জামায়াতের ওপর ট্যাগ লাগানো হয়, শিবিরকে যুক্ত করা হয়, যা সম্পূর্ণভাবে শিষ্টাচার বিবর্জিত।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিভেদের রাজনীতিতে জামায়াত-শিবিরকে জড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ তকমা দিয়ে জাতিকে বিপরীতমুখী দুই মেরুতে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে দীর্ঘিদিন ধরে। জাতি এখন আর পুরাতন বাসি খাবার খেতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ত্ব মেনে নিয়েই জামায়াত নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনীতি করে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মতো কোনো অসভ্য, বিভেদপূর্ণ, নোংরামি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জামায়াত-শিবির যে বিশ্বাস করে না তা জনগণের নিকট ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ ভোট দিলে হয়তো তারা সরকার গঠন করবে। তাই তাদের বর্তমান কর্মকান্ড যাতে ফ্যাসিস্টদের অনুরূপ কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, কোনো পুরাতন ঘুনে ধরা পরিত্যাক্ত জিনিসকে সামনে না এনে সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বিজয়ের শক্তিগুলোকে বায়ান্ন একাত্তর নব্বই এবং চব্বিশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলাই সকলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দেশ-জাতি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে এ চেতনা বুকে ধারণ করেই সুন্দর একটি বাংলাদেশ জাতির জন্য উপহার দিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়ন বিকেএসপি

‘বিদেশি’ আনছে ভারতও!

কর্ণফুলীতে বন্যহাতির আক্রমণে শিশুর মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নিহত

ঝিনাইদহে জমে উঠেছে ঈদের বাজার ক্রেতাদের ঝোঁক দেশি পোশাকে

সুশীল বিপ্লবীরা আ.লীগের পুনর্বাসন করতে চায় : রাশেদ খান

ধানমন্ডিতে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের ৭ সদস্য রিমান্ডে

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৯০% ভোট পেয়ে বিএনপি জয়লাভ করবে : কায়কোবাদ

আপন চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৪ বছরের বোনকে ধর্ষণের অভিযোগ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে : মাহমুদুর রহমান মান্না

টিভিতে দেখুন

অমর একুশে হল ছাত্রদলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

বিশ্বকাপে এক পা আর্জেন্টিনার

মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ায় হাফেজ ছেলের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নামাজরত অবস্থায় বাবা নিহত

‘‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ কিংবদন্তি জর্জ ফোরম্যান আর নেই

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে : নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী

৬ এপ্রিল ক্যাম্পে ফিরছেন সাবিনারা

আর্জেন্টিনা ম্যাচে ‘বেকার’ আলিসনও

ইউট্যাবের ইফতার মাহফিলে খালেদা জিয়ার সুস্থতার কামনা

কুস্তির কমিটি নিয়ে ক্ষোভ অব্যহত