নির্বাচনের টাইম ফ্রেম প্রসঙ্গে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিল থাকলেও নির্বাচনের টাইম ফ্রেম নিয়ে কিছুটা মতভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে সাক্ষাতের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমের কাছে দেয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তিনি মোটেও সন্তুষ্ট নন। প্রধান উপদেষ্টা বরাবরের মতো বিএনপি প্রতিনিধিদলকে বলেছেন, তারা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে চান। অন্যদিকে বিএনপি ডিসেম্বরকে নির্বাচনের কাট অফ টাইম ধরে এর মধ্যেই নির্বাচন শেষ করার তাগিদ দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি না থাকায় মির্জা ফখরুল অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতিসহ এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি বা ঝুঁকির কথাও বলেছেন তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রধান অংশীদার ছাত্র সমন্বয়কদের নতুন দল এনসিপি নির্বাচনের আগে শর্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং পতিত স্বৈরাচারের বিচারে একটি নিশ্চিত অগ্রগতির কথা বলেছে। মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি নিকোল চুলিকের সাথে সাক্ষাৎ শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নির্বাচনের টাইম ফ্রেম নিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন তা কিছুটা অস্পষ্ট। মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা এবং সে নির্বাচনে এনসিপি অংশগ্রহণ করবে কিনা তা নিয়েও সংশয়ের কথা জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই জুন মাস অতিক্রম করবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করার উপর জোর দিয়েছেন। আগামী রমজান ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে শুরু হতে পারে। সে মোতাবেক তার আগেই জামায়াত নির্বাচন চায়। উল্লেখ্য, এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে স্কুল-মাদরাসার পরীক্ষা, পরের বছর মার্চ পর্যন্ত রোজা, এপ্রিল-মে-জুন বর্ষাবাদলের সময়। এ সময় নির্বাচন সম্ভব নয়।

সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের মতবিরোধ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে না থাকলেও কিছুটা মতানৈক্য অবশ্যই আছে। এই মতানৈক্যের পেছনেও তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ বক্তব্য আছে। তবে মূল ধারার রাজনীতির বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের কথাবার্তা ও দাবি-দাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষ ড. ইউনূসকে ৫-১০ বছর, এমনকি আজীবন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চায়। তড়িঘড়ি যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন দাবি যেমন প্রাসঙ্গিক কিংবা গ্রহণযোগ্যে নয়, তেমনি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের দাবিও গ্রহণযোগ্য নয়। সকলের মনে রাখা জরুরি যে, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছে। বিগত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও সাংবিধানিক বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে যে অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফলাফলের জন্য যৌক্তিক সময় অবশ্যই দিতে হবে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে রাষ্ট্রের প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। লাখ লাখ টাকা লুটপাট ও পাচারের মাধ্যমে প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় অর্থনীতিকে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে। দেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করা যায় না। ড. ইউনূসের অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, বিশ্ব দরবারে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাচ্ছে।

রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর গুম-খুন-গণহত্যাসহ নানা রকম গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত দলটির সহসাই রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা নেই। গত ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অন্যতম শিকার বিএনপি ও জামায়াত। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র সমন্বয়কদের রাজনৈতিক মঞ্চ এনসিপির সাথে তাদের মতবিরোধের কোনো সুযোগ নেই। মৌলিক সংস্কার, স্বৈরাচারের বিচার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, তা নিরসনে বাস্তবতাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। মত পার্থক্য তাদের জন্য কোনো সুখকর বিষয় নয়। বিএনপি সংস্কার চায় না, এমন ধারণা যারা জনমনে ছড়িয়ে দিতে চান, তারা সত্যের অপলাপ করছেন। বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’ এবং তারেক জিয়ার ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশাকেই ধারণ করে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দলীয় সরকার। আগাগোড়া এই সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন রয়েছে বিএনপিরর। বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। কতিপয় বিএনপি নেতার কিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ও নির্দেশনায় বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। জুলাই বিপ্লব নিয়ে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। অতএব, জুলাই বিপ্লবের অংশীজন ও সমর্থকদের মধ্যে মতবিরোধ ষড়যন্ত্রকারীদেরকেই সুযোগ করে দিতে পারে। এখন প্রশাসনের সর্বত্র পতিত স্বৈরাচারের নিয়োগকৃত দোসরদেরই আধিক্য রয়েছে। এরই মধ্যে এনসিপিকে বিএনপি’র প্রতি প্রশাসনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলতে শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনের রদবদলের ক্ষেত্রে কতিপয় সমন্বয়ক ও উপদেষ্টার বিতর্কিত ভূমিকার কথাও গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। এটা ভালো লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। স্বীকার করতেই হবে, গত ১৬ বছরে পুলিশ, সাধারণ প্রশাসন, এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর উপর মহলে চরমভাবে আওয়ামীকরণ হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত বা অন্যান্য দলের সমর্থকরা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। স্বৈরাচারের পতনের পর তারা সঙ্গতভাবে সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতটা সঙ্গত, সেটাই প্রশ্ন। এনসিপির বিএনপিকে লক্ষ্যবস্তু করা মোটেই উচিত নয়, এটি দলটির নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে এনসিপির নেতারা নেতৃত্বের আসনে থাকলেও তাদের যে ভুল হতে পারে না, এমন নয়। তাদের মনে রাখতে হবে, জাতির ক্রান্তিকালে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে না পারলে ইতিহাসের মহানায়কও খলনায়কে পরিণত হতে পারেন। আমাদের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লবের স্পিরিটকে ধারণ করেই যথার্থ কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ছাত্র রাজনীতি কেন প্রয়োজন
বজ্রপাত : প্রয়োজন পর্যাপ্ত সতর্কতা
অন্তর্বর্তী সরকার কি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে?
করিডোর ও বন্দর নিয়ে সরকারের দ্বিচারিতা
রাষ্ট্রে জননিরাপত্তা জোরদার করতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

জাতীয় স্বার্থে দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য সবার প্রতি জামায়াত আমিরের আহবান

জাতীয় স্বার্থে দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য সবার প্রতি জামায়াত আমিরের আহবান

বেলগোরোড, কুরস্ক অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রুশ সেনা

বেলগোরোড, কুরস্ক অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রুশ সেনা

সুনাম হারাচ্ছে এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলো

সুনাম হারাচ্ছে এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলো

চীনের মধ্যস্থতায় ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান

চীনের মধ্যস্থতায় ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান

বিশাল বহর নিয়ে ৩১ মে ঢাকায় আসছেন চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী

বিশাল বহর নিয়ে ৩১ মে ঢাকায় আসছেন চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী

কাতারের কাছ থেকে বিলাসবহুল জেট গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প

কাতারের কাছ থেকে বিলাসবহুল জেট গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প

মাওবাদী নেতাসহ ৩০ জনকে হত্যা করেছে ভারত : বিরোধী দলগুলোর নিন্দা

মাওবাদী নেতাসহ ৩০ জনকে হত্যা করেছে ভারত : বিরোধী দলগুলোর নিন্দা

গণ-অভ্যুত্থানের পর সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকা দিল সেনাবাহিনী

গণ-অভ্যুত্থানের পর সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকা দিল সেনাবাহিনী

অধ্যাপক ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’ : নাহিদ ইসলাম

অধ্যাপক ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’ : নাহিদ ইসলাম

ঈদের আগেই বাজারে মিলবে যেসব নতুন নোট

ঈদের আগেই বাজারে মিলবে যেসব নতুন নোট

প্রধান উপদেষ্টার কাছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের স্মারকলিপি

প্রধান উপদেষ্টার কাছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের স্মারকলিপি

জানতে দেয়া হয়নি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের সিদ্ধান্ত

জানতে দেয়া হয়নি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের সিদ্ধান্ত

পুঁজিবাজারে লেনদেন সূচক বেড়েছে

পুঁজিবাজারে লেনদেন সূচক বেড়েছে

কালোবাজারি রোধে কঠোর রেল

কালোবাজারি রোধে কঠোর রেল

বিদেশে খেলনার বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকা

বিদেশে খেলনার বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকা

অবৈধ রেলিক সিটিতে রাজউকের অভিযান, কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা

অবৈধ রেলিক সিটিতে রাজউকের অভিযান, কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা

সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাসহ ৫ দফা দাবি গণ অধিকার পরিষদের

সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাসহ ৫ দফা দাবি গণ অধিকার পরিষদের

দেশের সংকটময় যেকোনো পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেন জিয়া পরিবার -ব্যারিস্টার অমি

দেশের সংকটময় যেকোনো পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেন জিয়া পরিবার -ব্যারিস্টার অমি

বন্দরে শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা

বন্দরে শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা

চালককে হাতুড়িপেটা করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই

চালককে হাতুড়িপেটা করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই