বাঁধের বিপরীতে বাঁধই হতে পারে ভারতের সাথে পানি সমস্যার সমাধান
৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম

বাংলাদেশ এবং ভারত পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র। ভারত উজানের এবং বাংলাদেশ ভাটির দেশ। দেশ দুটির মধ্যে ৫৪ টি অভিন্ন নদী রয়েছে, যা ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সব সময় নিচের দিকেই পানি প্রবাহিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারত হয়ে প্রবাহিত হওয়া নদীর পানি সবসময় উজানের দেশ ভারত হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব নদীর কয়েকটিতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং এর মাধ্যমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। বাঁধ নির্মাণের ফলে এসব নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ব্যাহত হয়। ভারত শুস্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখে, ফলে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানি হতে বঞ্চিত হয়। বর্ষা মৌসুমে ভারত বন্যা-বৃষ্টির পানি ছেড়ে দেয়। এতে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হয়। এভাবে বাংলাদেশ বরারবই আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং ভারত কর্তৃক সবসময় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেসব নদীতে ভারত তার অংশে বাঁধ দিয়েছে, সেসব নদীর বাংলাদেশ অংশে বাঁধ নির্মাণ হতে পারে পানি সমস্যার যৌক্তিক এবং টেকসই সমাধান।
পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে গঙ্গা নদীতে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ভারতের ১৮ কিলোমিটার ভিতরে অবস্থিত। ২৩০৪ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বাঁধটির নির্মাণ ১৯৬১ সালে শুরু এবং ১৯৭৫ সালে শেষ হয়। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল এটি চালু হয়। গঙ্গা নদীটি চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা হয়ে পদ্মা নামে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলার গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীতে ভারত গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে। ১৭৬ মিটার দীর্ঘ বাঁধটির নির্মাণ ১৯৯৮ সালে শুরু এবং ২০০৭ সালে স¤পন্ন হয়, যা বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ভারতের ৬০ কিলোমিটার ভিতরে অবস্থিত। তিস্তা নদীটি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলা দিয়ে ভারত হতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলার গন্ডাচেরায় গোমতী নদীতে ভারত ডম্বুর বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ভারতের ১২০ কিলোমিটার ভিতরে অবস্থিত। ১০৩ মিটার দীর্ঘ বাঁধটির নির্মাণ ১৯৬৯ সালে শুরু এবং ১৯৭৪ সালে শেষ হয়। গোমতি নদীটি কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে ভারত কিছুতেই এসব নদীতে বাঁধ দিতে এবং ইচ্ছামত পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ভারত শক্তির জোরে অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানি হতে বঞ্চিত করে চলেছে।
ভারত অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিরাট সংখ্যক মানুষ শুস্ক মৌসুমে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ৮-১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। পানির অভাবে মাটির আর্দ্রতা শুস্ক মৌসুমে ৩৫% পর্যন্ত কমে গেছে এবং লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় কুষ্টিয়ার বেড়ামারায় অবস্থিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নদীতে মাছের সরবরাহ কমে গেছে। অনেক জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। নাব্য কমে যাওয়ায় নদীসমুহ বেশি পানি ধারন করতে পারে না। ফলে বর্ষাকালে বেশি বন্যা হয়। শুস্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় দেশে ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌ-পথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। গড়াই নদী ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়ে অনেকটাই মরে গেছে। কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে শুস্ক মৌসুমে গাড়ি চলে। ভারত তিস্তা নদীতে গজলডোবা বাঁধ দেয়ায় শুস্ক মৌসুমে পানি কমে যায়। এতে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক মানুষ সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বর্ষাকালে এসব বাঁধ হতে পানি ছেড়ে দেয়ায় দেশের বিরাট এলাকায় প্রতি বছর বন্যা হয়। বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি ভারত কখনো বাংলাদেশকে জানায় না। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, বাংলাদেশকে তা জানানোর বাধ্যবাধকতা ভারতের রয়েছে। ভারত কর্তৃক গোমতী নদীর ওপর নির্মিত ডুম্বুর বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় ২০২৪ সালে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এভাবে অভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করছে এবং বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে পানির নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে পনের বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত স¤পর্ক অত্যন্ত ভাল বলে সব সময় বলা হয়েনে। তারপরও তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে ভারত চুক্তি করেনি এবং বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করেছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পানি বন্টন সমস্যা সমাধানে যৌথ নদী কমিশন থাকলেও তা অনেকটাই অকার্যকর এবং এই কমিশন ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশেকে ন্যায্য পানি এনে দিতে পারেনি। ভারত যেহেতু বাংলাদেশকে ন্যায্য পানি দিচ্ছে না এবং চুক্তিও করছে না, সেহেতু এ সমস্যা সমাধানে ভারতের দেওয়া বাঁধের বিপরীতে বাংলাদেশ অংশে আমরা অনুরূপ বাঁধ নির্মাণ করতে পারি। এটিই হতে পারে অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার যৌক্তিক ও টেকসই সমাধান। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হতে বাংলাদেশের ৫০-১০০ কিলোমিটার ভিতরে সুবিধাজনক স্থানে পদ্মা নদীর ওপর আমরা ফারাক্কার বিকল্প একটি বাঁধ নির্মাণ করতে পারি। বাঁধটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হতে একটু বেশি পরিমাণে বাংলাদেশের ভিতরে হতে হবে। ফারাক্কা বাঁধ হতে বাংলাদেশের ভিতরে বাঁধের দুরত্ব যত বেশি হবে, বাঁধের উজানে পানি ধারনের আধার তত বড় হবে। ফলে বাঁধটি দিয়ে বেশি পরিমাণে পানি আটকে রাখা যাবে। বাঁধে অনেকগুলো গেইট থাকবে, যা প্রয়োজন মতো খোলা এবং বন্ধের মাধ্যমে পানি ছেড়ে দেয়া অথবা আটক রাখা যাবে। বাঁধের সামনে-পিছনে নদীর অংশকে ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়াতে হবে এবং দুই তীর উঁচু করতে হবে। ফলে বাঁধের সামনের নদীর অংশ বেশি পরিমাণে পানি ধারন করতে পারবে এবং বাঁধ হতে ছেড়ে দেয়া পানি বাঁধের পিছনের অংশ দিয়ে নিচের দিকে চলে যাবে। এরকম বাঁধ নির্মাণ হলে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা হতে ছেড়ে দেয়া পানি এবং বৃষ্টির পানি বাঁধের সামনের অংশের নদীতে জমা থাকবে। এই পানির ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং বাংলাদেশ প্রয়োজন মতো পানি আটকে রাখবে অথবা ছেড়ে দেবে। বাঁধের বিপরীতে বাঁধ কিন্তু নতুন ধারনা নয়। প্রস্তাবিত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি এরকমই একটি বাঁধ। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা নদীসমূহ বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে এবং অন্যকোনো দেশে যায়নি। তাই এসব নদীতে বাধঁ দিতে আন্তর্জাতিক নিয়মে কোন বিধি নিষেধ নেই।
আমরা পদ্মা এবং তিস্তা নদীর ওপর দুটি বাঁধ নির্মাণ করতে পারি। তিস্তা নদীর ওপর প্রস্তাবিত বাঁধটি তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নামে সরকার ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে। চীন প্রকল্পটি সার্ভেও করেছে এবং প্রকল্পে অর্থায়ন করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। ভারতের প্রভাবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনকে দেয়নি। ফলে পরিকল্পনা গ্রহণ, সার্ভে, ফিজিবিলিটি স্টাডি স¤পন্ন করা এবং চীনের অর্থায়ন ও নির্মাণের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি, কাজও শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ চালাচ্ছে। এ অবস্থায় তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানাই। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অপেক্ষার দরকার নেই। এখনই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হোক। একই সাথে পদ্মা নদীর ওপর আরেকটি ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ারও আহবান জানাচ্ছি। পাশাপাশি নদীগুলোকে ড্রেজিং করে নাব্য বাড়াতে হবে। এতে নদীগুলেঅর পানি ধারন ক্ষমতা বাড়বে। বন্যা কম হবে, কৃষি কাজ বৃদ্ধি পাবে, নৌ-পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, মাছ বেশি পাওয়া যাবে, পানির লবনাক্ততা কমবে এবং পরিবেশ ভাল থাকবে। বেকারত্ব কমবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। আমাদের অর্থনীতি উন্নত এবং গতিশীল হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও রাষ্ট্রচিন্তক।
ই-মেইল : [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ডাক বিভাগের মাধ্যমে ঢাকায় আম আনবেন কওমি তরুণ উদ্যোক্তারা

চলতি মাসেই বাজারে আসছে আমের রাজধানীর আম

পাকিস্তানের ‘শূন্য শুল্ক’ প্রস্তাব, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে নতুন কূটনৈতিক বার্তা

২০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, এআই প্রযুক্তিতেও আমিরাতের পাশে যুক্তরাষ্ট্র!

মোরেলগঞ্জে পানি তালের কদর সারাদেশে

দুর্দান্ত ইয়ামালে বার্সার লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধার

ফিলিস্তিনিদের ৬০০ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিল ইসরাইল

গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ২৮

লাইভ চলাকালীন জনপ্রিয় টিকটকারকে গুলি করে হত্যা

পটুয়াখালীতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর উদ্যোগে অবহিতকরণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

ভারতে সন্দেহভাজন ‘১৪৮ বাংলাদেশিকে’ ত্রিপুরায় স্থানান্তর, হতে পারে পুশ ব্যাক

বাড়ল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সময়সীমা

কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সাজ এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না শেরপুর গারো পাহাড়ে!

ভারতের আরও একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি পাকিস্তানের

পাকিস্তানের জন্য স্থগিতই থাকছে সিন্ধু পানি চুক্তি, জানাল ভারত

আটঘরিয়ায় বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ; মোটরসাইকেল ও অফিস ভাঙচুর, আহত ৫

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমাবেশ আজ

গরু নিয়ে যাওয়া সেই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিষ্কার

ট্রাম্প-পুতিন সরাসরি বৈঠক ছাড়া ইউক্রেন সংকটের সমাধান অসম্ভব: রুবিও

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একদিনেই নিহত ১৪৩ ফিলিস্তিনি