বিজেপির আগ্রাসী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের জন্য বুমেরাং হবে
৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম

গত দেড় দশকে ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল ন্যারেটিভই হচ্ছে, মুসলমান জঙ্গিবাদী কার্ড ব্যবহার করে ভোটের লড়াইয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে সাম্প্রদায়িক জনতুষ্টিমূলক এজেন্ডার দ্বারা আচ্ছন্ন রাখা। একে এখন আর আচ্ছন্নতা বলা যায় না, এটি এখন রক্তপিপাসু উন্মত্ততায় পর্যবসিত হচ্ছে। হাজার বছর ধরে মুসলমান সুলতান ও মোঘলদের দ্বারা ভারত শাসিত হয়েছে। সে সময়টা ছিল ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গঠন ও সমৃদ্ধির যুগ। একদা স্থানীয় রাজ-রাজরা ও সামন্ত শাসিত বহুধা বিভক্ত ভারতীয় রাজ্যগুলোকে জয় করে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে একীভূত করার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেছিল। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সম্প্রীতিই ছিল বৃহত্তর মোঘল সা¤্রাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি। মোঘল শাসকরা বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিদ্ধু বিজয় থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত হাজার বছরে মুসলমান শাসকরা পুরো ভারতকে হিন্দু জনশূন্য করে ফেলতে পারতেন। তারা শুধু হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতির মাধ্যমে ভারতকে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ শান্তির জনপদে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক বৃটিশরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানদের অনাস্থা, অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠিকে হাতে রেখে ভারত শাসন দীর্ঘায়িত করে এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বৃটেনে পাচারের পন্থা গ্রহণ করেছিল। সেই বৃটিশদের সাথে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠির কোনোরকম এন্টাগনিজম না থাকলেও তারা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গনগোষ্ঠি মুসলমানদের সাথে একটি চিরস্থায়ী বৈরিতার রাজনৈতিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবিত ইতিহাস, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক দর্শনে মুসলমান বিদ্বেষের বীজ এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে দুই জাতি কখনোই একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে না পারে। ১৯৪৭ সালে টু নেশন থিউরির ফর্মূলায় মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরও একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলমান জনগোষ্ঠির দেশ হিসেবে রয়ে যায়। হাজার বছর ধরে যেভাবে মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে নিয়ে বিশাল ভারত সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, একইভাবে আধুনিক, স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের অগ্রযাত্রায়ও মুসলমানদের অবদান হিন্দুদের চেয়ে মোটেও কম নয়। ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে আত্মাহুতি দানকারী ভারতীয়দের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি। ভারতের রাজনৈতিক গঠন, গণতন্ত্রায়ন, শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সংগীত, চলচ্চিত্র শিল্প থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা ও পারমানবিক বোমার অধিকারি হওয়ার মধ্য দিয়ে পরাশক্তি বনে যাওয়ার প্রধান শক্তি মুসলমানরা। দাদাভাই নওরোজি, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, জামশেদজি- জাহাঙ্গির টাটা, রতনজি টাটা, ইউসূফ খান (দিলিপ কুমার) থেকে শুরু করে এ আর রহমান কিংবা ভারতের পরমাণু বোমার জনক এপিজে আব্দুল কালাম পর্যন্ত মুসলমানদের গৌরবজনক ইতিহাসকে এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ঘৃণা, সংঘাত-সহিংসতার দ্বারা কলুসিত করেই বসে থাকতে চায়না, তারা ভারতীয় মুসলমানদের নির্মূল, ছিন্নমূল বাস্তুহীন করে বিতাড়িত করতে চাইছে।
এনআরসি, কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ওয়াকফ আইন পর্যন্ত বিজেপি শাসিত ভারতে একের পর এক নানা প্রকার বৈষম্য ও নির্বতনমূলক আইনের টার্গেট হচ্ছে মুসলমানরা। তারা প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথিত অখ- ভারতের বুলি ও রাজনৈতিক এজেন্ডার কথা বললেও আদতে তাদের হিংসাত্মক আইনের কারণে ভারত ভেতর থেকে আরো বেশি খ-িত, দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। পঁচিশ কোটি মুসলমান জসংখ্যার বিশাল জনগোষ্ঠিকে টার্গেট করে ভারত নামক রাষ্ট্রটি আধুনিক সভ্যতার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কিছুতেই সামনে এগোতে পারবেনা, এটা একজন সাধারণ শিক্ষিত ভারতীয় বুঝলেও বিজেপির দাঙ্গাবাজ উন্মাদরা তা বুঝতে পারছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, মুসলমানদের নিকেশ করে দেয়াই ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের প্রধান এজেন্ডা। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ের কৌশলগত অংশীদার ভারত ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের কৌশলগত অংশীদারে পরিনত হয়। বিশেষত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক আধিপত্য ঠেকাতে পশ্চিমারা ভারতকে বেছে নেয়। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বে জায়নবাদ প্রভাবিত নিউকনজারভেটিভদের বর্ণবাদী রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামোফোবিয়ার রাজনীতি মুসলমান প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসি বিমান হামলার ঘটনার পর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট র্জজ ডাব্লিউ বুশের শুরু করা ক্রুসেড তথা অন্তহীন যুদ্ধের মূল টার্গেট ধরা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম আফ্রিকাসহ এশিয়ার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো। সে সময় নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য অনেকটা ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের সাথে আপস করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমারা। আওয়ামী লীগকে দিয়ে দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভাবনাকে ভারতের চাপিয়ে দেয়া একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। দেশের জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ভারত তোষণ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করাই ছিল সেই সরকারের মূল এজেন্ডা। শেখ মুজিব যেমন গণতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন, ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনার সরকারকেও নিয়মতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে আরেকটি গণঅভ্যুত্থানকেই অনিবার্য বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল দেশের ছাত্র-জনতা। চব্বিশের অভ্যুত্থান নিছক ক্ষমতা দখল বা স্বৈরাচার হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেয়েও বেশি কিছু ছিল। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। ভারতীয় আধিপত্যবাদের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নবযাত্রার সূচনাই ছিল এই অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের অবিরাম বাংলাদেশ বিদ্বেষি প্রচারণা, মিথ্যাচার, হুমকি ও নানাবিধ বিধিব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অর্ন্তবর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দৌড়ের উপর রাখার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়, বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আওতায় বাংলাদেশের মত মুসলমান প্রতিবেশী দেশকে চিরস্থায়ীভাবে ভারতীয় বশংবদ ও আধিপত্যের আওতায় শৃঙ্খলিত করাই ছিল ভারতের পুতুল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক এজেন্ডা। গত ১৫ বছরে ধারাবাহিক কর্মকা-ের মাধ্যমে এ কাজের অনেকটাই পূরণ করে একটি চুড়ান্ত পরিনতির পথে অগ্রসর হচ্ছিল। করিডোর, নৌ, স্থল ও রেল ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে অবাধ যাতায়াত এবং বাংলাদেশের উপর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার প্রান্তিক মুহূর্তে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের দিশাহারা করে তোলে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকারকে চাপে ফেলে ব্যর্থ করে দিতে গত ৮ মাসে মোদি সরকার যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার প্রতিটিই ভারতের জন্য বুমেরাং ও বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে।
ভারতের বিজেপি সরকার কোনো প্রতিবেশী দেশের সাথেই স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে ডোকলাম-লাদাখ সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী মার খেয়ে শত শত বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়েও বিড়ালের মত লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ভারতের সব আধিপত্য, দাপট, ক্ষমতা শুধু মুসলমানদের উপর। ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান সম্প্রদায় এবং মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রতিবেশী দেশগুলোতে সর্বাত্মক আগ্রাসনের নানা রকম কারসাজি চালিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অখ- ভারতের অলীক স্বপ্ন বাস্তবায়নে যে সব তৎপরতা চালাচ্ছে, তাকে বলা যায়, ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’। অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের পেহেল গাঁওয়ের বাইসারণ উপত্যকতার তৃণভূমিতে কথিত জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পর সে ঘটনা এখন কনস্পিরেসি বা ফল্স ফ্লাগ অপারেশন বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর বিবেচনা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সামরিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে পেহেলগাঁও কান্ডের ফল্স ফ্ল্যাগ অভিযোগ অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি এবং সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতকরণসহ যে সব ব্যবস্থার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার কোনোটিই ভারতের অনুকুলে যায়নি। উপরন্তু তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক প্রত্যাঘাতের হুমকি ও প্রস্তুতি, সিমলা চুক্তি বাতিল এবং ভারতের জন্য পাকিস্তানের আকাশ সীমা বন্ধের মত সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের এভিয়েশন, বাণিজ্য ও অর্থনীতির উপর সরাসরি আঘাত করেছে। একইভাবে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসা বন্ধ, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি ইস্যু বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো সমস্যা হয়ে না দাঁড়ালেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন, হাসপাতাল, হোটেল ব্যবসা এবং কৃষকদের জন্য ধস নামিয়ে দিয়েছে। এসব দেখে মনে হয়, নিজেদের সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের কোনো স্পষ্ট ধারণাও নেই। মুসলমান প্রতিবেশীদের হুমকি দিয়ে, বিদ্বেষমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা নিজেরাই বিপদে পড়লেও প্রতিপক্ষ দেশগুলো ভারতের সহায়তা ছাড়াই যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম হচ্ছে। গরু রফতানি বন্ধ করে বাংলাদেশি মুসলমানদের কোরবানি কিংবা সারাবছর গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করা যায়নি। বাংলাদেশের কৃষক ও খামারিরা গোসম্পদে স্বয়ংসম্পুর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভারত পেঁয়াজ-আলু, আদা-রসুন রফতানি বন্ধ করার পর দেশে উৎপাদিত এসব পণ্যের দাম কমে গেছে। ভারতের ভিসা বন্ধ হওয়ার পর চীনে মেডিকেল ভিসার নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। দেশে নতুন নতুন বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে উঠছে এবং ইউরোপীয় দেশগুলো ঢাকায় ভিসা সেন্টার খোলায় স্টুডেন্ট ও পর্যটকদের জন্য ভিসা সহজতর হয়েছে। অযোগ্য- অপরিনামদর্শী নেতৃত্বের হাতে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক অপতৎপরতায় ভারত ভেতর-বাহিরে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও অন্ত:সারশূন্য হয়ে পড়ছে। ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নিবর্তনমূলক আইন করে মুসলমানদের বাড়িঘর, মসজিদ-মাদরাসাসহ ইসলামি সংস্কৃতির সাথে সবকিছু বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেখান থেকে বড় ধরণের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হিন্দুত্ববাদীরা তা ঠেকাতে পারবেনা। ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দুত্ববাদীরা নয়। মুসলমানদের বাস্তুচ্যুত করে, কাশ্মিরকে গাজায় পরিনত করার হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনা ভারতকে ভেঙে খান খান করে দিতে পারে।
কাশ্মিরের পেহেলগামে বিজেপি সরকারের সাজানো নাটক বাস্তবায়িত হওয়ার সাথে সাথেই এর দায় পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে বড় ধরণের সামরিক হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে। কালবিলম্ব না করে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার ম্যারেড পার্টিনার নরেন্দ্র মোদিকে আসন্ন যুদ্ধে ইসরাইলের সমর্থন ব্যক্ত করে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প মোদিকে সমবেদনা জানিয়ে ভারতের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করলেও তিনি পাকিস্তানকেও তার ঘনিষ্ট অংশীদার বলে স্বীকার করেন। এটাই হচ্ছে, পারমানবিক বোমার ক্যারিশমা। ডোনাল্ড ট্রাম্প সব সময় ব্যতিক্রমী বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যমের নজর কাড়তে চেষ্টা করেন। কাশ্মির বিরোধ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, কাশ্মির নিয়ে নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ হাজার-দেড়হাজার বছরের। ঐতিহাসিক সত্য, বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের ন্যায্যতার বাইরে গিয়ে ট্রাম্প প্রায়শ এমন তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটান। প্রতিকী অর্থে হলেও কাশ্মির প্রশ্নে তাঁর এমন মন্তব্যকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যায় না। আমরা স্মরণ করি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর পরাজয়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী বলেছিলেন, ‘হাজার সাল কা বদলা লিয়া’। যেখানে ঔপনিবেশোত্তর ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তানের বয়েস মাত্র ২৩ বছর। বৃটিশ উপনিবেশ ২শ বছরের কম, সেখানে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের ঘটনাকে হাজার বছরের প্রতিশোধ হিসেবে আখ্যায়িত করার পেছনে বাংলায় মুসলমান শাসনের হাজার বছরের ইতিহাসের কথাই হয়তো প্রকারান্তরে ব্যক্ত করেছেন। সিন্ধু উপত্যকা, দিল্লী, আগ্রা কিংবা বাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠি ছিল না। সেই সপ্তম শতকে তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর রাজা দাহিরের বাহিনীকে পরাজিত করে সিন্ধু দখল করেছিলেন। ভারতের সব রাজারা মিলেও দশম শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান একবারের জন্যও রুখে দিতে পারেনি। মাত্র ১৭ জন অগ্রগামি অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বিনাযুদ্ধে বাংলাদেশ দখল করেছিলেন। দুর্বল শাসকরা সব সময় অত্যাচারি হয়। বখতিয়ারের বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে বাংলার শাসক রাজা লক্ষণসেন পেছনের দরোজা দিয়ে নৌপথে পালিয়ে বিক্রমপুরে চলে আসেন। এর ৮২০ বছর পর ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের ক্রিড়নক অত্যাচারি-স্বৈরাচারি শাসক শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে গণভবন থেকে পালিয়ে দিল্লিতে চলে যান। রাজনীতিকরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভুল ও পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে।
গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলমানরাই প্রথম ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে দীর্ঘদিন শাসন করেছেন। ভারতীয়রা অখ- ভারতের প্রতীক হিসেবে যে অশোক চক্রের ঐতিহ্যকে ধারণ করেন, সেই অশোক হিন্দু ছিলেন না। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ। তিনি মৌর্য সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাতি। টেনেটুনে মৌর্য সা¤্রাজ্যের আয়ুষ্কাল ছিল একশ বছরের মত। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের বিভক্তি ও বিদ্রোহের কারণেই মৌর্য সা¤্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়, স¤্রাট অশোক গো-হত্যা (গো-মেধ যজ্ঞ) বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আড়াই হাজার বছর পরেও ভারতীয়রা গো রক্ষার নামে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক উন্মাদনা ছড়াচ্ছে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাস এখনো ৮ দশক অতিক্রম করেনি। একইভাবে তিন হাজার বছরের মধ্যে একবারই অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বয়সও ৮০ বছর পার হয়নি। ইহুদি বাইবেলে নাকি ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে ইহুদি রাষ্ট্রের আয়ু হবে ৮০ বছর। ভারত এবং ইসরাইল হাতে হাত রেখে এখন কোটি কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠিকে নির্মূল করে, সামরিক-পারমানবিক এনাইহিলেশন সৃষ্টি করে অখ- ইসরাইল ও অখ- ভারতের স্বপ্ন দেখছে। নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো ইসরাইল সফরে গেলে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ভারত ও ইসরাইলের নাকি স্বর্গে বিবাহ হয়েছিল। ইহুদি জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের সমর্থন ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারত এখন মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের আদলে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, খৃষ্টান, জৈন নির্বিশেষে বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত টিকে থাকবে, নাকি মুসলিম বিদ্বেষ, হিংসা ও আত্মকলহে ভাঙ্গনের কবলে হারিয়ে যাবে, সেই সিদ্ধান্ত ভারতের সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে। পেহেলগামের নাটক নিশ্চিতভাবেই ভারতের জন্য বুমেরাং হচ্ছে। কাশ্মির কখনোই ভারতের অংশ ছিল না। ভবিষ্যতেও তা ভারতের দখলে থাকবে না। গত ৭৫ বছরে কাশ্মির বা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামিদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল, চীন বা অন্য কোনো পরাশক্তি নয়, কাশ্মিরিদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। বিশ্বকে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

চলতি মাসেই বাজারে আসছে আমের রাজধানীর আম

পাকিস্তানের ‘শূন্য শুল্ক’ প্রস্তাব, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে নতুন কূটনৈতিক বার্তা

২০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, এআই প্রযুক্তিতেও আমিরাতের পাশে যুক্তরাষ্ট্র!

মোরেলগঞ্জে পানি তালের কদর সারাদেশে

দুর্দান্ত ইয়ামালে বার্সার লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধার

ফিলিস্তিনিদের ৬০০ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিল ইসরাইল

গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ২৮

লাইভ চলাকালীন জনপ্রিয় টিকটকারকে গুলি করে হত্যা

পটুয়াখালীতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর উদ্যোগে অবহিতকরণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

ভারতে সন্দেহভাজন ‘১৪৮ বাংলাদেশিকে’ ত্রিপুরায় স্থানান্তর, হতে পারে পুশ ব্যাক

বাড়ল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সময়সীমা

কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সাজ এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না শেরপুর গারো পাহাড়ে!

ভারতের আরও একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি পাকিস্তানের

পাকিস্তানের জন্য স্থগিতই থাকছে সিন্ধু পানি চুক্তি, জানাল ভারত

আটঘরিয়ায় বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ; মোটরসাইকেল ও অফিস ভাঙচুর, আহত ৫

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমাবেশ আজ

গরু নিয়ে যাওয়া সেই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিষ্কার

ট্রাম্প-পুতিন সরাসরি বৈঠক ছাড়া ইউক্রেন সংকটের সমাধান অসম্ভব: রুবিও

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একদিনেই নিহত ১৪৩ ফিলিস্তিনি

স্থূলতা কেবল একটি অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার চেয়ে অনেক বেশি কিছু