তরুণ ও যুব সমাজে অনলাইন জুয়ার আসক্তি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে এই জুয়া অনেকটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রতিরোধ, প্রতিকার নিদেনপক্ষে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অনলাইন জুয়া নীরব ঘাতকের মতো তরুণ সমাজকে গ্রাস করছে। এটি এমন এক জুয়া, যা বাসাবাড়ি, বাস-ট্রেন, ফুটপাত থেকে রিকশা গ্যারেজ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় সবশ্রেণীর মানুষ এতে জড়িয়ে পড়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে একজনের পাশে বসে আরেকজন খেললেও টের পাচ্ছে না। মোবাইলে অ্যাপ নামিয়ে কিংবা চোখের সামনে ভেসে আসা জুয়ার লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষিত থেকে শুরু করে কম লেখাপড়া জানা লোকও এতে আসক্ত হচ্ছে। অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ, ফুটবল লীগ নিয়েও জুয়া চলছে। অনেকে ক্রিকেটের বলে বলে চার-ছক্কা হওয়া নিয়ে ছোট থেকে বড় অংকের জুয়া খেলছে। ফুটবলে গোল হওয়া বা কোন দল জিতবে তা নিয়েও জুয়া খেলা হচ্ছে। অনলাইনে আরও নানা ধরনের নিত্যনতুন জুয়ার অ্যাপ প্রতিনিয়তই খোলা হচ্ছে এবং এতে তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।

শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কীভাবে তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় মত্ত হচ্ছে, তার একটি প্রতিবেদন গতকাল ইনকিলাবের ঝিনাইদহ প্রতিবেদকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অনলাইন জুয়ার অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা জুয়ায় ঢালছে তরুণরা। অনেকে ধারদেনা করে বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করছে। জুয়ার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা নিঃস্ব হচ্ছে। হতাশ হয়ে মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জুয়া ও মাদকাসক্তি সকল অপরাধের উৎস। দুটোই মানুষের মৃত্যুর পথ তৈরি করে। পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই এই দুই নেশার কারণে খুন, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংসারে অশান্তি সৃষ্টিসহ সংসার ভেঙে যাওয়ার খবরও দেখা যায়। অনলাইন জুয়া এমন একটি বিষয়, যা প্রকাশ্যে খেললেও তা টের পাওয়া যায় না। ঘরে মায়ের পাশে শুয়ে-বসে সন্তান মোবাইলের স্ক্রিণে চোখ রেখে অবলীলায় জুয়া খেললেও মা তা বুঝতে পারে না। অনলাইন জুয়া নতুন কিছু নয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না থাকায় এর বিস্তৃতি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। সংঘবদ্ধ চক্র নিত্যনতুন অ্যাপ তৈরি করে লোভনীয় অফার দিয়ে তরুণদের জুয়ায় আকৃষ্ট করছে। হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের অর্থ। এসব জুয়ায় অংশগ্রহণকারিরা খুব কমই জিতে। প্রতারক চক্র চালাকি করে দুয়েকজন, যারা তাদেরই লোক, তাদের জিতিয়ে দেখিয়ে অন্যদের প্রলুব্ধ করে। এতে অন্যরা আকৃষ্ট হয় এবং জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে। একবার হেরে গেলে তার মধ্যে পুনরায় জেতার নেশা পেয়ে বসে। পরেরবার হেরে গেলে নতুন করে তার মধ্যে জেতার জেদ চাপে। জেদ মিটাতে গিয়ে হেরে নিঃস্ব হয়ে যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এতে কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কেউ জুয়ার অর্থ জোগাড়ে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। অনলাইন জুয়াকে প্রমোট করার জন্য শোবিজ এবং ক্রিকেটের বেশ কয়েকজন তারকাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে দেখা যায়। তাদেরকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে অনলাইনে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এসব তারকাদের কথায় তাদের ভক্ত ও সাধারণ মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। তাদের করা বিজ্ঞাপন বিভিন্ন অশ্লীল সাইটেও ব্যাপক হারে প্রচার করা হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয় কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। তাদের হাতে টাকা নেই। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে গেছে। অতিদারিদ্র্যসীমা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার উৎপাদনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে গেলে নেই। শেয়ার বাজার যতটুকু ছিল, তাও এখন নেই। শেয়ার বাজার চাঙা করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। এখানে শত শত তরুণ যুক্ত ছিল। পুঁজি হারিয়ে তারা নিঃস্ব ও হতাশ হয়ে পড়েছে। বিকল্প হিসেবে তাদের অনেকে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। সেখানেও প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে। ব্যাংক খাতও ধুঁকছে। অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ায় মানুষের আস্থা কমে গেছে। নিরাপদ মনে করছে না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা সে পূরণ করতে পারছে না।

কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় অর্থ উপার্জনের জন্য বেকার তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। তারা ধারদেনা করে হলেও এসব জুয়া খেলছে। এমনকি, অনেকে সংসার চালানোর জন্য স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে জুয়া খেলে সর্বসান্ত হয়ে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা অতীতে এ নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা ও পদক্ষেপ নেয়ার কথা শুনেছি। তা কার্যকর হতে দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে জুয়ার এই ভয়াবহ ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। জুয়ার সংঘবদ্ধ চক্রকে শনাক্ত করা তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। ইতোমধ্যে এর সাথে যুক্ত চক্রের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বের হয়ে পুনরায় একই কাজ করছে তারা। পর্যবেক্ষকদের মতে, জুয়া প্রতিরোধ করতে এমন আইন করা দরকার, যা অজামিনযোগ্য। এতে কিছুটা হলেও এর বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। শুধু আইন দিয়ে নয়, অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে এর কুফল সম্পর্কে সর্বত্র জনমত তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দায়িত্বশীলদের জনসচেতনতা তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে। আলেম-ওলামাকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ সম্পর্কে বয়ান দিয়ে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলসহ অনলাইন মাধ্যমে জুয়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। তরুণ শ্রেণীকে জুয়া থেকে নিবৃত্ত করতে ক্রীড়াঙ্গণ থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গণের খ্যাতিমানদের আহ্বান জানাতে হবে। ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে কর্মসংস্থান খাত তৈরি করে তরুণদের জন্য কর্মমুখী পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।