প্রযুক্তি সাক্ষরতার হার বাড়াতে হবে
১২ মে ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৫, ১২:০৮ এএম

বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবন এখন অনেকাংশে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করেছে। বর্তমান বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যে দেশ যত বেশি প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন করেছে কিংবা করছে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তারা তত বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের গতি আমাদের শিল্প, অর্থনীতি ও জীবনধারাকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে। অতীতে শ্রম ও মূলধনের ওপর নির্ভরশীল ছিল অর্থনীতি। আজকের অর্থনীতি জ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রয়োগযোগ্য দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যোগাযোগের ধারা বদলে গেছে। প্রযুক্তির বিকাশে মানুষের জন্য আর্থসামাজিক সুযোগ যেমন সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি এর অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
প্রযুক্তি সাক্ষরতা আসলে কি? প্রযুক্তি সাক্ষরতা হলো: প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলিকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের ক্ষমতা। অর্থাৎ প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিচালনা, বোঝার এবং মূল্যায়ন করার ক্ষমতা। হার্ডওয়্যার (যেমন কম্পিউটার এবং স্মার্টফোন), সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন কীভাবে পরিচালনা করতে তা জানা-বোঝা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধান করা। নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন এবং উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারাই হলো প্রযুক্তি সাক্ষরতা।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুততম সময়ে দেশে প্রযুক্তিখাতে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ সেবাই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় দেশের জনগণকেও ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে এ সেবাগুলো গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সকলকেই কম-বেশি প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হচ্ছে। পত্র যোগাযোগ, টাকা পয়সা লেনদেন এখন আর কোনো সমস্যাই না। অথচ কয়েক বছর আগেও এজন্য আমাদের পোস্ট অফিসে যেতে হতো এবং ডাক পিয়নের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে হতো। সেই দিন আর এখন নাই। মুহূর্তে মেইল, এসএমএস এমনকি মোবাইলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সেরে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদে টাকা পাঠানোতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনলাইন ই-শপের মাধ্যমে ঘরে বসে যে কোনো পছন্দমতো দ্রব্যাদি ক্রয় করা এখন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হয়েছে। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধী শনাক্ত করছে, যাতায়াতের সুবিধার জন্য আমরা হাতের কাছেই পাচ্ছি পাঠাও-উবার। ভূমি সেবায় এসেছে ডিজিটাল ছোঁয়া। ভূমি কর, ই-মিউটেশন, ই-পর্চাসহ নানারকম ডিজিটাল সেবা দিচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এক কথায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বহুবিধ সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এ সব সেবা বিস্তৃত রয়েছে। সরকারি অধিকাংশ সেবাই ডিজিটাল হওয়ায় এ সেবাগুলো এখন নাগরিকদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
ইতিহাসে এই প্রথম, একটি শিল্প বিপ্লব একযোগে ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও জৈবিক ব্যবস্থাগুলোর সমন্বয় ঘটাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডেটা অ্যানালিটিকসের মতো প্রযুক্তি এখন শিল্প ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। যার ফলে নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব পড়ছে। এসব বিষয়ে নাগরিকদের ধারণা না থাকলে প্রতিটি পদক্ষেপেই বিড়ম্বনার সমাধান হতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি এখনো সহজলভ্য নয়। বয়স্ক জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা কম, এগুলো হলো ডিজিটাল বৈষম্য। সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইসগুলোকে সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, নাগরিকদের সচেতন করতে বিনামূল্যে বা কম খরচে প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত এবং কম খরচে বা বিনা খরচে সেবা প্রাপ্তির সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
দৈনন্দিন জীবনে মোবাইলের গুরুত্ব এবং ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবাসীরা ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাদের স্বজনদের খোঁজখবর নিতে পারছেন। মোবাইল ফোনকে এখন আমরা ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। শুরুতে মোবাইল ফোন দিয়ে শুধু ফোন কল ও টেক্সট করা যেতো। স্মার্ট ফোনের আবির্ভাবের পর থেকে এটি দিয়ে কম্পিউটারের মতো সকল কাজ করা যায়। মোবাইল ফোনের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসগুলো মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।
গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে যায় জেলেরা। এই মাছ ধরায়ও এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকারের ফলে মৎস্যজীবীরা একদিকে যেমন অনেক লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে সমুদ্রের সার্বিক পরিবেশ, জলোচ্ছ্বাস, আবহাওয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদি জানার পাশাপাশি স্থলভাগে মৎস্য ঘাটে, মাছের বাজার দর এবং পরিবার পরিজনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ, ফিশ ফাইন্ডার, ইকো সাউন্ডার, অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি মৎস্য শিকারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও আছে ওফিশ অ্যাপ, রিমোট কন্ট্রোল অপারেটেড ফিশ ফিডার, অটোমেটিক পদ্ধতিতে পানির গুণাগুণ নির্ণয়, স্মার্ট সেন্সর, স্মার্ট আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তি। এসবই ব্যবহার করছেন আমাদের জেলেরা। গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার কার্যকলাপকে মনিটরিং করা হয়। সমুদ্রে অতিরিক্ত মাছ ধরা, অবৈধ মাছ ধরা এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে কি না এই প্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায়। গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ মাছের সংগৃহীত তথ্য ভিজুয়ালাইজ করে ৭২ ঘণ্টা পর পর ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। এই ভিজুয়ালাইজেশনে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কেউ এই তথ্য ব্যবহার করতে পারে। সংগৃহীত তথ্য দিয়ে একটি মেরিন ডেটা ব্যাংকে তৈরি করা হয়, যেখানে সাগরের তাপমাত্রা, পানির লবণাক্ততা ও অক্সিজেনের মাত্রা ইত্যাদি তথ্য জমা থাকে। ফিশ ফাইন্ডার এবং ইকো সাউন্ডার প্রযুক্তি শব্দশক্তির মাধ্যমে পানির ভেতরে উচ্চ তরঙ্গ তৈরি করে গ্রাফিক্যাল ডিসপ্লেতে প্রতিফলিত শব্দের পরিমাপ প্রদর্শন করে এবং সমুদ্রে মাছের অবস্থান শনাক্ত করে তার চিত্র স্মার্টফোনে পাঠায়। এত জেলেরা সহজেই মাছের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে। এছাড়াও অনেক জেলে মাছের লোকেশন বুঝতে টলনেট ব্যবহার করেন, যা ট্রলারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাছের ঝাঁক বোঝার জন্য সোলার নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা অনেকদূর থেকেও কাজ করে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির সুবিধাবঞ্চিত জেলেরাও এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত।
প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে বদলাচ্ছে সবকিছু। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন-জীবিকারও উন্নয়ন ঘটছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বিশ্বের কোথায়, কখন, কী ঘটছে তা মুহূর্তের মধ্যে জানা যাচ্ছে। নিত্যনতুন ধ্যানধারণা, উন্নয়নের গতিধারা সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি। উন্নয়নের এ গতিধারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। এক কথায় বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে, ইতিবাচক কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তি শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। (পিআইডি)
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

খুলনায় তারুণ্যের ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনার

রামগড় পর্যটন লেক সৌন্দর্য রক্ষায় সেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে উপজেলা বিএনপি পরিবার

জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভিডিও বার্তায় যা বললেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্যবাহী শিলপাটা!

রাজস্থলীতে উপজেলাতে ৫০টি গ্রাম ইন্টারনেটের বাহিরে!

আটঘরিয়ায় বৃষ্টিপাত জনজীবনে চরম দুর্ভোগ

অপারেশন সিন্দুর নিয়ে ট্রাম্পকে যে সাফাই দিলেন মোদী

ইতালিস্থ সন্দ্বীপ সমিতির আয়োজনে নবীন বরণ ও ঈদ পুনর্মিলন অনুষ্ঠিত

অন্যদিকে বালুমহাল ইজারা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন ভাঙন আতংকে এলাকাবাসী

নীলফামারী জেলা কারাগারের কারারক্ষী যখন মাদক মামলার আসামী !

ময়মনসিংহে গ্রাম আদালত বিষয়ক কর্মশালা

ইসরায়েল বিরোধী পোস্টে পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তা অপসারিত

রাঙ্গুনিয়ায় সড়কগুলিতে মরা বৃক্ষ: ঝুঁকিতে ৪ লক্ষ মানুষ

ঝিনাইদহে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সালথায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত তিন আসামীসহ গ্রেপ্তার ৭

ব্যালিস্টিক মিসাইল কতটা ভয়ানক! কীভাবে কাজ করে?

শেরপুরের নকলায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পেইন

রাজবাড়ীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও ভাঙচুর , আহত ১১

মুকসুদপুরে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার বিতরণ

পাওনা টাকা চাওয়ায় বরগুনার সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে জীবননাশের হুমকির অভিযোগ