তিস্তার পানি আদায়ে কঠোর হতে হবে

Daily Inqilab ড. মো. ফখরুল ইসলাম

২৪ মে ২০২৫, ১২:৩৩ এএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৫, ১২:৩৩ এএম

সম্প্রতি তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ এর ব্যানারে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুরে গণপদযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পদযাত্রা ও সমাবেশ উত্তরাঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি নতুন করে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। লালমনিরহাটসহ পাঁচটি জেলার হাজার হাজার মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে, যার মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও বন্যাকবলিত জনগণ ছিল। তারা তিস্তা নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নের দাবি জানায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, তারা তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে এই ইস্যু নতুন করে আলোচনায় এসেছে, তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। তাই জনগণের এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। এর আগে গত মার্চে তিস্তা নিয়ে এই নদী তরে দুইদিনব্যাপী ব্যাপক জনসমাবেশ থেকে দাবি উঠেছিল জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই। কিন্তু ভারতের এ নিয়ে কানে তুলা দেয়া আছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের কোনো কথা, দাবি শোনে না। এটা আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করার অপরাধ ও অপরের অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য একধরনের চাতুরী।

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ গত চার দশকে ১২০টি মিটিং করেও কোনো সামাধান হয়নি। বরং ভারত বার বার ছলনা করে সময় ক্ষেপণ করেছে। এ অবস্থায় আবারো শুধু মিটিং করে আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দরকষাকষি করা বোকামী নয় কি? তিস্তা পাড়ের মানুষ হতাশ হয়েছে বার বার। তাদের সাথে গোটা দেশের মানুষও হতাশ। তাদের হতাশা একেবারে যৌক্তিক। ১২০টিরও বেশি মিটিং, শত শত আলোচনা তবুও চুক্তি হয়নি। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশকে সময়ক্ষেপণের ফাঁদে ফেলে রাখার একটা কৌশল মাত্র।

তাহলে ভারত কি বাংলাদেশকে কখনও তিস্তা পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে না? সংক্ষেপে ইতিহাস বলে, ২০১১ সালে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৭% এবং ভারতকে প্রায় ৪২% পানি দেওয়ার কথা ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে সেই চুক্তি সই হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা নদীর পানি ছাড়ার বিরোধিতা করেন। কারণ, রাজ্যটিও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভারত আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কোনো চুক্তি হয়নি। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সুদূর পরাহত।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মাঝে বাংলাদেশ তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য চীনের সহায়তা চেয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, ভারতের পক্ষ থেকে চীনের এই সম্পৃক্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যা প্রকল্পটির বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটাচ্ছে।

তিস্তা নদীর পানি সমস্যা সাম্প্রতিক গণপদযাত্রার ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ চলছে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি এবং বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এই ইস্যুকে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রশ্ন হলো, এই ইস্যুতে ভারতের ধীরগতির কারণ কী? কারণ হলো রাজনৈতিক, আঞ্চলিক এবং কৌশলগত। এতে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি রয়েছে। তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, যদি বাংলাদেশকে পানি দেয়া হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিকাজ এবং পানির জোগানে বিপদ হবে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, নদীর পানিবণ্টনের মতো বিষয়গুলো রাজ্যের সম্মতির ওপরও নির্ভর করে। তাই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও পশ্চিমবঙ্গের মতামত উপেক্ষা করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পে বড় ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করছে। ভারত মনে করে, এতে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়তে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য হুমকি হতে পারে। তাই ভারত তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশকে চীনের দিকে পুরোপুরি ঠেলে দিতে চায় না আবার নিজেও এই মুহূর্তে কার্যকর সমাধান দিতে পারছে না।

এমতাবস্থায়, তিস্তাপাড়ের মানুষ শুধু আন্দোলন করে, হতাশা ব্যক্ত করে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রতিবাদ চালালেই কাজ হবে না। বাংলাদেশের শুধু দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বললে হবে না; পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এর সাথে তিস্তা প্রকল্পের বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে।

এখন শুধু প্রতিবাদ নয়, সরকারকেও আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে নিয়মিত সক্রিয় থাকতে হবে। পদযাত্রা, মানববন্ধন ইত্যাদি যেন জাতীয় ঐক্যের ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ভারতের কাছে এটি স্পষ্ট হবে যে, এটি শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও মৌলিক দাবি নয় বরং অন্তর্বর্তী সরকারেরও দাবি। তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের দর কষাকষির কৌশল কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে মতামত জানতে সেমিনার করুন। এজন্য ‘মাল্টিপল চ্যানেল’ কৌশল নিতে হবে।

শুধু কূটনীতিক আলোচনায় না থেকে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়া, গবেষণা সংস্থা, পরিবেশবাদী সংগঠন, জাতিসংঘ ইত্যাদির মাধ্যমে তিস্তা ইস্যু তুলে ধরতে পারে। এটা ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবর্র্যাদায় চাপ তৈরি করতে পারে। তিস্তায় কৌশলগত বিষয়ে পদক্ষেপের জন্য আমাদের তাহলে কী করা উচিত? আমাদের কাজ হবে নিজস্ব পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করে নিজেদের শক্তি বাড়ানো। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা Permanent Court of Arbitration, The Hague)| বিশ্বমিডিয়া ব্যবহার করে ভারতকে চাপ দেওয়া। বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলিকে (চীন, ইউরোপ, তুরস্ক, মালয়েশিয়া) কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা। প্রতিটি কূটনৈতিক বিনিময়ে তিস্তা ইস্যু জোরালোভাবে তোলা এবং সুবিধার বিনিময়ে শর্ত চাপানো। রংপুরে গণপদযাত্রার সময় তরুণদের জিজ্ঞাসা, এসব এতদিন করা হয়নি কেন?

নতুন বাংলাদেশের তরুণরা যে অবিচার দেখছে, তারা সেসবের বিরুদ্ধে একটা গর্জে ওঠা উত্তর চাচ্ছে। কিন্তু শুধু হাতের মুষ্ঠি তুললেই বিজয় আসে না, মুষ্ঠির সাথে মাথা ও মেধারও সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে।

পানির অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার, এটার বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের দাবি। বাংলাদেশের কূটনীতিকদের লক্ষ্য হবে বিশ্ব মিডিয়ায় তিস্তা ইস্যুকে প্রধান আলোচনা হিসেবে দাঁড় করানো। একইভাবে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই ইস্যুতে জড়িয়ে ফেলতে হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মতলব দক্ষিণের এক হিন্দু যুবক প্রিয় নবীকে নিয়ে ফেইসবুকে কটুক্তি করায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ, এলাকায় উত্তেজনা

মতলব দক্ষিণের এক হিন্দু যুবক প্রিয় নবীকে নিয়ে ফেইসবুকে কটুক্তি করায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ, এলাকায় উত্তেজনা

তিন সেঞ্চুরিতে ভারতের ৪৭১,পোপের ব্যাটে জবাব দিচ্ছে ইংল্যান্ড

তিন সেঞ্চুরিতে ভারতের ৪৭১,পোপের ব্যাটে জবাব দিচ্ছে ইংল্যান্ড

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

ফরাসি সংস্থাকে তাড়িয়ে ইউরেনিয়াম খনি জাতীয়করণ করছে নাইজার

ফরাসি সংস্থাকে তাড়িয়ে ইউরেনিয়াম খনি জাতীয়করণ করছে নাইজার

তুর্কি সাংবাদিক উজায় বুলুতের প্রবন্ধ প্রোপাগান্ডামূলক ও ভিত্তিহীন : প্রেস উইং

তুর্কি সাংবাদিক উজায় বুলুতের প্রবন্ধ প্রোপাগান্ডামূলক ও ভিত্তিহীন : প্রেস উইং

ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক এরদোগানের

ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক এরদোগানের

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামী শক্তির ঐক্য অপরিহার্য

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামী শক্তির ঐক্য অপরিহার্য

উৎসবমুখর পরিবেশে অভয়নগরে বিজ্ঞানমেলা

উৎসবমুখর পরিবেশে অভয়নগরে বিজ্ঞানমেলা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে : ঝিনাইদহে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে : ঝিনাইদহে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

হাতিয়ায় তাঁতীদল নেতার বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

হাতিয়ায় তাঁতীদল নেতার বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সভা

মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সভা

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

চৌদ্দ বা আঠারো মার্কা নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না- মাওলানা এটিএম মাসুম

চৌদ্দ বা আঠারো মার্কা নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না- মাওলানা এটিএম মাসুম

"দখলদার দের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন"

"দখলদার দের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন"

এনবিআরে ফের কলম বিরতি

এনবিআরে ফের কলম বিরতি

লক্ষ্মীপুরে ছালেহা হত্যার ক্লু ৬ দিনেও উদঘাটন হয়নি

লক্ষ্মীপুরে ছালেহা হত্যার ক্লু ৬ দিনেও উদঘাটন হয়নি

সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি

সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি

ওএসডি হলেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক

ওএসডি হলেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক

হিলি স্থলবন্দরের পানামাপোর্টের শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালন

হিলি স্থলবন্দরের পানামাপোর্টের শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালন