প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের চিন্তাভাবনা পরিহার করা উচিত

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৪ মে ২০২৫, ১২:৩৩ এএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৫, ১২:৩৩ এএম

গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্বনন্দিত ব্যক্তির দায়িত্ব নেয়া ছাড়া খুব একটা বিকল্প ছিল না। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর দেশ-বিদেশের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও সমর্থন পান। একবাক্যে সকলেই তাঁর দায়িত্ব নেয়াকে অভিনন্দিত করেছে। তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিপুল সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে। পতিত শেখ হাসিনা ও তার প্রভু মোদির একের পর এক নানা ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা- রাজনৈতিক দলসহ ছাত্র-জনতা প্রতিহত করেছে। ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকরকে সুসংহত করতে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছে। এই ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতাতেই অন্তর্বর্তী সরকার দশ মাস ধরে চলছে। এই সময়ের মধ্যে সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিতর্কিত ভূমিকা, ক্ষমতা উপভোগের প্রবণতা, সক্ষমতার অভাবে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সমালোচনার মধ্যে এনজিও থেকে আসা উপদেষ্টারাও রয়েছেন। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের গায়ে ‘এনজিও সরকারের’ তকমা লেগে গেছে। বিশেষ করে রিজওয়ান হাসান, আদিলুর রহমান খান, ফরিদা আক্তার প্রমুখ উপদেষ্টার কর্মকা- বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ সহকারি ও সংস্কার কমিশনে এনজিও থেকে আসা ব্যক্তিদের কর্মকা-ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাদের কর্মকা-ে রাজনৈতিক অঙ্গণে অসন্তোষ ও ক্ষুব্ধতা সৃষ্টি করেছে। গত সপ্তাহ জুড়ে নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে এক অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগের বিষয়ে কথা বলেন, যা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের পর সর্বমহলে নানা আলোচনা, চাঞ্চল্য, এমনকি গুজবেরও সৃষ্টি হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত আলোচনায় তিনি ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয় তুলে ধরেন। এ নিয়ে তাঁর পদত্যাগ সংক্রান্ত বিষয় সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম যখন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘পদত্যাগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ভাবছেন’ তখন। পরবর্তীতে সাংবাদিকরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন সূত্রের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি তুলে ধরেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তাঁর পদত্যাগ সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনার কথা একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তিকে বলা প্রধান উপদেষ্টার ঠিক হয়নি। এটা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। আস্থা-অনাস্থার বিষয়টিকে উসকে দিতে পারে। বরং প্রধান উপদেষ্টার উচিৎ ছিল, দেশের চলমান সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের বৈঠক ডেকে সেই বৈঠকে আলোচনা করা। তাদের সাথে পরামর্শ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা ও করণীয় নির্ধারণ করাই ছিল বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এমনিতেই সরকারের কিছু উপদেষ্টার সক্ষমতা ও অক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নিজের গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যেই আবার নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত ও ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এনজিও চালানো আর রাষ্ট্র চালানো এক কথা নয়। স্মরণযোগ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেননি। শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন। এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তিনি তাঁর ক্যারিশমা দিয়ে মোকাবেলা করতে পারবেন বলেই মানুষ তাঁর উপর আস্থা রেখেছে। কা-ারি হয়ে তিনি যদি এই কঠিন পথের অনেকদূর পাড়ি দিয়ে হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন, তাহলে তা দেশের মানুষের জন্যও হতাশাজনক। অন্যান্য উপদেষ্টাও মনোবল হারাবে এবং পুরো সরকার দুর্বল হয়ে পড়ার শঙ্কায় থাকবে। প্রধান উপদেষ্টার এমন হতাশা ব্যক্ত ও পদত্যাগের চিন্তা-ভাবনায় স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি খুশি নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এতে তারা উজ্জীবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তার আলামত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা গণঅভ্যুত্থানের চেতানার পরিপন্থী। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র সমন্বয়করা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তিনিও বিভিন্ন সময়ে এ কথা বলেছেন। ফলে তাদের প্রতি তাঁর সফট কর্ণার থাকা স্বাভাবিক। তবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সরকার প্রধানকে আবেগ ও অনুরাগের ঊর্ধ্বে থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সকল ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল সরকার প্রধানের কাছে সমদৃষ্টি প্রত্যাশা করে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেই তাঁকে রাষ্ট্র চালাতে হয়। এখানে ডিসক্রিমিনেশনের সুযোগ নেই। পতিত শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দেশকে বিভক্ত করে ফেলেছিলেন। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এটা বিশাল অর্জন। এই অর্জন বিসর্জন দেয়া তার উচিৎ নয়।

গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বৈষম্য, ফ্যাসিজম ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দায়িত্ব, গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ভেঙে পড়া রাষ্ট্র মেরামত করে গণতন্ত্রের টেকসই পথ তৈরি করে দেয়া। এখানে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার প্রধানের মধ্যে কখনো কখনো হতাশা, ক্ষোভ, রাগ বা অভিমানের জন্ম হতে পারে। তবে তা প্রকাশ না করে সামালে উঠাই তাঁর কাজ। এজন্য যা করা দরকার, তা করতে হয়। তাঁর দুর্বলতা যদি প্রকাশিত হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের জন্য দরজা খুলে যায়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়। রাষ্ট্রের যেকোনো ক্রাইসিসের সময় সরকার প্রধানকে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হয়। দেশে যে ক্রাইসিস চলছে, এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার উচিত, সকল রাজনৈতিক দলের সাথে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া। কীভাবে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া যায়, সে প্রেক্ষাপট তৈরি করা। তিনি একাধিকবার বলেছেন, এমন একটি নির্বাচন করতে চান, যা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্যও তাই। তাঁকে এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে হবে। যত বিলম্ব হবে, সমস্যা ও সংকট তত ঘনীভূত হবে। তার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া নিয়ে প্রায় সবমহলকেই ঐকমত্য পোষণ করতে দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারকেও সেদিকে এখন বেশি মনোযোগী হওয়া উচিৎ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্বনন্দিত ব্যক্তির হতাশ হওয়ারও কোনো কারণ নেই। তিনি আশাবাদী মানুষ। তিনি তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী চিন্তার দ্বারা ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন বলে সবাই আশা করে। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারলেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তিন সেঞ্চুরিতে ভারতের ৪৭১,পোপের ব্যাটে জবাব দিচ্ছে ইংল্যান্ড

তিন সেঞ্চুরিতে ভারতের ৪৭১,পোপের ব্যাটে জবাব দিচ্ছে ইংল্যান্ড

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

ফরাসি সংস্থাকে তাড়িয়ে ইউরেনিয়াম খনি জাতীয়করণ করছে নাইজার

ফরাসি সংস্থাকে তাড়িয়ে ইউরেনিয়াম খনি জাতীয়করণ করছে নাইজার

তুর্কি সাংবাদিক উজায় বুলুতের প্রবন্ধ প্রোপাগান্ডামূলক ও ভিত্তিহীন : প্রেস উইং

তুর্কি সাংবাদিক উজায় বুলুতের প্রবন্ধ প্রোপাগান্ডামূলক ও ভিত্তিহীন : প্রেস উইং

ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক এরদোগানের

ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক এরদোগানের

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামী শক্তির ঐক্য অপরিহার্য

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামী শক্তির ঐক্য অপরিহার্য

উৎসবমুখর পরিবেশে অভয়নগরে বিজ্ঞানমেলা

উৎসবমুখর পরিবেশে অভয়নগরে বিজ্ঞানমেলা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে : ঝিনাইদহে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে : ঝিনাইদহে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

হাতিয়ায় তাঁতীদল নেতার বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

হাতিয়ায় তাঁতীদল নেতার বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সভা

মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সভা

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

চৌদ্দ বা আঠারো মার্কা নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না- মাওলানা এটিএম মাসুম

চৌদ্দ বা আঠারো মার্কা নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না- মাওলানা এটিএম মাসুম

"দখলদার দের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন"

"দখলদার দের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন"

এনবিআরে ফের কলম বিরতি

এনবিআরে ফের কলম বিরতি

লক্ষ্মীপুরে ছালেহা হত্যার ক্লু ৬ দিনেও উদঘাটন হয়নি

লক্ষ্মীপুরে ছালেহা হত্যার ক্লু ৬ দিনেও উদঘাটন হয়নি

সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি

সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি

ওএসডি হলেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক

ওএসডি হলেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক

হিলি স্থলবন্দরের পানামাপোর্টের শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালন

হিলি স্থলবন্দরের পানামাপোর্টের শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালন

হিলি স্থলবন্দর আন্দোলন প্রত্যাহার কাজে ফিরেছে শ্রমিকীরা

হিলি স্থলবন্দর আন্দোলন প্রত্যাহার কাজে ফিরেছে শ্রমিকীরা