আধিপত্যবাদের ন্যারেটিভ পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও বড় হুমকি
০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম

বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি নির্বাচন কেন্দ্রিক মতভিন্নতা ও সংস্কারের দাবি-দাওয়াকে ঘিরে বৃহত্তর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভকে পাশ কাটিয়ে পুরনো বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করেছে। পতিত স্বৈরাচার ভালো করেই জানতো, তেমন একটি নির্বাচন হলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠু অবাধ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে এক সময় রাখ-ঢাক না রেখেই শেখ হাসিনা তার অনুগত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে অনেকটা এমনভাবে বলেছিলেন, আপনারা কি চান নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসুক? বিএনপি-জামায়াতসহ নিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৫৪টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটের দিন বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ১০ ভাগের কম। মূলত ভারতের কারসাজি ও প্ররোচনায় অনুষ্ঠিত সে নির্বাচন পশ্চিমা বিশ্ব মেনে নেয়নি। তারা যথাশীঘ্র একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। শেখ হাসিনাও তার ভারতীয় প্রভুদের সাথে বোঝাপড়া ছাড়াই মুখ ফসকে বলেছিলেন, তিনি যথাশীঘ্র সবার সাথে আলোচনা ও সমাঝোতার ভিত্তিতে আরেকটি নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ, দাবি-দাওয়া ক্রমশ জোরালো হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভারতীয় স্বার্থে ও প্রভাবে তেমন একটি নির্বাচন বা রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কোনো রকম রাজনৈতিক উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। তারা জাতিকে বিভক্ত করে প্রতিপক্ষকে নিস্ক্রিয় ও নির্মূল করতে প্রপাগান্ডা ভিত্তিক একটি ভূরাজনৈতিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গুম-খুন, গণহত্যা, বিচারিক হত্যাকা- ও লাখ লাখ বিরোধী নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিস্ক্রিয় ও সর্বস্বান্ত করতে সম্ভাব্য সব উপায় অপলম্বন করেছে। মূলত তিনজোটের সমঝোতা ও রূপরেখার আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় অর্ন্তবর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় প্রত্যার্বতনের ঘটনা থেকেই ভারতীয় বশংবদ রাজনীতিকদের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন খুব সহজ নয়। এ জন্য তারা রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছিল। জামায়াতকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করা এবং জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তোলা, ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ আর কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকলেও অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে একবারের জন্য ভোট প্রার্থনা করা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ধজাধারি আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার হিজাব ও তসবিহ- মোনাজাতের ছবি দিয়ে পোস্টার সেঁটে জাতির সামনে নতুন মেসেজ দিয়ে ভোটারদের সমীহ আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। মানুষ আবারো আওয়ামী রাজনীতির স্বরূপ দেখতে পায়। সারাদেশে আওয়ামী গডফাদারদের মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ৫ বছর শেষে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জনরোষ থেকে বাঁচতে অনেক আওয়ামী মাফিয়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জনগণ আবারো বুঝতে পেরেছিল, আওয়ামী লীগের হাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং গণতন্ত্র নিরাপদ নয়।
অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনমত ও গোয়েন্দা রিপোর্টে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেররিজমের রাজনীতির নতুন মেরুকরণে ভারত পশ্চিমা বিশ্বের নতুন কৌশলগত মিত্রে পরিনত হয়েছিল আরো কয়েক বছর আগেই। সমঝোতা অনুসারে পশ্চিমারা দক্ষিণ এশিয়াকে ইন্ডিয়ার চোখে দেখতে বাধ্য হয়। ইন্ডিয়ার প্ল্যান হচ্ছে, বাংলাদেশে তাদের বশংবদ শেখ পরিবার এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে এখানে মধ্যপ্রাচ্যের মডেলে একটি ডায়নেস্টিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে একটি ভ্যাসাল স্টেটে পরিনত করা। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নিশ্চিত না হওয়ায় পরিকল্পিতভাবে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা জরুরি ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় লগি-বৈঠার তা-ব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টিসহ অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর মধ্য দিয়ে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় প্ল্যান ও প্রেসক্রিপশনে নবম জাতীয় নির্বাচন ছিল মূলত একটি অতি নিয়ন্ত্রিত ও মিডিয়া ট্রায়ালের নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০ আসন লাভ করে। নবম নির্বাচনের আগে বিশেষ ট্রাইবুনালের বিচার, গণমাধ্যমের উপর বিশেষ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ, বিএনপির সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি দুর্নীতির চার্জ গঠনের সাথে সাথে অনেককে গ্রেফতার, ব্যাংক হিসাব জব্দ করা, গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো, চরিত্র হরণ এবং আওয়ামী লীগের সুবিধা অনুসারে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুর্নবিন্যাসের মাধ্যমে ভোটের হিসাব নিকাশ পাল্টে দেয়ার কারসাজির মধ্য দিয়ে এক অভাবনীয় নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিত করা হয়েছিল। সেনা সমর্থিত বিশেষ সরকারের সময় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে দাবি করা হলেও সেই নির্বাচনের নেপথ্যের কারসাজি নিয়ে বিরোধীদল বিএনপি যথাযথ মূল্যায়ণ তুলে ধরতে পারেনি। ভারতীয় এবং মার্কিন কূটনীতিকদের লেখা ও তারবার্তায় বাংলাদেশে হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সাজানো নির্বাচনের নেপথ্যের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। তবে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতীয় এজেন্ডার মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারণের আাকাক্সক্ষা অনুসারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ এবং অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের তাগিদ ও ইনিশিয়েটিভসমূহ ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিওনের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডার স্বার্থে নিরব-নিস্ক্রিয় হয়ে গেলেও এর প্রতিক্রিয়ায় একটি গণবিস্ফোরণ তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান অনিবার্যরূপে দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসররা ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার অভিযোগ তুলেছিল। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট অবশ্য সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর ভারত সমর্থিত ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিরোধীমত নির্মূলের বৃহত্তর রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল জাতিকে স্পষ্টভাবে বিভক্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের রাজনৈতিক বয়ানকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আওয়ামী বয়ানের মাধ্যমে নির্মূল করা। আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরিক বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতাদর্শকে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ‘বিএনপি-জামায়াত’ শব্দবন্ধ দ্বারা নির্দেশ করার ন্যারেটিভকে একটি মনস্তাত্ত্বিক এজেন্ডায় পরিনত করেছিল। এটি একটি ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী প্রজেক্ট। নতুন মিলিনিয়ামের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার সাথে ইসলামিক টেররিজমের রেডিমেড তকমা হাজির করে মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী সামরিক আগ্রাসন ও ডিস্ট্যাবিলাইজেশন এজেন্ডার সাথে যেসব আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক অংশীদারদের যুক্ত করা হয়েছিল, ভারত ছিল তারই অংশ। ইসলামোফোবিক এজেন্ডাকে কাজে লাগিয়ে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের চর্চা থেকে বিচ্যুত ও বঞ্চিত করে ভারতীয় হেজিমনি চাপাতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধকে বয়ান সৃষ্টির মাধ্যমে যুৎসইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। জামায়াতের রাজনীতি দমনে দাড়ি-টুপিওয়ালা ধর্মপ্রাণ মানুষদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেটে পরিনত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবেই এদেশের তৌহিদী জনতা কখনো দিল্লীর আধিপত্য মেনে নেয়নি, নেবেনা। এ কারণেই ভারতীয় বশংবদ শাসনকে নিষ্কণ্টক রাখতে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রসিকিউট করার এজেন্ডা কায়েম করা হয়েছিল। জঙ্গিবাদি তকমা দিয়ে যে কাউকে, যখন তখন গুম করে ফেলা কিংবা জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের নাটক সাজিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখার এক মনস্তাত্তিক কৌশল। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ন্যুনতম রাজনৈতিক অধিকারকেও অগ্রাহ্য করে তাদের উপর নিপীড়নের স্টিম রোলার চালানো এবং রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যে কোনো সাংগঠনিক ও সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়াকে প্রাণঘাতি অস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিহত করার বাস্তবতা ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলী বাহিনীর আগ্রাসনকে হার মানিয়েছে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনতার উপর গুলি চালিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে হত্যা করা, শাপলাচত্বর ও আশপাশে রাস্তার বাতি নিভিয়ে, গণমাধ্যমকর্মীদের তাড়িয়ে দিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের উপর নির্বিচার গণহত্যা কিংবা নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ করায় গুলি চালিয়ে কয়েক ডজন মানুষকে হত্যার ঘটনা থেকে মনে হবে, এসব মানুষের জীবনের মূল্য রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের চেয়েও কম। শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠার তান্ডব চালিয়ে পৈশাচিক কায়দায় মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে পিলখানা ম্যাসাকার এবং এরপরের একেকটি ম্যাসাকার, রাজনৈতিক ক্র্যাক-ডাউন ও টার্গেটেড কিলিংয়ের যে কোনোটির কারণে একটি সরকারের পতন ও তার রাজনৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ ও নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মিথ্যা বয়ানের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার চিরতরে রুদ্ধ করে বাস্তুচ্যুত করার পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের পরনো কৌশল চুড়ান্ত বিচারে সর্বৈব ব্যর্থ হয়েছে। তালেবানদের বিরুদ্ধে দুই দশক যুদ্ধ করে হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ করে কোনো সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে ব্যর্থ হওয়ার পর তালেবানদের সাথে চুক্তি করে মার্কিন সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হয়েছে। আইএস’র জুজু দেখিয়ে দেড় দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বশংবদ শাসকদের তটস্থ রেখেছিল মার্কিন প্রশাসন। আইএস বিরোধী যুদ্ধের নাটকও করেছে দীর্ঘদিন। সম্প্রতি আইএসএর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা আল নুসরা ফ্রন্টের পরিবর্তিত নাম হায়াত তাহরির আল শাম সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের বাহিনীকে হটিয়ে দামেস্কের দখল নেয়ার পর এর প্রধান জোলানি ওরফে আল শারা সিরিয়ায় প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেন। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আল শারার সাথে বৈঠক করেছেন। ফরাসি ও জার্মান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আল শারার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম জঙ্গিবাদী গোষ্ঠিগুলোকে নিয়ে পশ্চিমাদের টেরোরিজমের তকমা বা ন্যারেটিভের অসারতা প্রমান করে। সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পেহেলগাঁয়ে তথাকথিত জঙ্গি হামলায় ২৬জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর মোদি সরকার যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছিল, তাদের জন্য তা বুমেরাং হয়েছে। অপারেশন সিন্দুর নামে দিয়ে পাকিস্তান সীমান্তের কয়েকটি স্থানে মিসাইল হামলা করতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে মার্কিন মধ্যস্থতার দ্বারস্থ হয়ে রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। এখানেও ভারতে পাকিস্তানের ইসলামি জঙ্গিবাদের গৎবাঁধা ন্যারেটিভ চরমভাবে মাঠে মারা গেছে। ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার এসব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। একটির সাথে আরেকটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সাত দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও তাদের আঞ্চলিক দোসররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি বয়ানের যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। এটির শুরু জায়নবাদিদের এন্টিসেমিটিজমের বয়ান থেকে। ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চলে আসা ফিলিস্তিনি ও আরব মুসলমানদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ ট্যাগ লাগিয়ে তাদেরকে দমন করে বাস্তুচ্যুত করার ধারাবাহিক কার্যক্রমকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড থেকে চলমান গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসস্তুপে পরিনত করার বাস্তবতা জায়নবাদিদের সব ন্যারেটিভ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গ্লোবাল জিউরি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত এক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘উই আর লুজিং দ্য ন্যারেটিভ ওয়ার : হোয়াই অ্যান্ড হোয়াট নিড টু ডু’ । জায়নবাদী ইহুদি লেখক ফিলিস্তিনের বিপক্ষে জায়নবাদী ন্যারেটিভের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেই এ থেকে উত্তরণের পথে করণীয় বাৎলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
গত ৫৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ কায়েমের মূল অস্ত্র ছিল একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের একপাক্ষিক রাজনৈতিক ন্যারেটিভ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা। জাতির হাজার বছরের ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের খন্ডিত চিত্র অবলম্বনে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের চাপিয়ে দেয়া কালচারাল হেজিমনিক ব্লু প্রিন্ট অনুসারে এদেশে ইতিহাস, উপন্যাস, গল্প, কাব্য ও নাট্যকলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সীমারেখাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে। চব্বিশে ছাত্র-জনতার আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপেই ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের প্রধান ন্যারেটিভ ‘রাজাকার’ শব্দটিকে আয়রণি হিসেবে ব্যবহার করে এর কার্যকারিতা ভোঁতা করে দিতে সক্ষম হয়েছে। অধিকার আদায়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারিদের ‘রাজাকার’ বলে অপবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী একযোগে গর্জে ওঠে শ্লোগান তুলেছিল, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’। এই একটি শ্লোগান যেন ৫৪ বছরের ভারতীয় আধিপত্যবাদের তখতে-তাউস ধসিয়ে দিয়েছে। তবে আধিপত্যবাদের ভিত্তি হঠাৎ করেই গজিয়ে ওঠেনি, একদিনেই তা পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়া প্রায় অসম্ভব। জুলাই বিপ্লবের ১০ মাস পেরিয়ে এসে আমরা দেখছি, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও ক্ষমতা ও ভোটের হিসাব-নিকাশের ছকে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ আওয়ামী লীগের বয়ান শক্তভাবেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তারা এখন ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক শক্তির মোকাবেলায় ‘রাজাকার’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ একাত্তরের পরাজিত শক্তি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করার পুরনো ন্যারেটিভের বহুচর্বিত চর্চার দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। সম্প্রতি আল জাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত এক ওপিনিয়ন পোস্টে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এক সাংবাদিক-গবেষক সানা বাতুল লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রের চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক অস্ত্র হচ্ছে বয়ানের যুদ্ধ। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুৎসই বয়ান এবং প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন চালুর মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত করে শত্রুতে পরিনত করে যুদ্ধের রসদ যোগানোর ঘৃণ্য অপতৎপরতার প্রধান চারণভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে যতটা না বিধ্বংসী অস্ত্রের লড়াই, তারচেয়ে অনেক বেশি নিজেদের বয়ান প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। চরমভাবে মার খাওয়ার পরও ভারতীয় মিডিয়া একযোগে পাকিস্তানের দাঁত ভেঙ্গে দেয়ার অর্ক্রেেস্টড ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার এক ইউটোপিয়ান রিয়েলিটি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে তাদের প্রত্যাশিত বাস্তবতার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্ব ও অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ করে দেয়ার নানাবিধ কারসাজি ও সেট করা বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি নড়াইলের এক হিন্দু নারী ভারত ভ্রমণে গেলে সেখানকার গণমাধ্যম তাকে দিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের মিথ্যা বয়ান দিতে বাধ্য করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের জেন-জি প্রজন্ম যেভাবে জায়নবাদিদের ন্যারেটিভ প্রত্যাখ্যান করেছে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদিদের ন্যারেটিভ প্রত্যাখ্যান করেছে, একইভাবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মও শুধু আধিপত্যবাদী বয়ান প্রত্যাখ্যানই করেনি, তারা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ভারতীয় বশংবদ স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষের কাঁধে সওয়ার হয়ে জাতিকে বিভক্ত ও দুর্বল করে ভারতীয় হেজিমনি কায়েমের পুরনো বন্দোবস্ত তারা যেকোনো মূল্যে রুখে দেবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইরানে মার্কিন বর্বরোচিত হামলা বিশ্বমানবতাকে ভাবিয়ে তুলছে

কমিটি গঠনের ২দিন পরই স্থগিত হলো শেরপুরের নালিতাবাড়ী এনসিপির কমিটি !

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে বিএনপির নতুন প্রস্তাব

রাতের ভোটের নুরুল হুদাকে ধরে পুলিশে দিলো বিক্ষুব্ধ জনতা

ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতা

সাহেবাবাদ ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি হলেন ব্যারিস্টার আব্দুল আল মামুন

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ফয়সল বিপ্লব গ্রেপ্তার

শেরপুরে জনপ্রিয় ষাড়ের মই দৌড় প্রতিযোগীতায় আনন্দে মেতে উঠে হাজারো মানুষ

শাহরাস্তিতে ডাকাতিয়া নদীতে পড়ে শিশু নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর মৃত উদ্ধার করলো ডুবুরিরা

জকিগঞ্জে ‘মৃত ব্যক্তি’ জীবিত ফিরে এলেন: দাফনের আগ মুহূর্তে চাঞ্চল্যকর ঘটনা

কুড়িগ্রামে ট্রাক চাপায় প্রাণ গেলো যুবকের

ডা. জোবাইদা রহমানের জন্মদিনে রূপগঞ্জে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি উদ্বোধন

আজ ‘মার্চ টু সচিবালয়’ ঘোষণা চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের

অবশ্যই ইসি পুনঃগঠন হবে : এনসিপি

চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানি ২৯ জুন

উন্নতমানের গবেষণার পরিবেশ পেলে মেধাবীরা আবার দেশে ফিরবে : সালাহ উদ্দিন আহমেদ

সচিবালয়ের ভেতর সব সংগঠন বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে রিট

দুদকের মামলায় স্ত্রীসহ খালাস পেলেন বিএনপি নেতা দুলু

নিজের সুরক্ষা চেয়ে মা-বাবার বিরুদ্ধে মেয়ের মামলা

দক্ষিণ সিটিতে সকল নাগরিক সেবা প্রদানের আহ্বান, গাফিলতিতে ব্যবস্থা