পাচারের টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে
১১ জুন ২০২৫, ১২:২২ এএম | আপডেট: ১১ জুন ২০২৫, ১২:২২ এএম

পতিত শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে তার পরিবার ও দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী এবং তার দোসর সরকারি আমলারা, ব্যবসায়ীরা, শিল্পগোষ্ঠী ব্যাংক লুটপাট, অর্থপাচারসহ ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। এতে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে। এসব লুটপাট, অর্থপাচার ও দুর্নীতির খবর সেসময় কমবেশি প্রকাশিত হলেও ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর তার পুরো চিত্র জনগণের সামনে উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তার পুরো বিবরণসহ একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিও উঠেছে। যদিও তা এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর যারা দুর্নীতির মূল হোতা, তাদের অনেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক থেকে শুরু করে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান এ এফ এম শাহিনুর ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার শাসনামলে লুটপাট ও অর্থপাচারের কত টাকা ও সম্পদ সরকার জব্দ করেছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের এক প্রতিবেদনে মারফত জানা যায়, প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, লুটপাট ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় শেখ পরিবারসহ ১০টি শিল্প গোষ্ঠীর প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার অর্থ ও সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং ১০টি শিল্প গোষ্ঠীর ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার অর্থ জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া, ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এবং ৪২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পতি ফ্রিজ করা হয়েছে বলে জানা যায়। সরকার কর্তৃক গঠিত ১১টি তদন্ত দলের অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এসব অর্থ দিয়ে ‘লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করা হবে, যা সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকবে। লুটের অর্থ দিয়ে লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং যে অর্থ নন ব্যাংক রিলেটেড দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, সে অর্থ দিয়ে আরেকটি ফান্ড গঠন করে জনগণের কল্যাণের কাজে ব্যয় করা হবে।
দুর্নীতির অর্থ ও সম্পদ জব্দ করার সংবাদ সত্যিকার অর্থে আনন্দের বিষয়। তবে এসব অর্থ কবে কখন, কিভাবে ব্যবহার করা হবে এবং জনগণের কাছে যাবে, তার কোনো টাইমফ্রেমের মধ্যে রাখা হয়নি। শুধু একটি পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে মাত্র। তবে এ বিষয়ে এখানো যথেষ্ট শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার সময়ে রিজার্ভ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ উন্নয়নের নানা মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে জনগণের মন ভুলানোর অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। জনপ্রতি আয়ের যেসব ফিরিস্তি দেখানো হয়েছে তা রীতিমতো ছিল গলাবাজি। এসব গলাবাজি আর ধাপ্পাবাজি জনগণ বুঝতে পারলেও করার কিছু ছিল না। দেশের মানুষ অতি কষ্টে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও সরকরের আইওয়াশ পরিসংখ্যান দিয়ে তা কভারেজ দেয়া হতো। বলা হতো, বাংলাদেশের মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে সবচেয়ে সুখী ও আরামদায়ক অবস্থায় আছে। এক অর্থে তারা ঠিকই বলেছেন, কারণ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবারের সদস্যরা, মন্ত্রী-এমপিরা, অনুগত আমলারা, দলীয় নেতাকর্মীরা এবং আত্মীয়-স্বজনেরা সবচেয়ে আরামদায়ক অবস্থায় ছিল-এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাসের মধ্যেও সেই আলামত দেখা যাক, তা জনগণ চায় না। হাসিনার মতো পরিসংখ্যানগত উন্নয়নের গলাবাজি করার প্রবণতা যেন লক্ষ্যণীয় হয়ে না উঠে। রিজার্ভ বৃদ্ধি, বড় অংকের অর্থ ব্যয়ে বিনিয়োগ সম্মেলন করে ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হওয়ার মতো বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা, সংবাদ সম্মেলন করে এ সরকারের সময়ে মানুষ ভালো আছে ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে এবং শেখ হাসিনার আমলে যেমন মিথ্যা দিয়ে মানুষের মন জয় করার অপচেষ্টা করা হয়েছে, এখনো যাতে একই অবস্থা না হয় সে ব্যাপারে জনগণের আশঙ্কা রয়েছে। বাস্তব চিত্র হচ্ছে সরকারের হাতে কোনো টাকা নেই, মানুষের হাতেও টাকা নেই, চাকরি নেই, ব্যবসা নেই। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবং নতুন টাকা ছাপিয়ে চলতে হচ্ছে। এদিকে গত ২০ মে প্রকাশিত দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১১ মাসে সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বর্তমান সরকার অর্থনৈতিকভাবে কতটা নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। অর্থনীতির সব সূচক নি¤œগামী। দারিদ্র্যসীমা ক্রমেই দ্রুততার সাথে নিচের দিকে ধাবিত, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা বিরাজ করছে, শত শত শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, বেকারত্বের হার হু-হু করে বাড়ছে, মানুষের আয় কমে গেছে, আওয়ামী আমলে চাকরি হারানো মানুষগুলোর এখনো কোনো চাকরির ব্যবস্থা না হওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে অথচ কারো কাছে হাত পাততে পারছে না। সরকার চাকরি হারানো মানুষগুলোকে পুনর্বাসন অথবা কোনো সহযোগিতাও করছে না। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাকে ই-মেইল যোগে অসহায়ত্ত্বের কথা কেউ কেউ জানালেও বিগত ৯ মাসের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। বড় বড় রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো শীর্ষ নেতাকে মানবেতর জীবনযাপনের কথা জানালেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি বলে জানা গেছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকেরাও অন্যায়ভাবে হাসিনার আমলে চাকরি বঞ্চিত হয়ে ঘরে বসে আছে। তাহলে জনগণ কি বলবে না, এ সরকার অথর্ব ও ব্যর্থ সরকার? যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ও বিরোধী দলে যেতে চায়, তারাও কি ব্যর্থ নয়? আমি বলব, অবশ্যই ব্যর্থ। কারণ গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ও আহত পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ সরকারের পক্ষে কোনো চোখে পড়ার মতো সহযোগিতা নেই। সকল প্রকার নিয়োগ সার্কুলার বন্ধ রয়েছে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের রোষানলে পড়ে চাকরি হারানো স্কুল কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের অবস্থা খুবই করুন। ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ধনী হওয়া সত্ত্বেও সময় মতো শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন দিচ্ছেন না। এক মাসের বেতন পরবর্তী মাসের ১-৫ তারিখের মধ্যে না দিয়ে ২৮-৩০ তারিখের মধ্যে দেয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। তাও আবার সামান্য বেতন। অনেক গার্মেন্টসের মালিক তাদের শ্রমিকদের সাথে দুরাচার করছেন- যা উচিত নয়। আবার ছাঁটাই করছেন।
এসব নিয়ে সরকারের তেমন কোনো তৎপরতা ও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সরকারও তা স্বীকার করছে না। উল্টো শেখ হাসিনা সরকারের মতো মিথ্যা পরিসংখ্যানের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আশ্বাস আর পরিসংখ্যান দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো মন মাতানো গালগল্প দিয়ে মানুষের সত্যিকার কষ্টের জীবন ঢেকে রাখতে চাচ্ছে কিনা সরকারই ভালো জানে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা কিভাবে খোলা যায়, শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানো যায়, মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়, আয় বৃদ্ধি করা যায়, এ ব্যাপারে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে, সরকারের মনোযোগ আছে বলে জনগণের নিকট দৃশ্যমান নয়। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে পড়া-দুর্বল হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা করবে। জনগণের অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন সহনীয় পর্যায়ে ফিরে আসবে। কিন্তু ৯ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তাদের সে প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতে হবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং জনগণের কষ্ট ও প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে গেছে।
এ অবস্থায় সরকারের উচিত পরিসংখ্যানগত তথ্য দেয়া থেকে বেরিয়ে এসে অর্থনীতির বাস্তবভিত্তিক উন্নয়ন কিভাবে করা যায়, সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাজারে অর্থ সার্কুলেশন সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের আয় বৃদ্ধি, জীবনমানের উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করা। শেখ হাসিনার পরিবারসহ ১০টি শিল্প গোষ্ঠীর যেসব অর্থ ও সম্পদ জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত মানুষের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চাকরি হারানো, ব্যবসা হারানো, নির্যাতিত, জুলুমের স্বীকার শিক্ষক-কর্মচারি, ইসলাম প্রচারের দায়িত্বে লিপ্ত আলেম ব্যক্তিবর্গ ও ঈমাম-মুয়াজ্জিনদের কল্যাণে লোপাট ও পাচারের জব্দ করা অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে অন্তত কিছুটা হলেও কাজে আসবে। সুতরাং অতি সত্তর এসব টাকা জনগণের কল্যাণে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইরানে মার্কিন বর্বরোচিত হামলা বিশ্বমানবতাকে ভাবিয়ে তুলছে

কমিটি গঠনের ২দিন পরই স্থগিত হলো শেরপুরের নালিতাবাড়ী এনসিপির কমিটি !

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে বিএনপির নতুন প্রস্তাব

রাতের ভোটের নুরুল হুদাকে ধরে পুলিশে দিলো বিক্ষুব্ধ জনতা

ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতা

সাহেবাবাদ ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি হলেন ব্যারিস্টার আব্দুল আল মামুন

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ফয়সল বিপ্লব গ্রেপ্তার

শেরপুরে জনপ্রিয় ষাড়ের মই দৌড় প্রতিযোগীতায় আনন্দে মেতে উঠে হাজারো মানুষ

শাহরাস্তিতে ডাকাতিয়া নদীতে পড়ে শিশু নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর মৃত উদ্ধার করলো ডুবুরিরা

জকিগঞ্জে ‘মৃত ব্যক্তি’ জীবিত ফিরে এলেন: দাফনের আগ মুহূর্তে চাঞ্চল্যকর ঘটনা

কুড়িগ্রামে ট্রাক চাপায় প্রাণ গেলো যুবকের

ডা. জোবাইদা রহমানের জন্মদিনে রূপগঞ্জে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি উদ্বোধন

আজ ‘মার্চ টু সচিবালয়’ ঘোষণা চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের

অবশ্যই ইসি পুনঃগঠন হবে : এনসিপি

চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানি ২৯ জুন

উন্নতমানের গবেষণার পরিবেশ পেলে মেধাবীরা আবার দেশে ফিরবে : সালাহ উদ্দিন আহমেদ

সচিবালয়ের ভেতর সব সংগঠন বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে রিট

দুদকের মামলায় স্ত্রীসহ খালাস পেলেন বিএনপি নেতা দুলু

নিজের সুরক্ষা চেয়ে মা-বাবার বিরুদ্ধে মেয়ের মামলা

দক্ষিণ সিটিতে সকল নাগরিক সেবা প্রদানের আহ্বান, গাফিলতিতে ব্যবস্থা