চামড়া শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে
১৭ জুন ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০৩ এএম

চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। বাংলাদেশ এ খাতে নিজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ, বৈশ্বিক চামড়া শিল্পে আমাদের অবদান এক শতাংশেরও কম। এমন বাস্তবতায়, এলডিসি পরবর্তী সময়ে এ খাতের রফতানিতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদের দক্ষতার উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন, ভ্যালুচেইন শক্তিশালীকরণ, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সহযোগিতার ওপর জোর দিতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, চামড়া খাতে সিইটিপি’র (পরিবেশবান্ধব কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার) বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাভারে স্থাপিত সিইটিপি’র ক্যাপাসিটি বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার এবং পিক সিজনে (কোরবানির সময়) এ খাতে চাহিদা থাকে ৩২-৩৫ হাজার কিউবিক মিটার; সিইটিপি’র সক্ষমতা কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার কিউবিক মিটারে উন্নীতকরণ করা উচিত।
একসূত্রে জানা গেছে প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে সিইটিপি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, আরো ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এ খাতে পরিবেশ দূষণ রোধে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে উদ্যোক্তাদের সচেতন থাকতে হয়। সেইসঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়েও সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে। চামড়া খাতে নতুন বাজার তৈরি, উদ্ভাবন ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। লেদার গুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং এমসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ হতে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সিইটিপি পুরোপুরি চালু করা যায়নি; ফলে এ খাতের কাক্সিক্ষত রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এলডব্লিউজি’র মতো আমাদের আন্তর্জাতিক কোনো সনদ না থাকায় বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারছে না এবং এ খাতের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এছাড়াও চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সের অনুপস্থিতির বিষয়টিও অন্যতম কারণ। চামড়া খাতের রুগ্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান এবং যারা এ খাত থেকে বের হতে আগ্রহী, তাদেরকে প্রস্থানের সহজ সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পোশাক খাতের প্রতি নজর বেশি থাকায় তা অনেকদূর এগিয়েছে। চামড়াশিল্পে রফতানির সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে হলে আমদানিযোগ্য কাঁচামাল, শুল্ক ব্যবস্থাপনা, পণ্য ছাড় করা ও ব্যবসা সহজীকরণ নিশ্চিত করা উচিত। দেশে শিল্প বিকাশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বড় আকারে ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে চামড়া শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য। দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক গুণমানের অভাবে এ শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে যা যা দরকার সব করা হবে। সরকার এবার কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়ার জন্য ত্রিশ হাজার মেট্রিক টন লবণ দিয়েছে। কিন্তু কিছু জায়গায় চামড়াতে লবণ লাগাতে গ্যাপ হওয়ায় চামড়া নষ্ট হয়েছে, আর বাকি চামড়াগুলো ঢাকায় আসছে।
কোরবানির পর দেশের অধিকাংশ চামড়া ধর্মপ্রাণ মানুষ মাদ্রাসার এতিমখানা দান করে দেন। কিছু কিছু ছোট মাদরাসায় সময় মতো লবণ লাগাতে পারে নাই, তবে বড় মাদরাসাগুলোতে লবণ ঠিক মতো লাগাতে পারছে। চামড়াকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে না পারার কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। আবার আমাদের ট্যানারির কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) আধুনিকীকরণ এখনো করা হয়নি। চামড়ার ওপর ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। গত কয়েক বছরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণেও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক।
চামড়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাত দেখার কি কেউ নেই! প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশি চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ও দামও বেশি। কারণ বাংলাদেশি চামড়ার মান ভালো। সুযোগ নিয়ে কিছু পাচারকারী ভারতে প্রতি বছর চামড়া পাচার করে। দেশীয় বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলে চামড়া পাচার রোধ করা সম্ভব। এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে যেসব মানদ- রয়েছে তা পূরণে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশের পশুর চামড়ার মান ভালো, সরবরাহ বেশি হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়ার বাজার আছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট, পার্টস, ওয়ার্কিং হ্যান্ড গ্লাবস প্রভৃতি। বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, করোনা বা তার কাছাকাছি সময়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক রফতানি আয় ৩৪.৩৮ শতাংশ বেড়েছিল। এতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ খাতে রফতানি বেশ কয়েক বছর পর শতকোটির ঘরে পৌঁছেছে।
বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন বহুমুখী উৎস থেকে চামড়া সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য চামড়াশিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে, সাভারের শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারকে আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পনগরী হিসেবে এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ শিল্পের রফতানি বাড়াতে হলে পরিবেশসম্মত ট্যানারি স্থাপনের বিকল্প নেই। রফতানিকে আরো গতিশীল করার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাওয়ার জন্য এবং পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার ও তার বর্জ্য ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। এর বাইরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় দেশে আসে এমন শিল্পের মধ্যে চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ মাসে (জুলাই-মে) চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্য হলো এটি আগের অর্থ বছর ২০২২-২৩ এর চেয়ে ১৪.১৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই-মে সময়ে এখান থেকে রপ্তানি হয়েছে ১১২ কোটি ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১.৭৪ শতাংশ কম অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে এখাত থেকে তুলনামূলকভাবে রপ্তানি কমে যাচ্ছে, যা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অবহেলার বা অবজ্ঞারই প্রতিচ্ছবি। এ শিল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা হলেও তাতে বাস্তবধর্মী কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু পোশাক শিল্পের উপর ভর করে দেশের রপ্তানি আয় বাড়ানোর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্স অনুসরণে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি এবং এ খাতের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের সহযোগিতা আরো বাড়ান উচিত।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় একদিনেই নিহত ১১০ ফিলিস্তিনি

মুক্তির অপেক্ষায় জয়ার ৩ সিনেমা

হাসপাতালে কিয়ারা, আজই হতে পারেন মা

ঢাকায় ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে কলাপাড়ায় মশাল মিছিল

উত্তরা সেনাবাহিনীর হাতে চাঁদাবাজ মিলনসহ গ্রেফতার ৬

মিটফোর্ডে প্রকাশ্যে খুন: তদন্তে অগ্রগতি, বিভ্রান্তিকর প্রচারে ডিএমপির সতর্কবার্তা

ফের লর্ডস টেস্টে হাসল রাহুলের ব্যাট,তিন দিন শেষে সমানে সমান ভারত-ইংল্যান্ড

যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট রহস্যজনকভাবে সেই মূল তিন আসামীকে বাদ দেয়া হয়েছে :যুবদল সভাপতি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অবশ্যই ‘সঠিক পথ’ খুঁজে বের করতে হবে

বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার জঘন্য পরিণতি সোহাগ হত্যাকাণ্ড :বিভিন্ন ইসলামী দলের তীব্র প্রতিবাদ

অমীমাংসিত কিছু বিষয়, শুল্কছাড় নিয়ে আবার আলোচনায় বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে চাই -স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মূল্য যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন

রূপগঞ্জে ৩৪ বছর পর মসজিদের ওয়াকফকৃত ৪১ শতক জমি উদ্ধার করল গ্রামবাসী

বন্দরে বিএনপি নেতাদের চাঁদা না দেয়ায় মসজিদের বালু ভরাট কাজ বন্ধ

পাল্টা শুল্কের শঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ পিছিয়েছে ওয়ালমার্ট

দুই হত্যার প্রাপ্ত টাকা মসজিদে দান করে দেয় র্যাব কর্মকর্তা

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মেশিনারি মেলায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ

টাকা পয়সার সঙ্গে জামা জুতাও নিয়ে যায় ছিনতাইকারী