ঢাকা   রোববার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫ | ২৫ কার্তিক ১৪৩২

আগামী নির্বাচনে বিএনপি কি বিজয়ী হবে, নাকি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে?

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৫ এএম

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির দুর্বলতা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, তারা যেন ক্ষমতায় চলে গেছে। এই আচরণ যে কতটা আত্মঘাতী এবং আগামী নির্বাচনে তাদের বিজয়ের পথকে সংকুচিত করছে, তা তারা বুঝতে পারছে না। তাদের হাবভাব এমন, নির্বাচন হলেই বিপুল ভোটে জিতে যাবে। অথচ ভেতরে ভেতরে যে, দলটির প্রতিপক্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নিজেকে সংগঠিত এবং ভোটের মাঠ গুছিয়ে ফেলেছে, এ নিয়ে তাদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। এর সাধারণ একটি নমুনা হচ্ছে, ঢাকসু ও রাকসু নির্বাচন। এসব নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের শোচনীয় পরাজয় ও ভোট বর্জন এবং জামায়াত সমর্থিত শিবিরের বিপুল বিজয় থেকে তা বোঝা যায়, তারা কতটা সুসংগঠিত। এই দুই নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয়ে জামায়াত-শিবির এবং তাদের সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, ম্যাকানিজম, পাওয়ার প্লে ইত্যাদির যতই অভিযোগ আনা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছেÑ এসব প্রক্রিয়া ভোটে জেতার তাদের সর্বাত্মক পদক্ষেপ। জামায়াত ও ছাত্রশিবির ঢাকসু ও রাকসু নির্বাচনসহ সামনের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জেতার জন্য যত ধরনের কর্মপরিকল্পনা নেয়া দরকার, তা নিয়েছে এবং বাস্তবায়ন করছে। এ নিয়ে সমালোচনা যতই করা হোক না কেন, তাদের লক্ষ্যÑ বিজয় নিশ্চিত করা। মনে রাখা দরকার, যুদ্ধ কোনো আইন-কানুন মেনে চলে না। যেকোনো কৌশলে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াই সকলের লক্ষ্য থাকে। যারা বিজয়ী হয়, ইতিহাস তাদের মনে রাখে এবং তাদের পক্ষে যায়। পরাজিতরা ইতিহাসে পরাজিত হিসেবেই ঠাঁই পায়। ভালো খেলে হেরে যাওয়ার চেয়ে, খারাপ খেলে জিতে যাওয়াকেই মানুষ মনে রাখে। ঢাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে ছাত্রশিবিরের নানা দোষত্রুটির যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, এটা মানুষ পরাজয়ের অজুহাত হিসেবেই দেখছে। এই ত্রুটির পক্ষে বয়ান তৈরির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল মাধ্যমে তাদের বিশাল সাইবার ফোর্স রয়েছে। বলা বাহুল্য, যুদ্ধে নামার আগে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রত্যেক শক্তিরই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকতে হয়। প্রতিপক্ষ কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার কৌশল কি হবে, এসব জেনে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে মোকাবেলা করতে হয়। ঢাকসু ও রাকসুতে ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের ভোটের কাছে পরাজিত হয়নি। পরাজিত হয়েছে ছাত্রশিবিরের প্রস্তুতি, তার কৌশল বা অপকৌশল যেটাই হোক না কেন, তার কাছে। ছাত্রদল শিবিরের কৌশল পর্যবেক্ষণ তো করেইনি এবং বিজয়কে সুসংহত করার কোনো প্রস্তুতিই তার ছিল না। বিপুল সমর্থনও যে কৌশলের কাছে পরাজিত হয়, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ঢাকসু ও রাকসুতে ছাত্রদলের পরাজয়। এই পরাজয় শুধু ছাত্রদলের নয়, বিএনপিরও।

দুই.
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রস্তুতি ও বিজয়ের সম্ভাবনা কতটুকু, তা এই সময়ে দলটির অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনা করা জরুরি। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বা সকালই বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে। আগামী নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয় বোধ করি, বিএনপির আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি সকাল দেখিয়ে দিয়েছে। এই সকাল জানিয়ে দিয়েছে, হাসিনার পতনের পর বিগত একবছরে বিএনপি একটি সুন্দর সকাল পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। সরকার, প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র অটোমেটিক্যালি তার আধিপত্য থাকার কথা। অথচ মানুষ দেখছে, এসব ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য বলতে কিছু নেই। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভেবে দলটির নেতাকর্মীরা এতটাই রিলাক্সড হয়ে আছে যে, এ সুযোগে জামায়াত অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সবকিছু নিজের দখলে নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তার প্রভাব অপরিসীম। যে প্রশাসনযন্ত্র নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে, তা তার দখলে। বিএনপি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে, আর এই মনোভাব পোষণ করছে, নির্বাচন হয়ে গেলে জামায়াতের দখলকৃত সব জায়গা উদ্ধার করা হবে। এটা বুঝতে পারছে না, জামায়াতের দখলকৃত এই প্রশাসনযন্ত্র দিয়েই আগামী নির্বাচন হবে। এই প্রশাসন বিএনপিকে জিততে দেবে, এটা কোনো নির্বোধও ভাববে না। সরকার প্রশাসনে যতই রদবদল করুক না কেন, ঘুরেফিরে তারাই থাকবে। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, প্রশাসনে শুধু জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তাদেরই আধিপত্য নয়, আওয়ামী সমর্থক কর্মর্তারাও বহালতবিয়তে রয়েছে। এছাড়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও আওয়ামী লীগ এই তিন শক্তি জামায়াতের পক্ষে ঐতিহাসিকভাবেই রয়েছে। জামায়াত নিয়ে বিগত বছরগুলোতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মন্তব্য, বক্তব্য ও সম্পর্ক বিচার-বিশ্লেষণ করলে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ফলে বিএনপি এই ত্রিশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশল মোকাবেলা করে কীভাবে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হবে, তা বোধগম্য নয়। এখন বিএনপি ও তার সর্মকদের মধ্যে এই শঙ্কা দেখা দিয়েছে, বিএনপি ভোটারদের কাছে নয়, প্রতিপক্ষের দখলকৃত প্রশাসনের কারসাজি ও কৌশলের কাছে হেরে যাবে। যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপির অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। ইতোমধ্যে জামায়াতের পক্ষে বয়ান তৈরির কাজে নিয়োজিত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা বলতে শুরু করেছে, বিএনপি মুসলিম লীগে পরিণত হবে। যে বয়ান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কথায় কথায় দিয়েছে। এখন সেই সুরেই জামায়াতের সমর্থকরা কথা বলছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিএনপি যদি পরাজিত হয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কি হবে? ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেড় দশকের শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির মরণপণ আন্দোলন-সংগ্রাম কি বিফল হয়ে যাবে? তীরে এসে কি চিরতরে তরী ডুবে যাবে? যদি তা হয়, তাহলে দেশের জন্য ভায়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বড় ও দায়িত্বশীল দল হিসেবে এর দায় বিএনপিকেই নিতে হবে।

তিন.
এ কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত, ঢাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয় বিএনপির জন্য ‘ওয়েক আপ কল’ বা ঘুম ভাঙার সময়। দলটি যদি ঘুম থেকে জেগে না উঠে নির্বাচনে বিজয়ী হতে সুনির্দিষ্ট দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও কৌশল অবলম্বন না করে, তাহলে তার পরাজয় অনিবার্য। দেশের মানুষ বিএনপির এই অবস্থাকে ’৯১ সালে আওয়ামী লীগের সাথে তুলনা করছে। সে সময় আওয়ামী লীগ শতভাগ নিশ্চিত হয়েছিল, তাদের ক্ষমতায় যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। নির্বাচন হলেই বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে। ফলাফল হয়েছে উল্টো। দুর্বল বিএনপি, যার তিনশ’ আসনের অধিকাংশে উপযুক্ত প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা ছিল না, সেই বিএনপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যায়। বিএনপির অপরিচিত প্রার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা প্রার্থী পরাজিত হয়। অপরিচিত সাদেক হোসেন খোকার কাছে শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হয়। সচেতন মহল এখন বিএনপির হাবভাব দেখে ’৯১ সালের আওয়ামী লীগের হাবভাবের সাথে তুলনা করছে। বিএনপির আচরণ সেই সময়ে আওয়ামী লীগের আচরণের কার্বন কপিতে পরিণত হয়েছে। এই ইতিহাস থেকে বিএনপি মনে রেখেছে বলে মনে হয় না।

বলা হয়ে থাকে, বিএনপি একটি মধ্যপন্থী দল। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ধারণ করে। এ কারণেই বিএনপি জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং তার প্রতি আস্থা রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের ৯২ ভাগ মুসলমান ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। তারা কখনোই উগ্রপন্থা পছন্দ করে না, প্রশ্রয়ও দেয় না। আবার তথাকথিত সেক্যুলারিজমের নামে ধর্মহীনতাকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করে না, যেটা পতিত আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগ ও তার প্রভু ভারত বরাবরই আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে চাপিয়ে দিতে অপচেষ্টা করেছে। এজন্য দেশে উগ্রপন্থা ও জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে বলে অপবাদ দিয়ে নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এই অপবাদ ও বদনাম দেয়া সত্ত্বেও দেশের মুসলমানরা তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্বাভাবিক ধর্মকর্ম করে গেছে। তারা ধর্ম নিয়ে যেমন জোরজবরদস্তি পছন্দ করে না, তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চাপিয়ে দেয়া কোনো মতবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা পছন্দ করে না। তারা গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই স্বাভাবিক ধর্মকর্ম করতে চায়। জামায়াতে ইসলামী যে, গণতন্ত্র বাদ দিয়ে তার নিজস্ব মওদুদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, তাতে এদেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই মূল ধারার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখও তার ঘোর বিরোধী। গত ১১ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রামের হাটহাজারি ডাকবাংলো মাঠে এক সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির প্রবীণ ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ ইসলামের দুশমন, আর জামায়াতে ইসলামী দেওবন্দী কওমী মাদরাসার দুশমন। তিনি জামায়াতকে ফেরাউনের জাত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই ফেরাউনের জাত যদি কোনোভাবে কখনো সরকারে আসতে পারে, তাহলে দেওবন্দী কওমী ধারা এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ধারার মাদরাসার কোনো অস্তিত্ব কোথাও রাখবে না। এর আগে গত ৪ আগস্ট ফটিকছড়ির নাজিরহাট পৌরসভার একটি কমিউনিটি সেন্টারে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, জামায়াত প্রকৃত ইসলামি দল নয়, তারা ভ- ইসলামি দল। তারা প্রকৃত ইসলামকে ধারণ করে না। তারা মদিনার ইসলাম নয়, মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমরা জামায়াতকে ইসলামি দল মনে করি না। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, যদি আগামী নির্বাচনে জামায়াত ও তার সমর্থকদের ম্যাকানিজমের কাছে বিএনপির পরাজয় ঘটে, তাহলে আমাদের গণতন্ত্র ও মডারেট মুসলমান দেশের পরাজয় ঘটবে এবং মওদুদীবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি উগ্রবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিএনপি এ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে কিনা এবং আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুলধারার মুসলমানদের পালস্ বুঝতে পারছে কিনা, তা স্পষ্ট এবং পরিস্কার কোনো অবস্থান বোঝা যাচ্ছে না। অথচ জিয়াউর রহমান এক ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ দিয়ে দেশের মানুষের মন জয় করেছিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলধারার মুসলমানদের বাইরে যাওয়া যাবে না। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশের মানুষ পছন্দ করে না। তারা ইসলামের স্বাভাবিক আচার-আচরণ, কৃষ্টি-সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করতে চায়। বেগম খালেদা জিয়াও জিয়াউর রহমানের এই রাজনীতি ধারণ করে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। ইদানিং বিএনপির কিছু নেতা দেশে উগ্রবাদের উত্থান ঘটছে বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। এসব বক্তব্য যে আওয়ামী লীগ ও ভারতের ন্যারেটিভের ধারক-বাহক এবং সেটাকেই সমর্থন করা, তা তারা বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না। তাদের এ বক্তব্য যেমন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের জন্য আঘাতের, তেমনি বিএনপির জন্য আত্মঘাতী। তারা কি তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? বাস্তবতা থেকে কি তারা এতটাই বিচ্যুত? তারা কি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমাজ কীভাবে বদলাচ্ছে, তা অবলোকন করেছেন? যারা মসজিদের জামাতে নামাজ পড়তে যান না, তারা যদি যেকোনো ওয়াক্তে পাড়া-মহল্লার মসজিদে যান, তাহলে দেখবেন, ছোট ছোট বাচ্চা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাথে বেড়ে ওঠা টেক-জি তরুণরা জামাতে নামাজ পড়ছে। এ দৃশ্য কি জোর করে তৈরি করা হয়েছে? না। এটাই আমাদের দেশের মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আমরা এটাও দেখেছি, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশে উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের কথা বলে যত নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, ততই মানুষ ইসলামের অনুশাসনের দিকে ঝুঁকেছে। ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। গত এক দশকের দিকে আমরা যদি তাকাই তাহলে দেখব, আধুনিক নারী এমনকি ছাত্রীদের মধ্যে হিজাব পরার প্রবণতা বহুগুণে বেড়েছে। হরেক রকম ডিজাইনের হিজাব পরে তারা স্মার্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। হিজাবের বড় বাজার দেশে গড়ে উঠেছে। সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারদের স্ত্রীদের মধ্যে হিজাব পরার সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। হিজাব পরা নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও রয়েছে। অফিসারদের মধ্যে পরিশীলিতভাবে দাঁড়ি রাখারও প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামের এই যে আচার ও অনুশাসন, তা কিন্তু জোর করে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি বা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এটা চাপিয়ে দেয়া নয়, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন ধর্মাচার থেকে হয়েছে। এটাই আমাদের দেশের মুসলমানের বৈশিষ্ট্য। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মভীরুতা বা ধার্মিকতার এই প্রবণতা বিএনপি বুঝতে পারছে কিনা, প্রতীয়মান হচ্ছে না। যদি বুঝত, তাহলে তার কিছু নেতা দেশে উগ্রবাদের উত্থান ঘটছে বলে ঢালাও বক্তব্য দিতেন না। তাদের এ বক্তব্য আলেম-ওলামা শ্রেণীসহ সাধারণ মুসলমানকে আহত করেছে এবং প্রতিপক্ষকে সুবিধা দিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, ইসলামের নামে জামায়াত যে ধর্মাচার চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে, তা দেশের মানুষকে ভীত করে তুলছে। তরুণ প্রজন্ম শংকিত হয়ে উঠছে। তাদের মধ্যে এ পারসেপশন জন্মাচ্ছে যে, জামায়াতের ধর্মাচার তাদের স্বাধীন ও স্বাভাবিক ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠছে। মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে জামায়াতের যে নিজস্ব ধারণা, তা মেয়েদের মার্জিত ও শালীন পোশাক পরার ক্ষেত্রেও অন্তরায় বলে সচেতন মহল মনে করে। অথচ যে সউদী আরবে একসময় মেয়েদেরকে পুরো মুখমন্ডল ঢেকে চলাফেরা করা বাধ্যতামূলক ছিল, সেই সউদী আরবে এখন মেয়েদের পোশাক অনেক শিথিল করা হয়েছে। তারা মুখমন্ডল খোলা রেখে হিজাব পরছে। লোকালয়ে যাচ্ছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ নারীদের পোশাক কেমন হবে তা সহজ করে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা মাথা ঢেকে রাখ, বুকের উপর কাপড় টেনে দাও। তিনি আফগানিস্তানের নারীদের মতো পুরো মুখ, হাত-পা ঢেকে চলতে বলেননি। এমন পোশাক পরতে বলেছেন, যাতে নারীর দেহঅবয়ব স্পষ্ট হয়ে না উঠে।

চার.
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মন ও মনন বুঝে পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। জিয়াউর রহমান দেশের মুসলমানদের এই চরিত্র ধারণ করেছেন বলেই বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত দলে পরিণত হয়েছে। বিএনপির নেতারা যদি এই বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে এগিয়ে যায়, তাহলে তার বিজয় সুসংহত হবে। এর বাইরে ভিন্ন চিন্তা করলে, ভরাডুবি ছাড়া গতি নেই। বিএনপিকে বুঝতে হবে, দেশের মানুষ আওয়ামী ও ভারতীয় ন্যারেটিভ সেক্যুলারিজম চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপিকে তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের দিকে তাকাতে হবে। তারা কীভাবে দেশের মানুষের মন জয় করেছেন এবং দলকে ক্ষমতায় নিয়েছেন, সে ধারায় বিএনপিকে চলতে হবে। নির্বাচনে জামায়াত কি ম্যাকানিজম করে এগুচ্ছে, তা বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বিচ্যুতি ঘটলে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে ছয় মাসও অপেক্ষা করতে হবে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মহেশখালী উপজেলা হাসপাতালে শয্যা বাড়ান
স্কাউট পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা
তারেক রহমানের অপেক্ষায় সারাদেশ
ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধ করতে হবে
অভিভাবকদের সচেতনতা
আরও

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল

ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল

মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল

মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল

“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ

“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ

যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম

যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম

২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড

২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড

ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল

ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল

সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার

সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার

আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি

আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি

বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি

বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি

পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা

পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার

এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার

নাইম-শহিদুলের ফিফটি

নাইম-শহিদুলের ফিফটি

৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ

৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ

শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে

শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে

কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন

কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন

বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা

বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা

কারাগার থেকে হাজতি পালানোর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

কারাগার থেকে হাজতি পালানোর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

ঝিনাইদহে শহীদ জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

ঝিনাইদহে শহীদ জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

সিলেট-রংপুর ম্যাচে বোলারদের দাপট

সিলেট-রংপুর ম্যাচে বোলারদের দাপট