ঢাকা   রোববার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫ | ২৫ কার্তিক ১৪৩২

বাণিজ্যে এখনো ভারতনির্ভরতা কেন?

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশি পণ্যের উপর একের পর এক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পরও ভারত থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক এক নতুন মেরুকরণের উপর দাঁড়িয়েছে। এসময় বাণিজ্য বৃদ্ধির এমন বাস্তবতা আমাদের জন্য ভিন্ন বার্তা বহন করছে। শেখ হাসিনার রেজিমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও আন্দোলন হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। ভারতীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও হেজিমনিক প্রভাব বলয়ে গড়ে ওঠা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই অভ্যুত্থানের পর সারাবিশ্ব বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেও ভারত সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবেই বৈরিতা প্রকাশ পায়। ভারতের অনুগত সরকার দীর্ঘদিনে বাংলাদেশের বাণিজ্যকে ভারতনির্ভর করে তুলেছিল। বিশেষত খাদ্যসশ্যসহ নিত্যপণ্যের উপর ভারতনির্ভরতাকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল গ্রহণ করে তারা। আকস্মিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ভারতনির্ভর চিকিৎসা সেবা বন্ধ করতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি আরোপের মধ্য দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকেও চাপে ফেলতে চেয়েছিল ভারতীয় শাসকরা। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। ভারতের বিকল্প বাজার থেকে পণ্য সরবরাহ পেতে বাংলাদেশকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। এমনকি চিকিৎসা সেবার জন্যও অপ্রত্যাশিতভাবে চীনের দরজা খুলে যায়। ইতিপূর্বেও ¯্রফে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত, যা পক্ষান্তরে দেশের জন্য শাপে বর হয়েছিল। বাংলাদেশকে গো-সম্পদে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়ক হয়েছিল। ভারতের এবারের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও জনজীবন ও বাজার মূল্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। উপরন্তু খাদ্যমূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার।

বাহ্যিকভাবে ভারতের পক্ষ থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা রকম কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও আদতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে তার কোনো প্রভাব পড়েনি বলেই ধারণা করা যায়। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেখানে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১০৭ কোটি ডলার, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১ হাজার ১৪৯ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। ভারতের অনুকূলে প্রায় ৬০০ শতাংশ ভারসাম্যহীন বাণিজ্যের পরও ভারত বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পাটপণ্য ও তৈরি পোশাকের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে ডাম্পিং ট্যারিফ ব্যারিয়ার, স্থল বন্দরের উপর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ঠেকানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এভাবেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ক্রমবর্ধমান হারে ভারসাম্যহীন করে তোলা হয়েছে। কিন্তু রক্তাক্ত জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা নতুন বাংলাদেশের জনমত বাণিজ্যে ভারতনির্ভরতাকে সমর্থন করে না। তারা প্রতিবেশীর সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে স্বাভাবিক ভারসাম্য ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রত্যাশা করে। এ কথা আজ প্রমাণিত যে, ভারতের যে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও জনজীবনের স্বাভাবিক গতিশীলতা অক্ষুণœ রাখা সম্ভব। এতদ সত্ত্বেও বাণিজ্যে ভারতনির্ভরতা অক্ষুণœ থাকার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার কারণ ও নেপথ্যের কুশীলবদের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে হবে।

পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনৈতিক বিশ্বে রাজনৈতিক কারণে বাণিজ্যকে ব্যবহারের অনেক নজির থাকলেও অর্থনীতির গতিশীলতা স্বাভাবিক নিয়মেই চলমান থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট বাজার কিংবা দেশের উপর অধিক নির্ভরশীলতা যেকোনো সময় বড় ধরনের ক্ষতি কিংবা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি আরোপের কারণে ভারতসহ অনেক দেশের অর্থনীতি বিপাকের সম্মুখীন হয়েছে। দেশের প্রধান রফতানি অ্যাপারেল পণ্যে অতিমাত্রায় মার্কিননির্ভরতার কারণে বাংলাদেশও এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য আলোচনা ও সমঝোতায় অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশ অনেকটাই সংকট উত্তরণে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের সংকট এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে রফতানি পণ্যের বিকল্প বাজারসহ বাণিজ্য বহুমুখীকরণের কথা বলা হলেও আদতে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে ভারতের মতো অবিশ্বস্ত ও বৈরী প্রতিবেশীর সাথে বাণিজ্যনির্ভরতা ও বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হলেও ভারতের অনুগত স্বৈরাচারী সরকার সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পেরিয়ে এসেও এ বিষয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এ কারণেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চরম টানাপোড়নের মধ্যেও বাংলাদেশে ভারতের রফতানি বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখা গেল। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের এহেন বাস্তবতা কাক্সিক্ষত নয়। পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ বেশিরভাগ মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মী ভারতে পালিয়ে গিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত একটি গণতান্ত্রিক জাতীয় নির্বাচনের জন্য সব পক্ষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেও ভারত এবং পতিত স্বৈরাচারের দোসররা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় ভারতের উপর বাণিজ্যনির্ভরতা সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমাদের অর্থনীতি, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, রফতানি বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প ও নির্বিঘœ বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতি বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ঝুঁকি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কাছে আরো সচেতন উদ্যোগ কাম্য। বিশেষত ভারতের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বিকল্প বাজারের দিকে নজর দিতেই হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মহেশখালী উপজেলা হাসপাতালে শয্যা বাড়ান
স্কাউট পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা
তারেক রহমানের অপেক্ষায় সারাদেশ
ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধ করতে হবে
অভিভাবকদের সচেতনতা
আরও

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল

ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল

মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল

মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল

“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ

“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ

যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম

যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম

২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড

২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড

ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল

ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল

সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার

সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার

আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি

আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি

বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি

বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি

পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা

পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার

এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার

নাইম-শহিদুলের ফিফটি

নাইম-শহিদুলের ফিফটি

৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ

৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ

শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে

শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে

কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন

কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন

বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা

বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও আলোচনা সভা

কারাগার থেকে হাজতি পালানোর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

কারাগার থেকে হাজতি পালানোর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

ঝিনাইদহে শহীদ জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

ঝিনাইদহে শহীদ জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

সিলেট-রংপুর ম্যাচে বোলারদের দাপট

সিলেট-রংপুর ম্যাচে বোলারদের দাপট