নাইজেরিয়ার পথে দেশ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০২ এএম
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রামে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ৪টি মাজারে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ একদল লোক। ‘বেমজা মহসিন’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে গত বুধবার সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে একটি আপত্তিকর পোস্ট দেয়া হয়। এ ঘটনায় এলাকার লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং পুলিশ মহসিনকে গ্রেফতার করে। মো. শরীফুল ইসলাম নামের একজন মামলা করেন। আপত্তিকর এই পোস্টকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন মাইকে ঘোষণা দিয়ে আসাদপুর গ্রামে কফিল উদ্দিন শাহ ও আলেক শাহর মাজারে আগুন এবং কালু শাহ ও আবদু শাহর মাজারে হামলা-ভাঙচুর করে। গ্রামের একজন মাওলানা বলেছেন, ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য যে করেছে, তার বিচার হওয়া দরকার। তবে এভাবে মাজার ভাঙচুর ও আগুন দেয়া ঠিক হয়নি। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ফেসবুকে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। যে পোস্ট দিয়েছে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং আদাল তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে, তারপরও এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাজারে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর কেন করা হবে? এর পেছনে যে, মাজারবিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী জড়িত তা সহজেই বোঝা যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ঘটনার পেছনে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী এবং তাদের সমর্থকদের ইন্ধন ও ভূমিকা থাকলে পারে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামের আড়ালে এসব ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে কিংবা ঘোষণা দিয়ে মব ভায়োলেন্স সৃষ্টির ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় শ খানেক মাজার ভাঙা হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সরকার এর একটি ঘটনারও বিচার করেনি। বরং নিশ্চুপ থেকে এসব ভায়োলেন্সকে বাড়তে দিচ্ছে। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য পর্যবেক্ষকরা ড. ইউনূসকে দায়ি করছেন। এমনও বলেছেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে এসব ঘটনা ঘটছে।
প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, গত এক বছর ধরে ক্রমাগত মাজার ভাঙা, মব সন্ত্রাসসহ নানা অনাকাক্সিক্ষতি ঘটনায় দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? দেশ কি নাইজেরিয়া, সোমালিয়ার মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে রয়েছে? প্রায় ৫৪ শতাংশ মুসলমানের দেশ নাইজেরিয়ায় প্রতিনিয়ত ধর্মীয় সংঘাত, সহিংসতা ও উগ্রবাদিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটিতে ধর্মীয় সহিংসতা বলতে খ্রিস্টান-মুসলিম দ্বন্দ্বকে বোঝায়, যার সূত্রপাত ১৯৫৩ সাল থেকে। বর্তমানে দেশটির ধর্মীয় সহিংসতা বোকো হারাম বিদ্রোহের দ্বারা প্রভাবিত, যার লক্ষ্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর নাইজেরিয়ায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে দেশটি অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। হত্যা, সংঘাত লেগেই আছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায়ও কোনো কিছু হলেই ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ইমাম হত্যাসহ সংঘাত-সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে গত এক বছরে এই প্রবণতা শঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ মাসে ২৩০টি মব সন্ত্রাস এবং ১৩ মাসে ২২০ জন নিহত হয়েছে। এসব মব সন্ত্রাস কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইসলামের নামে উগ্রবাদিতা দেখানোর প্রবণতা বেশি। আমরা দেখেছি, তৌহিদী জনতা নামে একটি শ্রেণী মেয়েদের ফুটবল খেলা, তারকাদের দোকান উদ্বোধন ইত্যাদি নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে গোলোযোগ করেছে। মাজার, দরগায় ভাঙচুর ও হামলা চালিয়েছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার এগুলোর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত করেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মাঝে মাঝে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন খোদা বখশ চৌধুরী। তাদের সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ধর্মমন্ত্রী ড. এএফএম খালিদ হোসেন একজন বিশিষ্ট আলেম। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, তারা কী দায়িত্ব পালন করছেন? কী আইন প্রয়োগ করছেন? কেন মব সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারছেন না? উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশের ৯২ ভাগ মুসলমান যেমন উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয় না, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকেও মেনে নেয় না। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বিস্তারে হেন কোনো অপচেষ্টা নেই, যা করা হয়নি। দেশের মুসলমানরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে, ইসলামের নামে উগ্রবাদী অপসংস্কৃতিও তারা পছন্দ করে না। যার যার বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করে। বিশ্বের বুকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির দেশের মানুষ স্থাপন করেছে। পশ্চিমা বিশ্বও বাংলাদেশকে একটি মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে বরাবরই অভিহিত করে আসছে। কল্পিত ও বানানো উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের উত্থানের ন্যারেটিভ তৈরি করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। তার পতনের পর গত এক বছর ধরে বিভিন্ন মহল ইসলামের নামে উগ্রবাদী পন্থা অবলম্বন করছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ যেখানে অন্যমত ও অন্য ধর্ম এবং বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে বলেছেন, সেখানে একশ্রেণীর ভ্রান্ত মতবাদী অন্যের ধর্মীয় আচরণে আঘাত হানছে। আমাদের দেশে কখনোই মাজার বা দরগা ভাঙার মতো পরিস্থিতি ছিল না। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাজার-দরগা ভাঙার বিষয়টি অনেকটা মৌচাকে ঢিল মারার মতো। যারা এ পন্থী তাদের সাথে মাজার-দরগা বিরোধীরা বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চাইছে। মূল ধারার ইসলামী সংগঠন ও স্কলাররা বরাবরই এ ধরনের উগ্রবাদ ও অসিহিষ্ণুতার বিরোধিতা করে আছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব অপকর্ম ভারতের হাতে বাংলাদেশবিরোধী অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশটি বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের উত্থানের চারণভূমি বলে অপপ্রচার শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার কলকাতায় কম্বাইন্ড কমান্ডার্স কনফারেন্সে বক্তারা বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের উত্থান ঘটছে বলে তার নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পশ্চিমাদের সামনেও তা তুলে ধরছেন। তারাও এটি বিবেচনায় নিচ্ছে, যা দেশর জন্য ভয়ংকর বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মব সৃষ্টি করে একটি শ্রেণীর নানা অপকর্ম ও উগ্র আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যর্থ হচ্ছে, তা এখন দৃশ্যমান। উল্টো একের পর এক তা ঘটে চলেছে। সরকার শুধু মুখে মুখে লিপসার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকার নির্বাচন করবে কীভাবে? বলা বাহুল্য, অন্তর্বর্তী সরকার তরুণদের গণঅভ্যুত্থানের ফসল হলেও সাফল্য দেখাতে পারেনি। পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। নেপালে জেন-জি আন্দোলন করে সরকার হটিয়েছে। তবে ক্ষমতা চলে গেছে অভিজ্ঞ ও প্রবীণদের হাতে। সেখানের অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেছে। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এক বছরের বেশি হয়ে গেলেও নির্বাচন নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে। সরকার আইনশৃঙ্খলাসহ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এটা অত্যন্ত মর্মদায়ক। কুমিল্লার হোমনায় মাজার ভাঙা নিয়ে সরকারের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি। কাদের ইন্ধনে, কারা এই অপকর্ম করেছে, তা দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। কুমিল্লার এসপি, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। এমন আরেকটি ঘটনাও যাতে কোথাও না ঘটে, সরকারকে সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ
যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম
২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড
ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল
সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার
আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি
বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি
পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার
নাইম-শহিদুলের ফিফটি
৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ
শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে
কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন
বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র্যালি ও আলোচনা সভা
কারাগার থেকে হাজতি পালানোর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি
ঝিনাইদহে শহীদ জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধন
সিলেট-রংপুর ম্যাচে বোলারদের দাপট
শেরপুরে চাকরির প্রলোভনে পাহাড়ে এনে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা: আটক ৫
প্রায় ৬ বছর পরে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ফল আমদানি শুরু হয়েছে
