অর্থনীতি গতিশীল করতে দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০০ পিএম
দেশের চলমান বেকারত্ব ও অর্থনীতির হাল নিয়ে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে দুটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বেকারের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে, যাদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত। ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং বেকার হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক। অন্যটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যার বেশিরভাগই গেছে সরকারি খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে মোট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১২.১৫ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে এটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই দুই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, দেশের অথনৈতিক পরিস্থিতি কতটা নাজুক। বলতে দ্বিধা নেই, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনমলে লুটপাট ও লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার পর, তা পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার সফল হতে পারেনি। গত এক বছরেও অর্থনীতিকে একটি স্বাভাবিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করাতে পারেনি। বরং দিন দিন খাদের কিনারে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান তো নেই-ই, উল্টো অসংখ্য কর্মজীবী বেকার হয়েছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন স্থবির হয়ে আমদানি-রফতানি কমে গেছে। সরকারের হাতে টাকা না থাকায়, দেশ চালাতে গিয়ে ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে, আবার বিদেশ থেকেও নিচ্ছে। দেশকে ঋণে জর্জরিত করা হচ্ছে। সরকার ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের শাসনামলে নেয়া বেশ কিছু কমগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ স্থগিত করেছে, বড় প্রকল্পের কাজও ধীর হয়ে গেছে। এতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়ে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ও দুর্নীতির বড় অংশ জুড়ে ছিল তার চারপাশে থাকা অলিগার্ক শ্রেণী তথা ব্যবসায়ী চক্র। তার পতনের পর তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন, অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আবার অনেকে সরকারকে বিপাকে ফেলতে বেতন-ভাতা, বিভিন্ন সুবিধা ইত্যাদি দাবিদাওয়ার ছুঁতোয় তাদের শিল্পকারখানার শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলন করিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক সাধারণ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী শ্রমিকদের আন্দোলন সামাল দিতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। এমন শত শত কারখানা বন্ধ হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মকর্তা বেকার হয়েছে। এতে বেকারত্বের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয়েছে। ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান সংকোচন নীতি নিয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছে এবং করছে। দেখা যাচ্ছে, নতুন কর্মসংস্থান দূরে থাক, কর্মসংস্থানের সকল পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। আমরা বারবার বলেছি, শেখ হাসিনার অলিগার্ক, যারা দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে জড়িত, আইন অনুযায়ী তাদের বিচার করা হোক। তবে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে, সচল থাকে সরকারকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের মালিকের দুর্নীতির কারণে, তার বিচার হতে পারে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনোভাবেই উচিৎ হবে না। দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকোর মালিক গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, তার বিচার হোক, তবে প্রতিষ্ঠান যাতে সচল থাকে, সরকারকে এ ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার এ প্রতিষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেছে বটে, তবে প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে তা খুব একটা কার্যকর হয়নি। ফলে এই শিল্প গ্রুপের প্রায় ৪০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছে ৫০-৬০ হাজারের মতো শ্রমিক ও কর্মকর্তা। তাদের কর্মসংস্থান হয়নি। এমন আরও শত শত কারখানার শ্রমিক-কর্মকর্তা বেকার হয়েছে। তাদের পরিবারগুলো নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও হাতাশার মধ্যে রয়েছে। অনেকে হতাশ হয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে বিপদগামী হয়েছে এবং হচ্ছে। শিল্পকারখানা খোলা রাখতে সরকারের এই ব্যর্থতা অমার্জনীয়। আমরা দেখেছি, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং কোম্পানির মালিককে দেশটির সরকার বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল, তবে অর্থনীতির স্বার্থে তার প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বন্ধ না হয়, সে ব্যবস্থা করেছিল। বিশ্বখ্যাত হুন্দাই কোম্পানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিলেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সউদী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগে দেশটির প্রিন্স, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩৮০ জনকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। পাঁচ তারকা রিটজ-কার্লটন হোটেলে তাদের গৃহবন্দী রেখে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা তাদের অর্থ সরকারকে ফেরত দেওয়ার পর তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার জরিমানা আদায় করা হয়। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে প্রিন্স সালমান এ কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশে যেসব ব্যবসায়ী এ কাজ করেছে, তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কর্মরতরা যেমন বেকার হয়েছে, তেমনি কর্মসংস্থানের পথও রুদ্ধ হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলে অন্তত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকারদের অনেকে এখন কিছু রাজনৈতিক দলের লোকসমাগমের পুঁজি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহার করছে। অর্থের বিনিময়ে তাদের মিছিল-মিটিংয়ে নিচ্ছে। উপায় না দেখে, বাধ্য হয়ে তারাও যাচ্ছে। ওইসব রাজনৈতিক দলও তাদের সমাবেশে লোকসমাগম হচ্ছে বলে সুবিধা নিচ্ছে। এতে কী বেকারত্বের অবসান হচ্ছে? হচ্ছে না। উল্টো রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা ও উত্তপ্ত হচ্ছে। অপরাধ বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভাব্য দল বিএনপি এসব ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশের চলমান সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিচ্ছে না। অন্যদিকে, তার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জন্য যা যা করণীয় তা করছে। সে তার পরিকল্পনা মতো বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে, যদি যথাসময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতির পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
সরকার বিদেশ থেকে ঋণ আনতে পারছে, বিনিয়োগ আনতে পারছে না। বিদেশি বিনিয়োগকারিরা যে নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগ করবে না, তা ইতোমধ্যে সকলের জানা হয়ে গেছে। দেশি বিনিয়োগকারিরাও একই অবস্থানে রয়েছে। প্রত্যেকেই নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় দিন গুনছে। এমতাবস্থায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নির্বাচন দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারও তা ভালোভাবে বুঝছে। বুঝেই সে এখন পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য যে, কিছু রাজনৈতিক দল নানা ইস্যু নিয়ে এগুচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকার ততটা দৃঢ়তা দেখাতে পারছে না। তার মধ্যে একধরনের আপসকামি প্রবণতা রয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা আখেরে দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে না। ওইসব দল দেশের স্বার্থ না দেখে, নিজ নিজ স্বার্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুস্থির বা সুধারায় প্রবাহিত করতে পারছে না। আবার দেশের অর্থনীতি যে, দিন দিন শোচনীয় হয়ে পড়ছে, তাও স্বাভাবিক করতে পারছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশে দ্রুত নির্বাচন হওয়া জরুরি। উন্নয়ন সহযোগী দেশ, সংস্থা, দেশের ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই দ্রুত নির্বাচন দেয়ার তাগিদ দিচ্ছে। এর বিকল্প তারা দেখছে না। সরকারের উচিত, দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দ্রুত নির্বাচনের সকল ব্যবস্থা দৃঢ়তার সাথে আয়োজন করা। সরকারের মেয়াদ আর যে কয়মাস রয়েছে, এর মধ্যে অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ও মসৃণ করার পথনকশা তৈরি করে যেতে হবে।
সংশোধনী
আজ দৈনিক ইনকিলাবে প্রিন্টং ভার্সনে 'অর্থনীতি গতিশীল করতে দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই' শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়র দ্বিতীয় প্যারায় অসাবধানতা বশত ‘১০০ কোটি ডলার’ উল্লেখ করা হয়। প্রকৃত সংখ্যা হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা পাঠকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।
- সম্পাদকীয় বিভাগ
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আসামে নতুন করে বুলডোজার অভিযানে বাস্তুচ্যুত শত শত পরিবার
আকুর বিল পরিশোধ, ৩১ বিলিয়নে নামলো রিজার্ভ
সরকারের আশ্বাসে প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি আপাতত স্থগিত
সাতক্ষীরায় এমএফএস-এর অপব্যবহার রোধে এজেন্টদের সচেতনতা বাড়াতে জেলা পুলিশ ও বিকাশ-এর সমন্বয় কর্মশালা
গণমাধ্যম শ্বাসরুদ্ধ করে ‘রাজত্ব’ কায়েম ,বদলি হলেন ডিসি মুফিদুল
নাসিরনগরে তিন আওয়ামী নেতা গ্রেফতার
ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল
মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল
“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ
যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম
২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড
সালাহউদ্দিন আহমদের অনুরোধে অনশন ভাঙলেন আম জনতার তারেক, নেওয়া হলো হাসপাতালে
ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল
সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার
আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি
বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি
পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার
নাইম-শহিদুলের ফিফটি
