উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট কবে দূর হবে?
১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৬ এএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৬ এএম
দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত চার কোটি মানুষ ভয়াবহ খাবার পানির সংকটে ভুগছে। এটা তাদের জীবনযাত্রার সবচেয়ে কঠিন সংকট। চারদিকে অফুরান পানি থাকলেও তা পানযোগ্য নয়। লবণাক্ততার বিস্তার মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির আধার কমে গেছে। কুয়া, পুকুর, দীঘি, জলাশয়, খাল-বিল ইত্যাদি লবণাক্ততার গ্রাসে পরিণত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এমন কি লবণাক্ততা মাটির বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানিও আর লবণাক্ততামুক্ত নয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের টেকনাফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা-খুলনা পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগের ১৯টি জেলা কমবেশি আগ্রাসী লাবণাক্ততার শিকার। লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি। ধান উৎপাদন মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে। মাটিতে অতিরিক্ত লবণের কারণে ধানের গাছ বাড়ে না, শুকিয়ে যায়, শীষে দানা আসে না। ফলে ফলন আশানুরূপ হয় না। অনেক সময় ধানী জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখতে বাধ্য হয় কৃষক। এক পরিসংখ্যান মোতাবেক উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ১০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। কৃষির এই বিপুল ক্ষতি পূরণের কোনো উপায় নেই। কৃষির সঙ্গে মিঠা পানির ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। কৃষির জন্য মিঠা পানির পর্যাপ্ত যোগান অপরিহার্য। খাদ্যশস্য বা অন্য কোনো কৃষিপণ্য বাইরে থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু খাবার পানির মতো নিত্য প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য উপকরণের চাহিদা সেভাবে পূরণ করা সহজসাধ্য নয়। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য খাবার পানি সংগ্রহ করা এখন অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে বড় কাজ। সাধারণত মহিলা ও শিশুরা খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকে। কলসী ও পাত্র নিয়ে তাদের মাইলের পর মাইল গিয়ে কোনো কুয়া, পুকুর বা অন্য কোনো উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির এই অভাব বা সংকটকে পুঁজি করে বিভিন্ন এনজিও পানির ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। গভীর নলকূপ বসিয়ে তারা পাইপে পানি সরবরাহ করে। নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে এই পানি কিনে নিতে হয়। কোথাও কোথাও এলাকার লোকজন একসঙ্গে মিলে গভীর নলকূপ বসায়। এজন্য এনজিওরা ঋণ দেয়। পর্যায়ক্রমে সুদাসলসহ এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই নারী। তারা অভিনব পানির ঋণে বন্দী হয়ে অসহায় অবস্থার শিকার হচ্ছে। ইনকিলাবের এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, কাগজে-কলমে ‘পানির ঋণ’ লেখা থাকে না। অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে যে ঋণ দেয়া হয় সেই ঋণের টাকার বিনিময়ে প্রতিদিনই পানি কিনতে বাধ্য হচ্ছে নারীরা। আবার নলকূপ বা গভীর নলকূপ বিকল বা অচল হয়ে পড়লে আবার ঋণ নিয়ে তা মেরামত করতে হয়। এভাবে এনজিও’র ক্ষুদ্র ঋণের নামে মহাজনী চক্রবৃদ্ধি সুদে সর্বসান্ত¦ হচ্ছে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ। এনজিও’র এরকম নির্বিচার শোষণে মানুষ অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ।
উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠা পানির সংকট নতুন নয়। বিভিন্ন কারণে বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনে এ সংকট বাড়তে বাড়তে এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এক সময় চিংড়ী চাষের জন্য মিঠা পানির ধানী জমিতে সাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ীর পোনা ছাড়া হতো। এভাবে চিংড়ীর চাষ হলেও ধান চাষের জন্য ওইসব জমি বন্ধা হয়ে যায়। এরূপ বহু জমি ধান চাষের অনুপযোগী হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড় ও জালোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিডর, আইলা, ফনী, আস্ফান ইত্যাদি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল সংখ্যক উপকূলবাসী হতাহতই হয়নি, তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, বৃক্ষ-বাগান, ধ্বংস হয়েছে। আরো একটা বড় ক্ষতি হয়েছে এই যে, উপকূলভাগে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে এবং অনেক স্থানে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সুপেয় পানির সংকট, লবণাক্ততা সম্প্রসারণের সংকট, আবাদ-উৎপাদনের সংকট, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংকটসহ উপকূলীয় জনপদ সুরক্ষার, সংকট মোকাবিলার উপযুক্ত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলে গণ্য হলেও গত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বনায়ন, সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার তাকিদ যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। যে সব বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে, তা উঁচু ও টেকসই হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার-মেরামত উপেক্ষিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে প্রতি বছরই বড় অংকের বরাদ্দ দেয়া হলেও তা তেমন কাজে আসে না। অনুরূপভাবে উপকূলীয় বনায়ন ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে, যা কমই কাজে আসে। অরক্ষিত উপকূল অরক্ষিতই রয়ে গেছে, যা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি ও দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশা ছিল। যেহেতু পতিত স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে দুঃশাসন, খুন, জুলুম, লুটপাট, পাচার ইত্যাদিই ছিল মূল লক্ষ্য, সুতরাং গণপ্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে গেছে। উপকূল সুরক্ষা ও উপকূলব্যবস্থাপনার কিছুই ওই সরকার করেনি। উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট প্রকট আকার নিলেও তা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। চীন-শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাগরের পানি শোধন করে খাবারের পানিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখালেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার পূর্বের সরকারগুলোর মতোই আচরণ করছে। এ সরকার ‘এনজিও সরকার’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এ কারণে এনজিওদের প্রভাব পতিপত্তি বেড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশেই তার প্রমাণের অভাব নেই। সাদা পাথর আর প্রবাল রক্ষায় সরকারের অতিরেক দায়িত্বশীলতা লক্ষ করা গেছে। অথচ উপকূল রক্ষা, যানজট নিরসন, আইন শৃংখলার উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের সংস্কার, নাগরিক নিরাপত্তা প্রদান, চাঁদাবাজি প্রতিরোধ প্রভৃতি অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট নজর আছে, এমন প্রমাণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম যে কাজ অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হাস্তানন্তরÑ সে ক্ষেত্রেও তার লেজেগোবর অবস্থা দৃশ্যমান। রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে সরকার এ যাবৎ যা করেছে তা সম্পূর্ণ বিফলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংস্কারের পরিধি কতদূর হবে, জুলাই সনদের অবস্থান কোথায় হবে, তার বাস্তবায়নই বা কীভাবে হবে, সংবিধানে নেই, আরপিওতে নেই, এমন দাবি অর্থাৎ পিআর দাবিরই বা কী হবে এসব বিষয়ে, সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। এটা তার দুর্বলতার লক্ষণ। কাজেই, তার উচিত সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এবং নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, দেশের গুরুতর সমস্যাসহ প্রতিদিনের সমস্যা নিয়ে সরকারের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাঙিক্ষত দায়িত্বশীলতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা কাম্য নয়। আগামীর ক্ষমতাকামী দলগুলোর উচিত জনগণের সংকট-সমস্যা, আশা-প্রত্যাশার সঙ্গে সব সময় সম্পর্কিত থাকা। সমাধান ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সাতক্ষীরায় এমএফএস-এর অপব্যবহার রোধে এজেন্টদের সচেতনতা বাড়াতে জেলা পুলিশ ও বিকাশ-এর সমন্বয় কর্মশালা
গণমাধ্যম শ্বাসরুদ্ধ করে ‘রাজত্ব’ কায়েম ,বদলি হলেন ডিসি মুফিদুল
নাসিরনগরে তিন আওয়ামী নেতা গ্রেফতার
ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রথম ১২ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা জানালেন জ্যেষ্ঠ ইরানি জেনারেল
মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাপনের কাপড় জড়িয়ে মশাল মিছিল
“মোস্ট ইনোভেটিভ ফিনটেক প্রোডাক্ট ডিজাইন অব দ্য ইয়ার” অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ
যারা নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে: শামীম
২৬টি সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড
ধানের শীষে ভোট দিন, এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব আমার : ব্যারিস্টার মীর হেলাল
সরাইলে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেছেন মো. আবুবকর সরকার
আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক : সিইসি
বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সিরিজে আছেন জেসি
পদ ফিরে পেলেন বিএনপির বহিষ্কার হওয়া ৩৯ নেতা
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এনসিপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুগ্ম সমন্বয়কারী সৈয়দ ইমরান সাময়িক বহিষ্কার
নাইম-শহিদুলের ফিফটি
৫ লক্ষ টাকা জরিমানা ও ৩ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ
শেরপুরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জেলহাজতে
কিনব্রিজের ঐতিহাসিক ঘড়ির সামনে ট্রফি উন্মোচন
বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বর্ণাঢ্য র্যালি ও আলোচনা সভা
