জুলাই জাতীয় সনদ : নির্বাচনের পথে আর কোনো বাধা থাকবে না
১১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষরিত হবে। ঐতিহাসিক এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর দেয়া মতামত সমন্বয় করে কমিশন দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয়া হবে। ১৫ অক্টোবর এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে এবং ওই দিনই তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করবে। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর যাত্রা শুরু হয়। কমিশনের সহ-সভাপতি করা হয় ড. আলী রিয়াজকে। সদস্য হিসেবে রয়েছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং ড. মো. আইয়ুব মিয়া। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়। তবে সংবিধান সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হলেও সবক্ষেত্রে ঐকমত্য হয়নি। এজন্য কমিশন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নানা মত-দ্বিমত নিয়ে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ তৈরিতে প্রায় ৮ মাস সময় নিয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রিয়াজের ধীরগতি ও সময়ক্ষেপণের কারণে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে। সময়ক্ষেপণের মধ্যে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা দীর্ঘ সময় ধরে ভোগ করার প্রবণতা ছিল বলে তারা মনে করেন। এতে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের নামে নানা বাহানা ও দাবি-দাওয়া তুলে নির্বাচনকে প্রলম্বিত ও বিতর্কে নিক্ষেপ করার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া নানা ঘটনা ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য পতিত আওয়ামী লীগসহ নানা গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালানোর অবকাশ পেয়েছে। যদি ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সনদ তৈরির তাকিদ থাকত, তাহলে এত জটিলতা সৃষ্টি হতো না। কথায় আছে, শুভ কাজে বিলম্ব করা উচিৎ নয়। করলে জটিলতা তৈরি হয়। ঐকমত্য কমিশন তার কাজে অহেতুক বিলম্ব করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও দায়ী। কমিশনের সভাপতি হিসেব তিনিও যেন বিলম্বকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যেকোনো বিষয়েই মত-দ্বিমত, মতৈনক্য থাকতে পারে। শতভাগ একমত কেউই হয় না। এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শতভাগ মতৈক্যের জন্য বসে থাকলে, তা কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। মানব সৃষ্টির শুরুতেই এই মতদ্বৈততা ও মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ যখন ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করব। তখন ফেরেশতারা দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন, আপনি কি ঝগড়া-বিবাদ, রক্তপাত সৃষ্টি করবে এমন জাতি সৃষ্টি করবেন। মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমি যা জানি, তা তোমরা জান না। তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করলেন, প্রথম মানব আদমকে (আ.) সেজদাহ করতে। ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ মেনে নিলেও মাটির তৈরি আদমকে (আ.) আগুনের তৈরি ইবলিশ আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করে সেজদাহ করতে অস্বীকার করে। যেখানে মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে মত-দ্বিমত চলে আসছে এবং হযরত আদমও (আ.) বিয়ে নিয়ে তার দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন করে ঐকমত্য তৈরি করতে পারেননি, সেখানে বিতর্ক থাকবেই। তবে মত-দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ মানবজাতি সৃষ্টি বন্ধ করেননি। সেই মানবজাতির মধ্যে মতদ্বৈততা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়েছে, তাও থাকা স্বাভাবিক। মতভিন্নতা থাকাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে সকলের একমত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলে, কোনোদিনই ঐকমত্য তৈরি হবে না এবং গণতন্ত্রও এগুবে না। ড. আলী রিয়াজ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়ার মতো এক অসম্ভব আশা নিয়ে বসে থেকে সময়ক্ষেপণ করেছেন। এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেমন বিলম্বিত হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরা সুযোগ নিয়েছে। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার মধ্যেও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার খায়েশ জন্মেছে। তাদের কারো কারো মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তো বলেই ফেলেছেন, কোনো কোনো উপদেষ্টা আখের গুছিয়ে এখন ‘সেইফ এক্সিট’-এর পথ খুঁজছেন। তার এ বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতি করে এখন দেশ ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজছেন। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে কোনো কোনো উপদেষ্টা ও সচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে শুরু থেকেই ক্ষমতা উপভোগের প্রবণতা রয়েছে। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে ফেরানোর প্রতি তার অনীহা দেখা গেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে সরকারের একাংশ ্র জামায়াতে ইসলামী উভয়ে ভাগাভাগি করে ক্ষমতা উপভোগের এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। এজন্য নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, উভয়েরই তত লাভ। নির্বাচন হয়ে গেলে তাদের এই ক্ষমতা উপভোগেরও দিন শেষ হয়ে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেষ পর্যন্ত কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাস্তবতার আলোকেই তাঁকে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করার জন্য দৃঢ় অবস্থান নিতে হয়েছে। এটা আশার কথা। বলা বাহুল্য, যে কাজটি অল্প সময়ের মধ্যেই করা যেত, সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্য কমিশনের লাগাতার বৈঠকের কারণে দেরি হয়েছে। এতে যেমন সময় অপচয় হয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অথচ নেপালে যে গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল এবং সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই বলে দিয়েছে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমাদের দেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই অনির্দিষ্টকাল থাকার প্রবণতা দেখানো শুরু করে। সবচেয়ে বড় দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশকে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর কথা বলায় সরকারকে তার উপর অসন্তুষ্ট হতে দেখা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরে গিয়ে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেও ফেলেছেন, শুধু একটি দল নির্বাচন চায়। তবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার কারণে এবং বিএনপি ও তার সমমনা দল ও উন্নয়নসহযোগী দেশগুলোর দ্রুত নির্বাচনের তাকিদের কারণে সরকারকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে বাধ্য করে। দেশ এখন নির্বাচনমুখী। সকলেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হতে আর কোনো বাধা থাকবে না। মতপার্থক্য ও মতদ্বৈততা থাকা সত্ত্বেও সকল রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দেশকে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রায়গঞ্জে ফিস্টুলা রোগী সনাক্তকরণ সংক্রান্ত অ্যাডভোকেসি সভা অনুষ্ঠিত
ইসি’র সংলাপে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষের হট্টগোল
অষ্টগ্রামে সাংবাদিকদের ওপর ইউপি মেম্বারের হামলা, এলাকাজুড়ে তোলপাড়
পাকিস্তানে ফের যাত্রীবাহী ট্রেনে রকেট হামলা, বোমায় উড়ল রেললাইন
এ রায় একটি মাইলফলক : সালাহউদ্দিন আহমেদ
চাটমোহরে বিনাহালে রসুন চাষাবাদে ঝুঁকেছে কৃষক
কলাপাড়ায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ৫ জন হাসপাতালে
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও কামালের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
আসছে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ তৃতীয় কিস্তি! যা জানা গেল
পরিবেশ রক্ষায় পাটকেন্দ্রিক শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার ও উদ্ভাবন জরুরি : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সরকারপ্রধান যতই ক্ষমতাধর হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় : গোলাম পরওয়ার
৫ দফা দাবিতে ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানায় মানববন্ধন
সূর্য নয়, সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে অন্য এক শক্তি!
গণহত্যাকারী হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে: ছাত্রশিবির
আলোচনার দায়িত্বে বিএনপি’র ২ নেতা
ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফাঁসির রায়ে সন্তুষ্ট আবু সাঈদের পরিবার
অর্কেস্ট্রা পরিচালনায় ইতিহাস গড়লেন ইরানের প্রথম নারী ফারিউসেফি
বিচারকের ছেলে হত্যার প্রতিবাদে ইবির আইন অনুষদের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
পতিত স্বৈরাচার হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে টিএসসিতে উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ
ধামরাইয়ে বাসে আগুন