বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও শিক্ষকদের দায়

Daily Inqilab ড. মো. কামরুজ্জামান

১০ মার্চ ২০২৩, ০৭:৪৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৯ পিএম

প্রাচীন যুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার অবয়ব ও সুস্থ সংস্কৃতি দুটোই চালু ছিল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা থেকেই পৃথবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ফলে সেখানে ধর্মের উন্নত গবেষণা ও প্রয়োগ দুটোই চালু ছিল। ধর্মের সঠিক বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের কারণে শিক্ষক ও ছাত্রদের মাঝে উন্নত রুচিবোধের স্ফুরণ ঘটেছিল। তাদের মাঝে উন্নত রুচি ও সুস্থ সংস্কৃতির ধারা বিকশিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অতি নিষ্ঠুরভাবে ধর্মকে বিদায় করা হয়েছে।
আধুনিক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণা হলো বিশ^মানের পাঠদান ও গবেষণা করা। উৎকর্ষ, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে আলোকিত করা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হলো, পা-িত্য ও গবেষণা দ্বারা বিশ্ববাসীকে নিত্য নতুন জ্ঞান উপহার দেয়া। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সব ধরনের বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণ করা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৌলিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। ব্যাপকার্থে,বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন এক পরিবেশ, যেখানে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে মানুষ আগমন করবে। ব্যাপকভাবে সেখানে ভাবের আদান প্রদান ঘটবে। তাদের একে অপরের জ্ঞান ও মতের সঙ্গে মতান্তর সৃষ্টি হবে। আর এ মতান্তরের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে। এখানে অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীর যৌথ পা-িত্য মিলে আবিষ্কার হবে নতুন জ্ঞান। সৃষ্টি হবে নতুন গবেষণা।

সংক্ষেপে বর্ণিত এসব লক্ষ্য এটাই প্রমাণ করে যে, উন্নত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে দেয়ার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। নিজ দেশের মান ও গৌরব বৃদ্ধির অবিরাম সাধনার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। দিনের পর দিন নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় থাকার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। জগৎবিখ্যাত নতুন ফর্মুলা তৈরির নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং বলা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি দেশের জন্য নয়, বিশ্বসমাজের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বর্তমানে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লেখিত লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে ছিটকে পড়েছে। এসব লক্ষ্য থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অবস্থান করছে যোজন যোজন দূরে। বিপরীতমুখী স্রোতের অনুকূলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একেবারে হয় না বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রাজনৈতিক পরিচয়েই তার পদ অলংকৃত করে থাকেন। ফলে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সময় কিছু শিক্ষকের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এ পদে নিয়োগ পেতে একজন উপাচার্যকে সর্বপ্রথম দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। ফলে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি আর নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করতে পারেন না। বাকি সময়টা তাকে সরকারের পদলেহন করেই চলা লাগে।

শুধু উপাচার্য নিয়োগই নয়, বিশ^বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পোস্ট-পদবী পেতেও যোগ্যতা হিসেবে দলীয় অন্ধত্বকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ইত্যাদি পদে নিয়োগ পেতে একমাত্র যোগ্যতা হলো ক্ষমতাসীন দলের অন্ধকর্মী হওয়া। ভালো শিক্ষক হবার একমাত্র গুণাবলী হলো রাজনৈতিকভাবে পেশী শক্তির অধিকারী হওয়া। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ, স্বার্থ ও ক্ষমতা। সম্মানিত অধ্যাপকগণ শিক্ষা ও গবেষণা বাদ দিয়ে এসব পদ পেতে ব্যস্ত সময় পার করেন সর্বক্ষণ। অথচ, একজন অধ্যাপকের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের ক্লাস গ্রহণের মাধ্যমে মোটিভেশনাল কার্যক্রমে মনোযোগী হওয়া। তাদের দায়িত্ব ছিল শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দেয়া। কিন্তু এ দায়িত্ব বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকগণ বর্তমানে বিভিন্ন দলীয় বৃত্তে বন্দি হয়ে আছেন। দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, উপাচার্য হতে বাংলাদেশের অনেক অধ্যাপক মন্ত্রী, আমলা ও এমপিদের তোয়াজ করে বেড়ান! এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে আসতে পারেনি।

রাজনৈতিক এ দুর্বৃত্তায়নের কারণে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংস্কৃতি চর্চার চেয়ে, বিকৃতি চর্চার পরিমাণই বেশি। এ বিকৃতির চরম দুঃখজনক নিদর্শন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন। এ নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী নীরবে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়! অনেক শিক্ষার্থী মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে! এমনকি এ নির্যাতন অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়! এর জ¦লন্ত সাক্ষী হলো বুয়েটের আবরার হত্যাকা-। বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফরহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। সম্প্রতি ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে ফুলপরী নির্যাতনের ঘটনাটি টপ অব দা কান্ট্রি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলে প্রথমবর্ষের ঐ ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের শিকার ঐ ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। ঘটনা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের দু’জন বিচারপতি অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিস্কারের নির্দেশ দেন। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে আদালত হল প্রভোস্টকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া আদালতের প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুঈদ রহমানের একটি লেখা দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত লেখাটির সাথে আমি সম্পূর্ণভাবে ঐক্যমত পোষণ করছি। পাঠকগণের উদ্দেশ্যে লেখাটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: ‘আমি উল্লিখিত ঘটনার বাদী-বিবাদীর বাইরে যে বিষয়টির ওপর প্রশ্ন রাখতে চাই তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটার মতো বাস্তব পরিস্থিতি আছে কিনা? জবাবে বলতে হয়, আছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখ- নয়। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ বিশ্ববিদ্যালয়কেও প্রভাবিত করতে বাধ্য। যে কোনো সরকারের আমলেই সরকারসমর্থিত ছাত্রসংগঠনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তারা সরাসরি মূল দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রভোস্ট, ছাত্র-উপদেষ্টা, এমনকি সরাসরি শিক্ষকের নীতিবাক্যকে আমলে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। রাজনীতির বাইরে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অভিভাবক হিসেবে গুরুত্ব দেয়। আমি বর্তমান সময়ের কথা বলছি। ছাত্ররাজনীতির এ সংস্কৃতি আজকে সৃষ্টি হয়নি, এর শুরু ১৯৯১ সাল থেকে। অন্ধ আনুগত্য আর মূল সংগঠনের আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে ছাত্ররাজনীতি। যতই দিন যাচ্ছে, তা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতার ফল ভোগ করছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এটি অনাকাক্সিক্ষত হলেও আকস্মিক কিছু নয়’। (দৈনিক যুগান্তর, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)। দেশের প্রত্যেকটি বিশ^বিদ্যালয়েই এ জাতীয় ঘটনা অহরহ ঘটছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলোকে দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারি না। দলীয় অন্ধত্ব তাদের যেন মানসিক বৈকল্যে পরিণত করে ফেলেছে। ফলে তারা সত্যকে সত্য বলতে ভয় পায়। আর মিথ্যাকেও মিথ্যা বলতে তারা সৎ সাহস রাখে না।।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উন্নত রুচি-সংস্কৃতি চর্চার বদলে এরকম বিকৃতি নিয়ে গড়ে উঠছে কেন? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের সমাজ একটি বৈষম্যমূলক সমাজ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও বৈষম্যমূলক। আর বৈষম্যমূলক অর্থনীতি আধিপত্যবাদের জন্ম দেয়। বৈষম্য মানে হলো সমাজের এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর উপর কর্তৃত্ববাদী হওয়া। আর এ কর্তৃত্ববাদ শারীরিক ও মানসিক দুই ক্ষেত্রেই হতে পারে। আবার সমাজ অভ্যন্তরে একই শ্রেণীর মধ্যেও শক্তির তারতম্যের ভিত্তিতে আধিপত্য তৈরির চেষ্টা চলে। আমাদের দেশ ও সমাজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি। পুঁজিবাদ একটি শোষণমূলক অর্থনৈতিক হাতিয়ার। এটি জোর-জবরদস্তির শাসন। মুষ্টিমেয় মানুষ কর্তৃক বেশিরভাগ মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিধান হলো এ পুঁজিবাদ। এখানে প্রতিমূহুর্তে আধিপত্য-দমন-পীড়নের পরিবেশ তৈরি হয়েই থাকে। কিন্তু তারপরও বেশিরভাগ মানুষ ব্যবস্থাটিকে পাল্টাতে পারে না। কারণ, এ ব্যবস্থায় শোষকের আধিপত্যের সংস্কৃতি ছড়িয়ে আছে সমাজের স্তরে স্তরে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন মনোভাব হর-হামেশাই দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত দুর্বলের উপর কর্তৃত্ববাদের প্রয়োগের চেষ্টা চলে সর্বক্ষণ। ফলে অর্থ আর পেশীশক্তির কাছে অন্য সবকিছু দাসত্বের শিকলে বন্দি হয়ে পড়ে। তাই অন্যায় আধিপত্য দেখলেও বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ মুখ বুঝে সহ্য করে। এ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের শক্তিটা সাধারণত দুর্বলই হয়ে থাকে। একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদেরকে আগে নিজেরটা দেখার কথা বলে। নিজের স্বার্থটাই এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড়ো করে দেখে। এ ব্যবস্থার স্লোগান হচ্ছে, ‘খাও দাও ফুর্তি করো’। এটি একটি স্বার্থান্বাষী ও ভোগবাদী স্লোগানের বাস্তব উদাহরণ। একদম উপর থেকে নিচ পর্যন্ত এই ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আধিপাত্যবাদ থেকে মুক্ত হতে দু দুবার রক্ত ঝরিয়েছে। অধিপাত্যবাদীদেরকে বিতাড়িত করতে ৩০ লাখ মুক্তিকামী মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে। ২ লাখ মা বোন সতিত্ব বিসর্জন দিয়েছে। স্বাধীনতা আজ ৫২ বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের শাসকদের মগজ থেকে আধিপত্যবাদ দূর হয়নি। দূরতো হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাসকগণ পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে দিয়েছে। আমাদের সমাজ আজ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত। নিজ দলের মধ্যেও আধিপত্যবাদী মনোভাব স্পষ্ঠ। সমাজ অভ্যন্তরে বয়ে চলা এই মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে, সেখানে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিরাজ করছে আধিপত্য, ক্ষমতাবাজি আর ভোগের সংস্কৃতি। জ্ঞানচর্চার জন্য যে ন্যূনতম সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রয়োজন তার ছিটেফোঁটাও আজ সেখানে নেই। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও ব্যক্তি স্বার্থে আমরা ধান্ধাবাজ। সামগ্রিক এই বাস্তবতার সাথে র‌্যাগিং নামের অপসংস্কৃতি যুক্ত।

বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের একটি বড়ো জায়গা হওয়ায় এখানে রয়েছে জমজমাট বিজনেসের সুযোগ। আর এ বিজনেসের সাথে প্রত্যক্ষভাকে যুক্ত থাকে ক্ষমতাসীনরাই। ক্ষমতা দেখিয়ে আয় উপার্জনের প্রবণতা দেশের অর্থনীতির পুরাতন এক প্রধান বিষয়। সুতরাং তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আর সরকার তাদেরকেই পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে, সেটাও খুব বিস্ময়কর নয়। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় সকলেই একটি ম্যাচিউরড চিন্তাধারা লালন করে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোও তাই শিক্ষিত এবং মেধাবী হয়ে থাকে। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় শাসন-শোষণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তোলার আয়োজন করা হয় যেন তাদের মধ্যে সুপ্ত ন্যায়-নীতিবোধ জেগে উঠতে না পারে। আর এভাবে তাদের মধ্য হতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার ন্যূনতম বোধগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এ কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ মাদক-পর্নোগ্রাফির অভয়ারণ্য। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। বন্ধু হয়েও বন্ধুর গলায় ছুরি চালানো, গুলি করা, পিটিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস-হিংসাত্মক ঘটনাগুলোও ঘটছে।

লুটপাটের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এমন উগ্র-ভোগবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশই শাসকদের প্রয়োজন। রাষ্ট্র যখন ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে, তখন তার সবচেয়ে বড় ভয় থাকে শোষিত-নির্যাতিত মানুষের সংগঠিত অবস্থান। তাই মানুষকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন করে, ভোগবাদিতায় আচ্ছন্ন রাখতে পারলে শাসনকাল দীর্ঘ করা সম্ভব হয়। শাসকদের সবচেয়ে বেশি ভয় থাকে সমাজের শিক্ষিত মানুষদের ব্যাপারে। কেননা, তারাই প্রথমে মিথ্যাগুলো ধরতে পারে। তাই তাদের উপর আক্রমণটাও থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন কোনো উদ্যোগ দেখতে পাবো না যাতে একজন শিক্ষার্থী নৈতিক ও সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। সবক্ষেত্রেই শুধু ভোগবিলাস আর গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দেয়ার আয়োজন। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির চর্চা হয় না, বরং প্রশাসনের মদদে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এমন সব আয়োজন থাকে, যা অনেক ক্ষেত্রেই যৌন উদ্দীপক। উন্নত রুচি-সংস্কৃতির আধারে নয় বরং শেখানো হচ্ছে ‘যেভাবেই হোক ভোগ করো’।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইরূপ পরিবেশ দেখে কতিপয় নিরীহ শিক্ষক নির্লিপ্ত ও উদাসীন থেকে কোনোরকমে বাঁচার পথ খুঁজছেন। অনেকে উপায়হীন হয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন। চারিদিকে যেন এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস, আতঙ্ক, জবরদস্তি ও স্বেচ্ছাচারিতা এই সংস্কৃতির উপাদান। যারা আধিপত্য চালাচ্ছে, তারা দুর্বলের উপর সমাজে বিকৃত আকাক্সক্ষাগুলো চরিতার্থ করছে। যারা অত্যাচারিত হচ্ছে তারা আরও ন্যূজ হয়ে অন্ধকারে মুখ লুকাচ্ছে। একদিকে নানা আধিপত্যকামী কর্মকা-, অন্যদিকে মানুষের চূড়ান্ত নিস্পৃহতা-নির্লিপ্ততা! এ দুটোই সুকোমল বৃত্তিগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে জন্ম নিচ্ছে নানা বিকৃতির। এ যেন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া!

এই হতাশাজনক পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় জরুরি। এক্ষেত্রে অল্প হলেও আমাদের সামনে কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ফুলপরীর ভূমিকা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার। নিপীড়িত শিক্ষার্থীর পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবীর ভূমিকাও প্রশংসার যোগ্য। পাশাপাশি বিজ্ঞ আদালতকেও শ্রদ্ধা জানাই দ্রুততার সাথে ভুক্তভোগীর নালিশ আমলে নিয়ে তাকে নিরাপত্তার নির্দেশ দেয়ার জন্য। দীর্ঘ আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিশ^বিদ্যালয় একটি উন্নত গবেষণার জায়গা। কিন্তু নষ্ট রাজনীতি আজ সে জায়গার পরিবেশকে নষ্ট করে তুলেছে। অবশ্য এ অবস্থা একদিনেই সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে এটা জন্ম নিয়েছে। আজ তা মহিরুহ আকার ধারণ করেছে। সকল পক্ষের জন্য সেটা গলার কাঁটা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সম্মানিত শিক্ষকগণ প্রত্যক্ষভাবে দায়ী না হলেও পরোক্ষভাবে এর দায় এড়াতে পারেন না।

লেখক: অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিবাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি
হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে
গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ
সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?
ট্রেন বিলম্বে যাত্রীদের দুর্ভোগ
আরও

আরও পড়ুন

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে  রুখে দিতে হবে

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে রুখে দিতে হবে

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

টাকার বিছানায় ঘুম

টাকার বিছানায় ঘুম

চশমার যাদুঘর

চশমার যাদুঘর

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

গ্রেফতার সেই কুমির

গ্রেফতার সেই কুমির

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?