ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও প্রশাসনের সর্বত্র এখনো তার দোসর ও সুবিধাভোগীরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তারা রং ও রূপ পাল্টে কৌশলে সরকারের কার্যক্রমকে স্থবির, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত করে তুলছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনও (বিটিভি) এর বাইরে নয়। বিটিভি আছে সেই আগের মতোই। পরিবর্তনের তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি। মহাপরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজার পরিবর্তন হলেও শেখ হাসিনার স্তুতি গাওয়া দুর্নীতিবাজ দোসররা বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। তারা শুরুতে বিএনপি সমর্থক সেজেছিল। এখন জামায়াত সমর্থক সেজেছে। এসব দুর্নীতিবাজ শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বিটিভির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বিটিভিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আদেশ-নির্দেশও যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে না। কোনো অফিস আদেশ এলে তা বাস্তবায়নে বিটিভি কর্তৃপক্ষ করব-করছি বলে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছে। ফলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাদের টিকিটি ধরা যাচ্ছে না। বিটিভির একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, দুর্নীতির অভিযোগ উঠা এবং আওয়ামী শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও তোষণকারি এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে, বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের উপ-মহাপরিচালক ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদ (বার্তা ও অনুষ্ঠান), জেনারেল ম্যানেজারের চলতি দায়িত্ব পালনকারি মাহফুজা আক্তার (বর্তমানে সাতক্ষীরা বিটিভি উপকেন্দ্রে কর্মরত), প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ মোল্লা আবু তৌহিদ, অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) মো. আতাউর রহমান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (চলতি দায়িত্ব) ও ছাত্রলীগের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক সাহরিয়অর মোহাম্মদ হাসান, নিয়ন্ত্রক (ডিজাইন) মো. সেলিম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ মনিরুল হাসান (ছাত্রলীগের সাবেক গবেষণা সম্পাদক), প্রকৌশল ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) মো. মান্নাফ হোসেন, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. আক্তার হোসেন, নিয়ন্ত্রক (প্রকৌশল) মো. আরিফুল হাসান, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) অফিফা আফরোজ এবং ঊর্ধ্বতন বাদ্যযন্ত্রী মো. সুমন রেজা খান। অভিযোগ রয়েছে, বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এই সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষক। আওয়ামী লীগের শাসনামলে কোনঠাসা ও বঞ্চিত থাকা ভিন্নমতের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারির সাথে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আলাপকালে তারা উল্লেখিত সিন্ডিকেটের নানা অপকর্ম, দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের এসব অপকর্মের নির্ভরযোগ্য তথ্য এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ের পর সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা ছিল ‘বাপ-বেটির বাক্সে’ পরিণত হওয়া বিটিভির খোলনলচে বদলে আমূল পরিবর্তন আসবে। তার দোসরদের তাৎক্ষণিকভাবে বিদায় করা হবে। দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস হয়ে গেলেও তারা বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। যতই সময় গেছে, তারা আরো সংগঠিত হয়েছে। এমনকি, হাসিনার পতনের পর যোগদান করা বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার নুরুল আলম পবনও দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারি ওই সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি তাদের প্রশ্রয় ও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে চলছেন। অভিযোগ উঠেছে, বিটিভির পর্দায় আগে যেখানে ফিলারের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার অপকর্ম তুলে ধরা হতো, এখন কৌশলে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যাতে দেশের মানুষ জানতে না পারে। কেবল জুলাই বিপ্লবের ফিলার চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিটিভির অন্যতম দায়িত্বই হচ্ছে, হাসিনার খুন-গুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, দুর্নীতিসহ তার ষোল বছরের ফ্যাসিজমের চিত্র তুলে ধরা। অন্যদিকে, বিটিভির নাটক থেকে শুরু করে প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ফ্যাসিবাদের দোসর শিল্পীদের কৌশলে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে বলে বিটিভি সূত্রে জানা যায়। বিটিভির তালিকাভুক্ত যেসব অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী ও কলাকুশলীকে বিগত ষোল বছর বিটিভির ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি, তাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এদিকে বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ উল্লেখিত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ উত্থাপন করে তাদের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিভির মহাপরিচালক এবং টেলিকমিউনিকেশন, বিজ্ঞান, তথ্য, প্রযুক্তি বিষয়ক অডিট ডিরেক্টরেট-এর মহাপরিচালক বরাবর আইনি নোটিশ প্রেরণ করেন। এ নোটিশ পাঠানো হয় বাংলাদেশ সংস্কৃতি এবং শিল্প অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ জসিম উদ্দিন কবির ও সদস্য সচিব পলাশ কুমার শ-এর পক্ষ থেকে। আইনি নোটিশে ২০০৯ থেকে ২০০২৪ সাল পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তের দাবি জানিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। নোটিশে সিন্ডিকেটের প্রায় প্রত্যেক সদস্য কীভাবে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট করেছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বিনোদন প্রতিদিনের অনুসন্ধানেও তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তথ্য বিটিভির বিভিন্ন সূত্র মারফত উঠে এসেছে। সিন্ডিকেট সদস্যদের সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কী করে তারা বিটিভিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে, তা নিয়ে ফ্যাসিবিরোধী বিটিভির কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা প্রশ্ন তুলেছেন। বিটিভি থেকে এদের দ্রুত বিতাড়িত করা না গেলে, এটি ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাদের কবলে থেকে যাবে এবং সুকৌশলে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন করবে বলে তারা মনে করছেন। এখন দেখার বিষয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বিটিভি কর্তৃপক্ষ ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়।