সিয়াম সাধনা ও সুস্বাস্থ্য
০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম

মুসলমানদের পাঁচটি ধর্মীয় ভিত্তির মধ্যে রোজা বা সিয়াম অন্যতম। ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মাসে রোজা রেখে, ইবাদত বন্দেগি করে, তারাবির নামাজ পড়ে পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত কামনা করেন।এ মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ রজনী হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুল কদর, যে রাতে পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছে। সুতরাং এ মাসের পরিপূর্ণ সিয়াম সাধানার জন্য সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
রোজা রাখলে আমাদের শরীরে শক্তির প্রয়োজনে অতিরিক্ত চর্বি ভাঙতে থাকে। এজন্য রমজানে প্রত্যেকটি মুসলমানের উচিত কিভাবে স্বাস্থ্য ঠিক রেখে রোজা পালন করা যায় সে দিকে গুরুত্ব দেওয়া।
রোজা পালনের জন্য এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য যা করা প্রয়োজন-
* রোজায় এ বছর প্রায় ১৪ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হবে। এ জন্য ইফতার, ইফতার পরবর্তী আহার এবং সেহরির খাবার সুষম এবং উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বঞ্ছিত হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে নির্ধারণ করে খাবারের ছক তৈরি করতে হবে।
* যেসব খাবার সহজে হজম হয় সেগুলো গ্রহণ করা ভালো।
* বেশি ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।
* ফাস্টফুড, জাংকফুড, চিপস, পিজ্জা, রঙিন পানীয় পরিহার করা ভালো।
* প্রচুর পরিমাণে পানীয়, তাজা ফলের রস এবং লেবুর শরবত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
* লাল মাছ মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ মাংস গ্রহণ না করা ভালো।
* মদ্যপান, ধূমপান, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ পরিত্যাজ্য।
* যাদের গা খুব বেশি ঘামে তাদের ওরাল স্যালাইন বা ডাবের পানি খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
রোজার সময় যেসব রোগবালাই হতে পারে Ñ
* রোজার প্রাক্কালের সবচেয়ে প্রথম যে সমস্যা তৈরি হয় তা হল ঘুম না হওয়া, বা কম হওয়া বা অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া। সাধারণত সেহরি খাওয়ার কারণে প্রথমদিকে স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। এটা সাময়িক একটা সমস্যা এবং পর পর কয়েকদিন রোজা রাখলে এটা শরীরে ধাতস্থ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধও খাওয়া যেতে পারে।
* ইফতারির সময় বেশি ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, রঙিন খাবার গ্রহণের ফলে বুক জ্বালপোড়া করা, অম্ল ঢেঁকুর ওঠা বা এসিডিটি পেটে ব্যথা হতে পারে। যাদের আগে থেকে পেপটিক আলসার ডিজিজ আছে তাদের এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শম মতো আপনার জন্য উপযুক্ত ওষুধ ইফতার, ইফতার পরবর্তী খাবার বা সেহরির মাঝখানে গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার যা আপনাকে কষ্ট দেয় তা বাদ দিতে হবে।
* রোজার প্রথমদিকে আরেকটি প্রধান অসুবিধা হল কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনসস্টিপেশন। এটা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় যাদের তামাক, সিগারেটজাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে এবং যারা পানি, শাকসবজি, ফল ও ফলের রস কম গ্রহণ করে থাকে। তাই এসব ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, তাজা ফলমূল খেলে এবং প্রচুর পানি এবং তরল খাবার গ্রহণ করলে এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
* কোনো কোনো রোজাদারদের বদহজম পাতলা পায়খানা ও আমাশয় হতে পারে। এগুলো সাধারণত অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পানি, ফলের রস এবং খাবারের কারণে হয়ে থাকে। এসব খাবার ও পানীয় আক্রান্ত ব্যক্তির হাত থেকে খাবারে সংক্রমিত হয়। এজন্য ইফতারি ও অন্যান্য খাবার ও পানীয় কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পরই এগুলো ক্রয় করে গ্রহণ করতে হবে। বেশি পরিমাণে ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি বা বদহজম হলে ডাক্তারের পরামর্শমতো ওরাল স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ খাবেন।
* রোজাদারের কোনো কোনো সময় তীব্র গরম এবং ঘামের কারণে অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পরে। এর সঙ্গে হিট স্ট্রোক হয়ে রোগী মূর্ছা যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গায়ে চুলকানি, র্যাশ ইত্যাদিও হতে পারে। কোনো কোনো রোজাদারের ক্ষেত্রে মাংসপেশির ক্র্যাম্পও হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে ঠান্ডা কোনো জায়গায় শুয়ে বিশ্রাম করাতে হবে, প্রচুর পরিমাণ খাবার স্যালাইন খেতে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে।
* ডায়েবেটিসের রোগীরা কী রোজা রাখতে পারবে-ডায়াবেটিস একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সীমিত খাবার গ্রহণ, মুখে খাবার ডায়াবেটিস বড়ি এবং ইনসুলিন সময়মতো গ্রহণ করা এবং শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম বেশি করা, মিষ্টি, শর্করা এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ বা পরিহার করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কাজেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখার ব্যাপারে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইনসুলিনের ডোজ বা মাত্রা রোজার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো নির্ধারণ করে নিতে হবে। প্রয়োজনে ইফতারির সময়, সেহরির সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ নির্ণয় করে ওষুধ অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর জটিলতা বা কম্পিøকেশন আছে যেমন হার্টের অসুখ, কিডনি ফেইলুর তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো এবং রোগের ধরন ও গভীরতা থেকে নির্ধারণ করতে হবে যে সে রোজা রাখতে পারবে কিনা।
* হার্টের সমস্যা ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রনে না থাকলে রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের জেনে রাখা ভালো হার্টের যে কোন রোগ হলেই রোজা রাখা যাবে না এমনটি ধারণা করা সম্পূর্ণ ভূল। নিউইয়র্ক হার্ট এ্যাসোসিয়েশন এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে করোনারি আর্টারি ডিজিজে রোজা রাখলে রোগীদের কোন সমস্যাই হয় না। সেখানে বলা হয়েছে ৮৬% রোগীর সারা মাস রোজা রাখার ফলে কোন সমস্যাই হয়নি। হাইপারটেনশন, এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন, ভালভিউলার ডিজিজ, এনজাইনা পেকটোরিস, হার্ট ব্লক রোগীদের ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন ২৮৮ জন রোগী এসব রোগ নিয়ে রোজা রেখেও উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যায় পড়েন নি।
* বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মাদের ক্ষেত্রে রোজা অনেকেই ভাবেন বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় রোজা রাখা যাবে না কারণ দুধ শুকিয়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। তবে স্তনদানকারী মাকে অবশ্যই প্রচুর তরল খাবার ও সহজে হজম হয় এমন খাবার প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।
* রিওমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীরাও চিন্তামুক্ত হয়ে রোজা রাখতে পারেন। কারণ সম্প্রতি ইরানিয়ান একটি রিসার্চে বের হয়েছে ৪৬-৫০ বছরের আর্থ্রাইটিসের রোগীরা রোজা রাখলে ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি লাভ করে। রিসার্চে বলা হয়েছে ৫৭.২% রোগীরা একটু সতর্কতার সহিত তারাবির সালাত আদায় করলে ও ডায়েটের দিকে গুরুত্ব দিলে সহজেই রোজা পালন করতে পারেন।
* স্ট্রেস, ডিপ্রেসন, এ্যানজাইটি রিলিভার সম্প্রতি ইরানিয়ান ও সুইডিস গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন ২৯-৩০ দিনের রোজা এবং প্রতিমাসে ২-৩টি রোজা পালন করলে স্ট্রেস, ডিপ্রেসন, এ্যানজাইটি অনেকাংশে কমে যায়।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যে কোনো সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ও পুরুষ এবং পেপটিক আলসার ডিজিজ, ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখায় কোনো নিষেধ নেই। শুধু সঠিক এবং সুষম খাবার গ্রহণ, প্রচুর পানীয় এবং শাক সবজি গ্রহণ করে অসুখটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, ফাস্টফুট, জাংকফুড কম খাওয়া, তামাক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করে যে কেউই রোজা রাখতে সক্ষম। তবে খুব বেশি অসুস্থ, গর্ভবতী মা ও খুবই ছোট বাচ্চার দুগ্ধ প্রদানকারী মা, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, মানসিক রোগী এদের রোজা না রাখাই ভালো।
মহান আল্লাহ রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন তার বান্দাদের কল্যাণের জন্য। সারাদিন না খেয়ে থাকার নামই রোজা নয়। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “নিশ্চয়ই নিয়মানুবর্তিতার সহিত তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে।” সুতরাং নিয়ম শৃঙ্খলার সহিত রোজা পালনই এর মূল ভিত্তি। তথাপি বর্তমানে নিয়ম মানার পরেও অনেকেই বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্্রান্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকেই আবার রোগ নিয়ে কিভাবে রোজা রাখবেন সেই চিন্তায় আছেন।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সুস্থ অবস্থায় রোজা রাখার তৌফিক দান করুন, আমিন।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চেম্বার :-ন্যাশনাল হোমিও রিসার্চ সেন্টার
অলংকার শপিং কমপ্লেক্স চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: [email protected]
মোবাইল: ০১৮২২৮৬৯৩৮৯
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

অন্ধত্ব রুখতে পারেনি আরশাদ আলীকে করেন সংসারের সব কাজ

দুইশ’র আগেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত বৃষ্টি বরিশালের জনজীবনে স্বস্তি দিলেও মাঠে থাকা ফসল অতিবর্ষণের ঝুকিতে

নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী তারিনের ফ্ল্যাট ক্রোক

মার্কিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে বিশ্ব?

বরিশালে ফয়জুল করিমকে মেয়র ঘোঘনার দাবিতে আদালতের সামনে অবস্থান কর্মসূচী

গণহত্যার বিচার-সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন হবে অতীতের মতো পাতানো : ড. মাসুদ

মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম

ভাঙ্গা থেকে অনলাইন প্রতারক চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী অঙ্গসংগঠনের ১০ জন গ্রেফতার

একমাত্র ঘরটি ভেঙে দিলে আমি যাবো কোথায়--প্রতিবন্ধী নজরুল

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত

প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মোহাম্মদ সুফিউর রহমান

বেরসিক চোর !

মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট ও অগ্নিসংযোগকারী এখন মুক্তিযোদ্ধা : মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ

নসরুল হামিদের ৪ অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট ক্রোক ও ৩ গাড়ি জব্দের নির্দেশ

রাবি প্রেসক্লাবে মাহিন-মিশন নেতৃত্বে নতুন যুগের সূচনা

বিগত নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবি এনসিপির

ফ্যাসিবাদ পতনের পরও বদলায়নি পুলিশ একাডেমির চিত্র: নিয়োগে আওয়ামীপন্থী আধিপত্য, ক্ষুব্ধ অন্য শিক্ষকরা

বাংলার কণ্ঠে বিশ্ব মুগ্ধ: আমেরিকায় রয়া চৌধুরীর অনন্য সম্মাননা