জামায়াত নেতার গীতা পাঠ ও ধর্ম উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন
১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
গত ১৩ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা শেষ হলো। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে পাহারা বসিয়েছিল ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন। এমনি একটি পূজামণ্ডপ হলো ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার বাজেবামনদাহ হরিতলা পালপাড়ায়। ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুর্গাপূজার সপ্তমীর রাত ১০টার দিকে উক্ত পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে যান কোটচাঁদপুর উপজেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের অনেকেই সেখানে বক্তব্য পেশ করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জীবননগর কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মতিয়ার রহমান, যিনি এলাকায় অধ্যাপক মতিয়ার রহমান নামে পরিচিত। তিনি জামায়াতে ইসলামী ঝিনাইদহ জেলা শাখার নায়েবে আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সম্ভ্রান্ত একজন মানুষ। সাংগঠনিকভাবে এলাকায় তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে আমার সাথে তার যথেষ্ট সখ্য আছে। এলাকায় একজন সুবক্তা হিসেবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইসলামী শরিয়াহর ব্যাপারে তার যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। তিনি একজন দক্ষ একাডেমিসিয়ান। ওয়াজ মাহফিল, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে তিনি ভালো বক্তব্য রাখেন। ২০১০ সালের পূর্ববর্তী সময়ে একই মঞ্চে তার সাথে বহুবার বিভিন্ন জায়গায় আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য রাখেন। বিভিন্ন ধর্মে মহানবী (সা.) শিরোনামে তার একটা লিখিত বইও আছে। সব মিলিয়ে তিনি একজন সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় একজন মানুষ। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে পূজামণ্ডপে গিয়ে গীতা পাঠ করা নিয়ে। উক্ত পূজামণ্ডপে প্রধান অতিথির বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি গীতা পাঠ করেন। এ সময় সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা উলুধ্বনি দেন ও শঙ্খ বাজান। শুধু তাই নয়, প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই কোটচাঁদপুরে আলো, বাতাস, মাটি, মায়া ও মমতায় বেড়ে উঠেছি। ইসলামী আদর্শের একজন ব্যক্তি হলেও আমার ভেতর একজন ভালো সনাতনী হিন্দু ব্রাহ্মণ, একজন ভালো খ্রিষ্টান এবং একজন ভালো মুসলিমও আছেন।’
তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, হিন্দু ধর্মের আবির্ভাব মুসলমানদের কোরআন পাওয়ার প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বছর পূর্বে হয়েছে। এই জাতিটি ভারতের কালীকোটের মালমল সিন্দুর হ্রদের অববাহিকায় বাস করতো। আড়াই হাজার বছর তারা সেখানে ছিল।’ এটাই ছিল তার বক্তব্য। তার এই বক্তব্যে গোটা বাংলাদেশে হইচই পড়ে যায়। পাঁচ মিনিটের এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ঝড় উঠে। এতে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আলেমদের পক্ষ থেকে ফতোয়া আসে। খোদ জামায়াতে ইসলামীতে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জনগণের মাঝে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে যে ইমেজ সৃষ্টি হয়েছিল সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো কোনো সাধারণ মানুষতো বলেই ফেলেন যে, জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আর দেয়া হবে না, দেবো না। মূলত তিনি হিন্দু ভাইদের ভোট পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এই কাজটি করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন, তার যে হিন্দু ধর্মে পাণ্ডিত্য আছে সেটা জাহির করতেই আবেগে গীতা পাঠ করে বসেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, গীতাতেও যে মহানবীর আগমনের কথা উল্লেখ আছে সেটা প্রমাণ করতে তিনি মন্ত্র পাঠ করেছেন। যাহোক, তিনি যে উদ্দেশ্যেই এটা করুন না কেনো, এটি একটি বেঠিক কাজ হিসেবেই সমাজে বিবেচিত হচ্ছে। অবশ্য অনেকে তাকে সেভ করতে তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার ইমেজ রক্ষা করতে তৎপর হয়ে পড়েছেন। অনেকে তার পাঠকৃত গীতা অংশের বাংলা ভাবার্থ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, অধ্যাপক মতিয়ার রহমান মূলত জাকির নায়েক লিখিত ‘বেদ পুরাণে আল্লাহ ও নবী (সা.)’ বই থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃতি করেছেন মাত্র। গীতা থেকে তার পাঠকৃত অংশ হলো: ‘অস্য ইল্লালে মিত্রাবরুণোরাজা তস্মাৎতানি দিব্যানি পুনস্তং দুধ্য হবয়ামি মিলং কবর ইল্লাল্লাং অল্লোরহসূল মহমদ রকং বরস্য অল্লো অল্লাম ইল্লাল্লোতে ইল্লল্ল’। (৯ অথর্ববেদীয় উপনিষদ)
‘এতস্মিন্নন্তিরে ম্লেচ্ছ আচার্যেন সমন্বিতঃ
মহামদ ইতিখ্যাতঃ শিষ্যশাখা সমন্বিতঃ (৫)
নৃপশ্চৈব মহাদেবং মরুস্থল নিবাসিনম্।
চন্দনাদিভিরভ্য্য তুষ্টাব মনসা হরম্ (৬)
নমস্তে গিরিজানাথ মরুস্থল নিবাসিনে।
ত্রিপুরাসুরনাশায় বহুমায়া প্রবর্তিনে (৭)
স্নেচ্ছৈগপ্তায় শ্রদ্ধায় সচ্চিদানন্দরূপিণে।
তুং মাং হি কিংকরং বিদ্ধি শরণার্থমুপাগতম্’ (৮)
ভবিষ্য পুরাণ: ৩:৩:৩-৫-৮ শ্লোক।
তিনি উল্লেখিত শ্লোকগুলো পাঠ করেছেন। যার বাংলা ভাবার্থ হলো: যথাসময়ে ‘মহামদ’ নামে জনৈক মহাপুরুষ আবির্ভূত হবেন। যাঁর নিবাস হবে ‘মরুস্থল’ (আরব দেশে)। সঙ্গে স্বীয় সহচরবৃন্দও থাকবেন। হে মরুর প্রভু! হে জগতগুরু! আপনার প্রতি আমাদের স্তুতিবাদ। আপনি জগতের সমুদয় কলুষাদি ধ্বংসের উপায় অবগত আছেন। আপনাকে প্রণতি জানাই। হে মহাত্মা। আমরা আপনার দাসানুদাস। আমাদেরকে আপনার পদমূলে আশ্রয় প্রদান করুন।’ তিনি আরো পাঠ করেন, ‘অল্লো মহমদকং বরস্য’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (সা.)-কেই সবাই অনুকরণীয় হিসেবে গ্রহণ করো।’
এবার ধর্ম উপদেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। তিনি দুর্গাপূজা উপলক্ষে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে গমন করেছিলেন। এরপর তিনি গুলশান বনানীতে সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত পূজা মণ্ডপে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেছেন এবং বক্তব্য দিয়েছেন। হিন্দুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, আমরা একই পরিবারের সন্তান। তারপরে তিনি আরও একটি কথা বলেছেন যে, ‘আমাদের দুর্গাপূজা’। এরপর হিন্দু সম্প্রদায় তার গলায় তাদের ধর্মীয় নিদর্শন উথুলি (মূর্তি খচিত কাপড়) পরিয়ে দিয়েছেন এবং সেই কাপড়টি পরে তিনি অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং এই পরিধান করাটাকে তিনি কোনো দোষনীয় মনে করেননি, বরং বৈধতা দিয়েছেন। তার এসব কথা ও কাজের কড়া প্রতিবাদ করেছেন ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। আব্বাসী বলেছেন, ধর্ম উপদেষ্টা হিন্দুপ্রীতি ও পৌত্তলিকতার মতো জঘন্যতম কাজকে সমর্থন যুগিয়েছেন। তিনি এ জঘন্য শিরকি কাজের প্রতি যে পরিমাণ শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন তা আমাকে হতবাক করেছে। তার কিছু কথা মোটেও মেনে নেওয়া যায় না। যার মধ্যে দ্বীনের ন্যূনতম জ্ঞান আছে; এমনকি সাধারণ কোনো মুসলিমের পক্ষে আদৌ এ কথাটি বলা সম্ভব নয়।
তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে ‘আমরা একই পরিবারের সন্তান’ না বলে এটা বলতে পারতেন যে, আমরা একই দেশের নাগরিক। ‘আমরা একই পরিবারের সন্তান’ বলাটা জঘন্য শিরক। আর শিরকের গুনাহের কারণে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নাপাক ঘোষণা দিয়েছেন (সুরা তাওবা ২৮)। দ্বিতীয়ত: তিনি কখনো একথা বলতে পারেন না যে ‘আমাদের দুর্গাপূজা।’ তিনি বলতে পারতেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ‘আমাদের দুর্গাপূজা’ বলে তিনি জঘন্যতম শিরকি কাজটিকে শীথিলতার সাথে উল্লেখ করলেন কেন? এটার ব্যাখ্যা তাকে জাতির উদ্দেশ্যে দিতে হবে। তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আব্বাসী প্রতিবাদ করেছেন সেটা হলো, হিন্দু সম্প্রদায় তার গলায় ধর্মীয় নিদর্শন স্বরূপ একটি মূর্তি খচিত কাপড় (উথুলি) পরিয়ে দিয়েছেন এবং সেই কাপড়টি পরে তিনি অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং এই পরিধান করাটাকে তিনি কোনো দোষনীয় মনে করেননি বরং বৈধতা দিয়েছেন। ড. আব্বাসী এক্ষেত্রে ড. আ ফ ম খালিদের ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি আকিদার একটি মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ধর্ম উপদেষ্টার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম ব্যতীত অন্য যেকোনো ধর্মের ধর্মীয় কোনো অনুষঙ্গ কিংবা নিদর্শনকে গ্রহণ করা, স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমর্থন করা সুস্পষ্ট কুফরী। অন্য ধর্মের সাংস্কৃতিক কোনো বিষয়ও মুসলমানদের গ্রহণ করা বৈধ নয় বলে তিনি ফতোয়া প্রদান করেছেন। সর্বশেষ তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন, উথুলীকে সাদরে গ্রহণ করে, তার পক্ষে সাফাই গেয়ে ড. আ ফ ম খালিদ বড় ধরনের অন্যায় ও অপরাধ করেছেন। আমরা তাকে বলবো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার নামে, এভাবে নিজের আকিদা থেকে সরে যাওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। যে কাজগুলো হয়ে গেছে; তার কাছে অনুরোধ করবো আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবায়ে নাসুহা করুন এবং প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমা চান এবং পাশাপাশি এসকল বিষয়ে যেনো আগামীতে সংযত হন।
নিবন্ধের সমাপ্তিতে বলবো, প্রতিটি ধর্মের নিরাপত্তা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদি রাষ্ট্রটি মুসলিম প্রধান হয় কিংবা ইসলামী হয় তাহলে এর মূল দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রপ্রধানের উপর। সুতরাং পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা প্রদান এ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। যাহোক, মন্দিরে গিয়ে জামায়াত নেতার গীতা পাঠ মেনে নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে জনতার সামনে প্রকাশ্যে তার ভুল স্বীকার করা উচিত।
প্রত্যেক ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে স্বধর্ম পালন করবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, নিজ ধর্মের স্বকীয়তা বিলীন করতে হবে এবং নিজের ঈমান বিসর্জন দিয়ে তাদেরকে খুশি করতে হবে। ধর্ম উপদেষ্টা সেটাই করেছেন। জনতার প্রতিবাদের মুখে তিনি এজন্য সরি বলেছেন। আমরা আশা করবো, তিনি ভবিষ্যতে কথা বলার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধান হবেন।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না
দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম
বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু
দালালচক্রে জিম্মি রোগীরা
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকোই সাটুরিয়ার শিশু শিক্ষার্থীদের ভরসা
পঞ্চগড়ে চিকিৎসক পদায়নের দাবিতে সড়ক অবরোধ