অর্থনীতি পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
অন্তর্বরর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ প্রায় তিন মাস হতে চলছে। তবে তার কিছু কর্মকা- দেখে মনে হচ্ছে, তারা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকবে। বিষয়টি তেমন নয়। এই সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো মাস তিনেক অবস্থান করতো, তাহলে তাদের অর্থনীতি নিয়ে এতো চিন্তা না করলেও হতো। আপাত দৃষ্টিতে, দেড় থেকে দুই বছর দায়িত্বে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, রাষ্ট্র সংস্কারের স্বার্থে দেড় থেকে দুই বছর দায়িত্বে থাকাটা তার জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। তাই দুই বছর দেশের অর্থনীতি বেহাল অবস্থায় রাখা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে অর্থনীতিতে জরুরি ও আবশ্যকীয় বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। অর্থনীতিকে একটি দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করার পাশাপাশি যথাসম্ভব রাষ্ট্র সংস্কার করে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা এনে অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা এই সরকারের প্রধান কাজ। একটা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার সূত্রপাত করা উপদেষ্টাদের পবিত্র দায়িত্ব। কিছু উপদেষ্টার কর্মকা- দেখে মনে হচ্ছে, তারা খেই হারিয়ে ফেলছেন। তাদেরকে অনেকটা অমনোযোগী বলে প্রতিয়মান হয়। তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, ফ্যাস্টিষ্ট শক্তি আবার ফেরার সুযোগ পেলে এদেশের স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্ব সম্পূর্ন রূপে বিপন্ন হবে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, বিপন্ন অর্থনীতিকে রক্ষা করায় মনোযোগী হওয়া।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস দিয়েছে, কোভিড মহামারির পর সবচেয়ে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে চলতি অর্থবছরে এবং গতি হারাতে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে অর্থনৈতিক কর্মকা- আরও শ্লথ হয়েছে। অর্থনীতিতে যেসব অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সরকারের উচিত সেগুলোর দিকে দ্রুত মনোযোগ দেওয়া। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। তবে এটি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাসের মধ্যবর্তী পয়েন্ট। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতি ঠিকমতো না চললে প্রবৃদ্ধি কমে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, আর খুব ভালো করলে হবে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২ শতাংশ। দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ায় যদি প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে তা হবে কোভিডের সময়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম। করোনোভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এ কারণে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল শিল্পের উৎপাদন কর্মকা-। মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক নিয়ামক হতে পারে দুটি বিষয়। একটি উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে। অন্যটি হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার সাম্প্রতিক বন্যা, যা কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সীমিত করে দেবে। এ কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে কমবে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা এখন অনিশ্চয়তা। ‘অনিশ্চয়তা যদি কাটানো না যায়, তাহলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের পথে হাঁটবেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। টাকা তারা পকেটে রেখে দেন। তাই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে চেষ্টা করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে।’ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি সূত্র থেকে এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যার কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতার পরও যা চলমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, জ্বালানি খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা। তবে অর্থনীতির সাম্প্রতিক শ্লথ গতি হঠাৎ আসেনি। এটি উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্লথ হতে শুরু করে, যে ধারা চলতি বছরে আরেকটু গতে পেতে পারে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাতÑকৃষি, প্রবাসী আয় ও তৈরি পোশাক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে, কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে পুঁজির ব্যবস্থা করতে হবে। সারের যাতে ঘাটতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর কর্মীদের বিদেশ গমন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত রয়েছে। যে অর্থনীতি এখন শতকরা ৮ থেকে ১০ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পারত, তা এখন শতকরা প্রায় ৪ ভাগ হতে পারে। বিশ্বব্যাংক সে রকম পূর্বাভাসই দিয়েছে। এই একটি বার্তাই অন্তর্বরর্তী সরকারকে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বড় বার্তা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে শতকরা ১ ভাগ কমেছে। কিন্তু তাতে মানুষের কষ্ট কমেছে কিনা, সেটিই দেখার বিষয়। যাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও শাকসবজি কিনতে বাজারে যান, তাদের প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। কেউ বলছেন, আগেই ভালো ছিল। ‘এই আগেই ভাল ছিল’, থেকে ‘এখনই ভাল’ তা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বই সরকারের উপর বর্তেছে। যদিও অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তৎপর রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। তিনি কয়েক দফা সুদের হার বাড়িয়েছেন, যা ঋণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে। তবে বিনিয়োগ কমে যাবে বৈকি! ষাটটির মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়ে গেছে, যা বিনিয়োগে মন্দ নির্দেশক। মূল্যস্ফীতি দমনে সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টারও ভূমিকা রয়েছে। কারণ, বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে একটা বড় সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি রয়েছে। তবে আপাতত মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বা সাফল্য নেই। এই বিভাগের আন্তরিক মনোযোগ ছাড়া উচ্চ মূল্যের তীব্রতা কমানো সম্ভব নয়। বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, তথ্য, যোগাযোগ, রেল ও নৌপরিবহন, স্থানীয় সরকার, জ্বালানি, বিচার, আইন ও অর্থ বিভাগগুলোর মনোযোগই পারে মূল্যস্ফীতি কমাতে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক নয়। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নির্মূল করা শুধু স্বরাষ্ট্রবিষয়ক কাজ নয়, এতে অর্থনীতির উপকার অনেক বেশি। এই সরকার সেদিকে অখ- মনোযোগ আনবে, এটিই প্রত্যাশা।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে, দেশের অর্থনীতির জন্য যে চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে সেগুলো হচ্ছেÑ মূল্যস্ফীতি, যা কিছুটা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিস্থ খাতের চাপ, যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বাড়ছেই। সরকারকে এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে হবে। যদি অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় এবং প্রকৃতি শেষ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে থাকে, তাহলে চলতি অর্থবছরে হয়তো ৫ শতাংশের একটু বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে চেষ্টা করতে হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশের দিকে যেতে। চলতি অর্থবছরের সমস্যাগুলো থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে আগামী বছর অর্থনীতিতে আবার চাঙ্গা ভাব ফিরে আসবে, এটা আমরা আশা করতে পারি। তার আগে সরকারকে জরুরি বিষয়গুলোর ব্যাপারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন কাজ আগে করবে, আর কোন কাজ পরে করবে, সেই অনুযায়ী একটি রোড ম্যাপ ঠিক করতে হবে। তাহলে সাফল্য আসবে। রাজনৈতিক সরকার যে কাজগুলো করতে আগ্রহ দেখায় না, সে ধরনের দীর্ঘমেয়াদী জনহিতকর কাজ করে নজির রেখে যেতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
Email : [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৩২
আল্লাহকে পেতে হলে রাসুলের পথ অনুসরণ অপরিহার্য: মাওলানা রুহুল আমিন খান
ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে : ডিএমপি কমিশনার
ভোটের মাধ্যমে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবন্ধ থাকতে হবে-লুৎফর রহমান আজাদ
গফরগাঁওয়ের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুছ ছালামের ইন্তেকাল
আওয়ামী দোসররা মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে: তানভীর হুদা
ফিলিস্তিনিদের জন্য কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে মিশরে পৌঁছেছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল
১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি
বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ
ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন