ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল আকসা পুনরুদ্ধারে মুসলিম ঐক্য নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করতে পারে
৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
বিশ্বসভ্যতার অন্যতম পাদপীঠ, মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও পবিত্র জেরুসালেম নগরী আট দশক ধরে জায়নবাদী ইহুদিদের জবরদখলে রয়েছে। খলিফা ওমরের নির্দেশে সেনাকমান্ডার আবু উবাইদার নেতৃত্বে ৬৩৬ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মুসলিমবাহিনী জেরুসালেম অবরোধ করলে ৬ মাসের মাথায় খ্রীষ্টান যাজক শাসক খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাবের নিকট আত্মসমর্পনে রাজি হন। এরপর ক্রুসেডের সময় সত্তুর বছর জেরুসালেম ক্রুসেডারদের দখলে থাকলেও সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবির নেতৃত্বে জেরুজালেম মুসলমানরা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা প্রথম মহাযুদ্ধের নীল নকশায় হাজার বছরের উসমানীয় খেলাফত রাষ্ট্র ভেঙ্গে দিয়ে আরব ও অনারব মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভেদ-অনৈক্যের বীজ বপন করে ভবিষ্যতে জেরুসালেম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। বৃটিশ গোয়েন্দা তৎপরতায় আরব উপদ্বীপে আরব জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে প্রথমে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করে। লর্ড বালফোরের ঘোষণা অনুসারে, অটোমান সা¤্রাজ্য বা উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পরও ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। কারণ, সেখানে আরব জনগোষ্ঠির তুলনায় ইহুদি জনসংখ্যা ছিল শতকরা ১০ ভাগেরও কম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে ইউরোপ-রাশিয়ার ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আগমন এবং হিটলারের ইহুদি নিধন বা হলোকষ্টের ঘটনাকে পুঁজি করে জায়নবাদীদের নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা গণমাধ্যম ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করতে আরবদের উচ্ছেদ ও জমি দখলের পথ বেছে নেয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে হাঘানা মিলিশিয়া বাহিনীকে পশ্চিমা সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরাস্ত্রে সজ্জিত করে জাহাজ বোঝাই সমরাস্ত্রসহ ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়। সেখানে তারা কোন কোন দিক থেকে কি ধরণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারে, সে সব বিবেচনায় রেখেই সমরশক্তি ও যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল। বলাবাহুল্য, শুরুতেই আরবরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
ফিলিস্তিনের বুকে একটি জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র পুরো মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বশান্তির জন্য বেদনাদায়ক বিষফোঁড়ায় পরিনত হয়। মূলত আরব ও মুসলমানদের মধ্যকার ফেরকা, অনৈক্যই ইহুদি রাষ্ট্রটির টিকে থাকা ও সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা এগিয়ে নেয়ার প্রধান শক্তি। উল্লেখ্য, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফোরের ঘোষণার আগেই মক্কার শরীহ হোসেনের সাথে বৃটিশদের গোপণ সন্ধি এবং যুদ্ধ পরবর্তী আরব ভূখ-ের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সাইক্স-পিকো চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হলেও আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে ইউরোপের পুরনো বোঝাপড়ার সাথে মার্কিনীরা সমর্থন দিয়ে আসছে। এই সমর্থনের কেন্দবিন্দুতে রয়েছে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি সম্পদ ও ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণœ রাখতে ইসরাইলকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে চিরস্থায়ীভাবে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল ও বশংবদ করে রাখতে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে রেখেছে। সবকিছু ঠিকঠাকমতই চলছিল। মধ্যপচ্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রাচীন ঐতিহ্যের দেশ পারস্য তথ্যা ইরানের পাহলভি রাজারা ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ের সাথে হাত মিলিয়ে ইরানকে পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক রাষ্ট্রে পরিনত করার কাজে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইরানি জনগণ পশ্চিমা গণতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিল। সে লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে আরব বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে রেজা শাহ পাহলভির ক্ষমতা খর্ব করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল ইরান। তিনি প্রথমেই ইরানের তেল সম্পদের উপর সে দেশের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিত করতে এংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানিকে জাতীয় করণের উদ্যোগ নেন। আর এই সিদ্ধান্তই কাল হয়ে দাঁড়ায় ইরানের শিশু গণতন্ত্র ও প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের জন্য। ১৯৫৩ সালে বৃটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দা বাহিনীর যৌথ প্রযোজনায় একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকারের পতনের পর ইরানে শাহের রাজতন্ত্র এবং পশ্চিমা নিয়ন্ত্রন পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের উপর পশ্চিমাদের চিরস্থায়ী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য জায়নবাদী ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো স্বাধীন সত্তা ও সম্ভাবনাময় সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করার পন্থাকে বেছে নিয়েছে। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি, সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ও মানবিক মর্যাদা যেন পশ্চিমাদের খেয়াল খুশির বিষয়ে পরিনত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের জনগণ প্রথম শক্তি প্রতিরোধ ও সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমাদের আধিপত্যের নাগপাশ ছিন্ন করে ইমাম খামেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেখানে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পশ্চিমা ও জায়নবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বিরোধগুলো উস্কে দিয়ে পরস্পরকে যুদ্ধ, বৈরীতা ও অনাস্থার-অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছে। ইরানে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই শাত-ইল আরবের সীমারেখার পুরনো বিরোধকে সামনে এনে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরান আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছিল পশ্চিমারা। ইসরাইলসহ পশ্চিমা বশংবদ আরব দেশগুলোও বিপুল অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে সাদ্দাম হোসেনের পাশে দাঁড়িয়েও সফল হতে পারেনি। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ও জানবাজ জনগণ অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা, বিপ্লবের লক্ষ্য অক্ষুন্ন ও সমুন্নোত রাখতে সক্ষম হয়। ওআইসিভুক্ত অর্ধশতাধিক তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে এই মুহূর্তে সম্ভবত ইরানই একমাত্র রাষ্ট্র যাকে জায়নবাদী ইসরাইল ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি প্রধান অন্তরায় বলে গণ্য করে। দশকের পর দশক ধরে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যখন ইরানের অগ্রযাত্রা নস্যাৎ করা যায়নি। শিক্ষা,জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক প্রযুক্তিতে ইরানের ঈর্ষনীয় সাফল্য যতটা না তাদের জন্য পীড়াদায়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি হুমকি হচ্ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আল আকসার মুক্তি ও জেরুসালেম প্রশ্নে ইরানের বিপ্লবী সরকারের ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধের সমর্থনে ক্রমবর্ধমান তৎপরতা। ইরানিরা জানে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রের জন্য পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব একটি ফাঁদ মাত্র। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং পূর্ব জেরুজালেম প্রশ্নে পশ্চিমাদের অবস্থান, কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতাই হচ্ছে শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষে তাদের প্রকৃত অবস্থান নির্ধারণের একমাত্র মানদন্ড। সেখানে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অজুহাত তুলে গত সাড়ে ৭ দশকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব রেজুলেশন ও চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে জায়নবাদী ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি বাস্তবায়নে ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন ও গণহত্যার প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থন অটুট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সা¤্রাজ্যবাদী সামরিক-অর্থনৈতিক নীল নকশায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইরানই হচ্ছে তাদের একমাত্র প্রতিবন্ধক। ইরানের শাসকরা পশ্চিমাদের সাথে আপস করে নতুন পরাশক্তির স্বীকৃতি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্রলোভনের চেয়ে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ ও অথবা বিজয়ী হওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। ইরানের ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনীর আল আকসার মুক্তির শপথ কোনো সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। ইরানে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ইমাম খামেনি প্রথমেই আল আকসা মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইরানের আল কুদস ফোর্স মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল কুদস ফোর্সের সাবক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরাইল-আমেরিকান নেক্সাস ইরানের চুড়ান্ত প্রতিরোধের মুখে দাঁড়িয়েছে।
ইরানের সাথে ইরাকের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে ইসরাইলসহ পশ্চিমা আঞ্চলিক মিত্ররা সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে সাদ্দামের পাশে দাঁড়ালেও সাদ্দাম হোসেনের পারমানবিক প্রকল্প ধ্বংস করতে ১৯৮১ সালে ইসরাইলকে সহায়তা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মানে হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ছাড়া আর কোনো দেশের কাছে পারমানবিক অস্ত্র থাকবে না. এটাই পশ্চিমাদের সিদ্ধান্ত। পারমানবিক হামলার ভয় দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে দাবিয়ে রাখা এবং গ্রেটার ইসরাইল গঠনে সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসন চালিয়ে যেতে ইসরাইলকে সব রকম সহায়তা অব্যাহত রাখা। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী আরব দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন ও বৈরীতার মুখে ঠেলে দিয়ে পারমানবিক-সামরিক উচ্চাভিলাষ থেকে ইরানকে নিবৃত্ত রাখার পশ্চিমা ফর্মূলা ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রত্যাশা পরিত্যাগ ও আরব দেশগুলোর ইসরাইলের আধিপত্য মেনে নেয়ার মার্কিনী আয়োজনও ইরানের প্রভাবের কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তবে ইসরায়েলের জায়নবাদী নেক্সাস সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা থেকে বিচ্চুত হয়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ ভাষনে নেতানিয়াহু গ্রেটার ইসরাইল পরিকল্পনার ম্যাপ দেখিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে ঔদ্ধত্ত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার সময় আল আকসায় ইহুদি অনুপ্রবেশ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস প্রথমবার ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে অপারেশন আল আকসা ফ্লাড পরিচালনা করে। সেই থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলী আগ্রাসনে গত ১৩ মাসে গাজা শহরকে ধ্বংস স্তুপে পরিনত করে প্রায় ৪৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরাইলী বোমায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজা উপত্যকার বিশ লাখের বেশি মানুষকে উদ্বাস্তু চরম খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সেখানে ইরান ছাড়া আর কোনো আরব দেশকে ঝুঁকি নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বজনমত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকলেও আরব শাসকরা এখনো ইঙ্গ-মার্কিনীদের কৃত্রিম দোস্তি ত্যাগ করে আল আকসা ও আরব ফিলিস্তিনীদের রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ইহুদি জায়নবাদীরা যাদেরা শর্তহীন বন্ধু, ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করতে যারা নি:শর্তভাবে শত শত কোটি ডলারের বিদ্ধংসী মারনাস্ত্রের সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে মুসলমানদের সম্মিলিত স্বার্থের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে আগামি কয়েক দশকে ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়ার জনগণের উপর জায়নবাদী আগ্রাসনে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এখানে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার একটি প্রতীক মাত্র। হামাসের হাতে আটক ইসরাইলীদের মুক্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে ইসরাইলকে রাজি করাতে পারেনি। অথচ তাদের সহযোগিতা ছাড়া ইসরারাইল একদিনও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম নয়। তাদের মদতে গাজার পর এখন লেবাননকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করা হচ্ছে। গাজা যুদ্ধের প্রথম একমাসে যে পরিমান বোমা ফেলা হয়েছে, তা অন্তত ২টি পারমানবিক বোমার সমান বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন। ওদের ধারণা ও পরিকল্পনাকে ভুল প্রমান করে হামাস এখনো অজেয়। তারা এখনো ইসরাইলের অভ্যন্তরে রকেট ব্যারেজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্থলযুদ্ধে ইসরাইলী ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান ও সৈন্যদের খতম করে চলেছে। অন্যদিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের সামরিক ব্যবস্থা পশ্চিমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। গত সাড়ে ৭ দশকে অন্তত তিনবার সম্মিলিত আরব বাহিনী ইসরাইলের কাছে হারলেও এবার ইরানের প্রক্সিদের কাছেই কার্যত হেরে গেছে ইসরাইল।
চলতি বছরের ১ লা এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনসুূলেট ভবনে ইসরাইলের ড্রোন হামলায় কয়েকজন ইরানি সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর ইরান এর পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’ নাম দিয়ে ১৪ এপ্রিল তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে বড় ধরণের চমক সৃষ্টি করে। আয়রন ডোম ও পশ্চিমা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বেশিরভাগ ক্ষেপনাস্ত্র আকাশেই আটকে দেয়ার দাবি করলেও বেশ কয়েকটি হাইপারসনিক মিসাইল ইসরাইলের নাভাটিম বিমান ঘাটিতে আঘাত হানে। এর পাল্টা ইরানে হামলা চালালে ইরান আরো শক্ত হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। সে হুমকি অগ্রাহ্য করে ইসরাইল ইরানে খুবই দুর্বল ড্রোন হামলার জবাবে ইরান ১ অক্টোবর ইসরাইলে প্রায় ২০০ সুপারসনিক মিসাইল হামলা করে তিনটি বিমানঘাটি এবং অন্তত ২০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দেয়। এর জবাবে ২৬ অক্টোবর ভোরে ইসরাইলী বিমান বাহিনী শতাধিক বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি প্রদেশে কয়েকটি সেনাঘাটিতে হামলা চালিয়েছে। তবে ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সে সব হামলা ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হওয়ায় বড় ধরণের কোনো ক্ষতি হয়নি। এ কারণে ইরানের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও তাৎক্ষনিক পাল্টা হামলা থেকে বিরত রয়েছে ইরান। এভাবেই ফিলিস্তিনে, লেবাননে ও সিরিয়ায় ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক বোমা হামলা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরান শক্ত প্রত্যাঘাত করে চলেছে। ইরানের পাল্টা হামলার ঘোষণা সত্ত্বেও তেহরান-খুজেস্তানে ইসরাইলের বিমান হামলার ঘটনা থেকে বুঝা যায়, গাজা ধ্বংসের নীল নকশা এবং ইরানকে যুদ্ধে নামিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে আরেকটি আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। গাজা ও লেবাননের শিশু, নারী ও বেসামরিক মানুষদের রক্ষায় মিশর, সউদি আরব, আমিরাত এবং ন্যাটো সদস্য তুরষ্ক সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে পারলে এবার ইসরাইলকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে আল আকসার মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন সম্ভব। ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক পরিনতির মুখোমুখি দাঁড় করানো ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি মেনে নেবে না। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইলের ফিলিস্তিনি গণহত্যা এবং লেবানন ধ্বংসের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে আরব বিশ্ব এখনো ইরানকে সামনে রেখে নিজেদের নিরাপত্তা খুঁজছে। তাদের নিরবতা ও নিস্ক্রিয়তা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি আত্মঘাতি প্রবণতা। তবে সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইরান যখন ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তছনছ করে চলেছে তখন চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সউদী বৈরী সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কে উপনীত হতে চলেছে। গত বছর ৭ অক্টোবরে হামাস ইসরাইল যুদ্ধের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে সউদী আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া চলছিল। ইরানের প্রক্সি হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও ইরাকের ইসলামিক জিহাদের ধারাবাহিক হামলার পাশপাশি আইআরজিসির ইসরাইল আক্রমন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে জায়নবাদীদের পুরনো নীলনকশা ভন্ডুল করে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সুত্রপাত ঘটাতে চলেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং আল আকসার মুক্তি সেই কাঙ্খিত পরিবর্তনের মাইলফলক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দানে পাওয়া কাপড়ের মনোরম ডিজাইনে ভাইরাল ভারতীয় একদল ডিজাইনার
কেমন হল ভিভো ভি৪০ লাইটের অভিজ্ঞতা!
তাদের রাজনীতি করতে দেবে কি-না তা দেশের মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে: জামায়াতে সেক্রেটারি
উত্তরায় হাসপাতালে সন্ত্রাসী হামলাও লুটপাটের ঘটনায় থানায় মামলা
পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৩২
আল্লাহকে পেতে হলে রাসুলের পথ অনুসরণ অপরিহার্য: মাওলানা রুহুল আমিন খান
ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে : ডিএমপি কমিশনার
ভোটের মাধ্যমে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবন্ধ থাকতে হবে-লুৎফর রহমান আজাদ
গফরগাঁওয়ের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুছ ছালামের ইন্তেকাল
আওয়ামী দোসররা মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে: তানভীর হুদা
ফিলিস্তিনিদের জন্য কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে মিশরে পৌঁছেছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল
১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি
বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ
ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার