গণঅভ্যুত্থানের সাবলিমিটি : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন
১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-২০২৪-এ মোসা. আয়শা আক্তার, বেগম বদরুন্নেসা কলেজের সমন্বয়ক, শাহিনুর সুমি ইডেন কলেজের সমন্বয়ক, আনিকা তাহসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক। হামলা-মামলার মুখেও তারা রাজপথে অবিচল ছিলেন। লেখাবাহুল্য, হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। শাহবাগ মোড়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি, হলের মিছিলগুলো, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে স্লোগানে মুখরিত উত্তাল নারীদের দেখা গেছে। আন্দোলনে নারীরা ছিল ‘জয়নাব বিনতে আলী’ মতো কারবালা প্রান্তরে নিজ ভাইয়ের উদ্দেশ্যের প্রধান রক্ষাকবচ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া সকল সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রাজপথে দেখা গেছে। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। আহত ও নিহতদের সংখ্যার মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। কিন্তু সরকার গঠনে কিংবা মিডিয়ায় কাভারেজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এগিয়ে আছে। এজন্য বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার আত্মত্যাগকে সকলের কাছে তাৎপর্যমণ্ডিত করার জন্য অবশ্য সেখানকার সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের সামনে আনতে হবে।
২০০৯ সাল থেকে তীব্র দমন-পীড়নের সম্মুখীন হওয়া বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বড় ও ছোট আকারে প্রতিবাদ করে এসেছে। হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ন্যারেটিভস সাধারণ বাংলাদেশিদের, বিশেষ করে যারা বিরোধী দলগুলির সাথে জোটবদ্ধ তাদের সহ্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। আসলে গতিবেগ এবং জনসমর্থন সত্ত্বেও, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিরোধীদের দমন ও ত্যাগের দীর্ঘ ইতিহাসের ভিত্তি ছাড়া সফল হতে পারে না। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিরোধ এই ইতিহাস থেকে শক্তি অর্জন করে, যা দেখায় যে বিএনপি কর্তৃক স্থাপিত ভিত্তি জনগণের কাছে আন্দোলনের অনুরণনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য শুধুমাত্র তার স্লোগান বা নেতৃত্বের কারণে নয় বরং বছরের পর বছর স্বৈরাচারী শাসনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক মোহভঙ্গের প্রতিক্রিয়াও ছিল। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি গণসংহতির জন্য আস্থা প্রদর্শনে সক্ষম হয়।
হাসিনা বিরোধী প্ল্যাটফর্ম থেকে বিএনপি ত্রুটিপূর্ণ ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু ২০১৮ সালের কারচুপির নির্বাচনে অংশ নেয়। ফলে নির্বাচনী নিপীড়নের প্রতি কঠোর হলেও মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি এবং কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের মতো সংকটের মধ্যেও বিএনপি প্রতিবাদী হতে হয়েছে। তবুও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্ররা নিহত বা গ্রেফতার হলে জনগণ গভীর সহানুভূতির সাথে সাড়া দিয়েছিল। বিএনপি তাদের প্রতি এতোটাই নিবেদিত ছিল যে নিজের দলের প্রায় ৪০০ জন নেতা কর্মী গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন বলে মিডিয়া সংবাদ প্রকাশ করেছে।
৬.
আমরা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন মাস অতিক্রম করছি। এটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। নোবেল বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দু’জন নেতাকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি কার্যত নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। ভালো হতে পারতো সরকারের কোন অংশে অন্য ফর্মে হলেও নারী শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতিনিধি এবং দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হলে।
ছাত্র আন্দোলন বিএনপি’কে এই শিক্ষা দিয়েছে যে গণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচার বিরোধী বক্তব্যের উপর রাজনীতি নির্ভর করতে পারে না। তাদের অবশ্যই অতীতের ভুল থেকে মুক্ত সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক স্থান তৈরি করে আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্গঠন করতে হবে। আন্দোলনে বিএনপি ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য এসেছে কোনো নতুন রাজনৈতিক ভাষা থেকে নয় বরং ঐতিহ্যগত দলীয় রাজনীতিকে অতিক্রম করে পরিবর্তনের সম্মিলিত আকাক্সক্ষার মাধ্যমে। বিএনপি জানে, রাজনৈতিক সংহতির ভবিষ্যত নির্ভর করবে আস্থা, জবাবদিহিতা এবং অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপর। একটি খাঁটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য আকুল আকাক্সক্ষা গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সমুজ্জ্বল করে তুলবে।
জুলাই মাসে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ৫ আগস্টে পরিসমাপ্ত হওয়া গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব জাগরণে সরকার পরিবর্তনের এই দৃষ্টান্ত বিশে^ বিরল ঘটনা। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আরব বসন্ত(২০১০ এবং ২০১১ ও ২০১২) মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশের স্বৈরাচারী শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে। তাদের দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হিংসাত্মক দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়। মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া বিপ্লবোত্তর নতুন দেশ গঠনের কাজে সফল না হলেও তিউনিসিয়া সফল হয়েছিল। এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে মেলানো যায়। তিউনিসিয়ার ‘জেসমিন বিপ্লব’ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবং ১৪ জানুয়ারি (২০১১) দেশটির শাসক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ডিসেম্বরে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একটি নতুন সংবিধান জারি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিউনিসিয়া আরব বসন্তের বিক্ষোভের প্রথম দেশ যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজনের কাছ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো সেখানেও দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি কাউন্সিলের সদস্যরা অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। গণ-অভ্যুত্থান ও খুনি শাসকের দেশ ত্যাগের ঘটনা উভয় দেশে ঘটেছে দেড় মাসের মধ্যে। কিন্তু অতি অল্প সময়ে তিউনিসিয়ায় নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে ৮ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নানা তর্ক-বিতর্কে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু কিংবা সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের উপর অর্পিত হোক এ প্রত্যাশা সকলের। উদুর পিণ্ড বুদুর ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতা ও অযথা সময় ক্ষেপনের চেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ড. ইউনূস সরকার ছাত্র-জনতাকে সুশাসন ফিরিয়ে দেবেÑএটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
হাসিনার শাসনামলে সরকারের সমস্ত দিক দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নতুন প্রশাসক দিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ নেতৃত্ব কীভাবে অর্জন করা সম্ভব? বাংলাদেশে এখনো অনেকেই অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য সংগ্রাম করছেন। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অধীনে বাংলাদেশ কীভাবে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক পথ তৈরি করবে? বিচার বিভাগ পক্ষপাতদুষ্ট এবং ভিন্নমত দমনে ব্যবহৃত হয়েছে। কিভাবে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হবে?
বছরের পর বছর স্বৈরাচারী শাসনের পর কীভাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? ফ্যাসিবাদী হাসিনার শাসনামলে সমাজের সকল দিক কুলষিত হয়েছে, ফলে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করা।
৭.
অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকার যথেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করেছেন। বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো বারবার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেনÑযত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করে দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ঠ উদাসীন এবং নির্বিকার। নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য ফন্দি-ফিকির করছেন উপদেষ্টামণ্ডলী। এতে করে ফ্যাসিবাদের দোসররা ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যদি তাই হয়, তবে বিনষ্ট হবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাবলিমিটি। (সমাপ্ত)
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী সরকার শুধু ফ্যাসিস্ট নয় তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট : অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন
নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান
‘ফিফা ছিল খুবই দুর্বল, আমিই একে বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছি’
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কাউকে রেহাই দেয়নি, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে পালিয়ে গেছেন: রিজভী
স্বৈরাচার সরকারের দোষররা এখনো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে: রফিকুল ইসলাম খান