ঢাকা   শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে

Daily Inqilab মাহবুব নাহিদ

১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশের মানুষ এক অভুতপূর্ব অভ্যুত্থান করেছে। অভ্যুত্থানে পেয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাধ। ফ্যাসিবাদী শাসন গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে এবং দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা।
আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই আন্দোলন রূপ নিয়েছে গণআন্দোলনে। মানুষের বিস্ফোরণে হয়ে উঠেছে গণঅভ্যুত্থান। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ছাত্র, শ্রমিক জনতা, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, লেখকসহ সকল শ্রেণীপেশার মানুষ। আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছে দেশের সকল রাজনৈতিক দল।

বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সকল রাজনৈতিক শক্তিকে একত্রিত করে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যাঁর নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যশক্তি আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল। শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনব্যবস্থা যখন দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছিল, তখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ায়। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়। ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার মঞ্চ থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর বহু আগেই তারেক রহমান হাসিনার পতনের এক দফার ডাক দিয়েছিলেন। আর ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল শক্তিকে এক করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র কাণ্ডারীও তিনিই। তারেক রহমানের ৩১ দফা পরিকল্পনা কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের রূপরেখা নয়, এটি একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, যেখানে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী হবে। তবে এই ঐক্যের শক্তি আমাদের দেশের সামাজিক মুক্তির সংগ্রামের অংশ হিসেবেই দেখা উচিত, যেখানে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শুধুমাত্র সরকারের পতন নয়, বরং একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

এছাড়া, বাংলাদেশের সমাজে বর্তমানে যে নৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তারও সমাধান প্রক্রিয়া আমাদের পথচলার অংশ হতে হবে। ‘মব লিনচিং’-এর মতো ঘটনা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে এবং এর মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার উপর দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের সমাজের উন্নতি ঠেকাচ্ছে। দুর্নীতি, অসততা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় জাগরণ, যে জাগরণের মাধ্যমে আমরা সমাজের নৈতিক ভিত্তি পুনঃস্থাপন করতে পারব।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যুব সমাজের মধ্যে যদি নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের চেতনা জাগ্রত না করা যায়, তাহলে আমাদের সামনে এক কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার কেবল আইনগত দিক থেকে নয়, বরং নৈতিক দিক থেকেও প্রয়োজনীয়। নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটিয়ে একটি সুস্থ সমাজ গঠন করতে হবে।

যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু আন্দোলন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা স্বার্থে হয়ে উঠছে এবং এর ফলে আন্দোলনগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। রিকশাওয়ালাদের আন্দোলন, আনসারদের দাবি, শিক্ষকদের প্রতি অপমান, এ সবই আমাদের সংকট আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, আমাদের সকলের উচিত এই ধরনের অস্থিরতা এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

প্রতিটি আন্দোলনই একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এটি যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তবে তা সামাজিক শৃঙ্খলা এবং শান্তি ভেঙে দিতে পারে। আমাদের দেশের যে সমস্যা, তা সমাধান করতে হলে ধৈর্য, শান্তি এবং সম্মানের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। সঠিক সময় এবং সঠিক কৌশলে দাবি আদায়ের পথ খুঁজে বের করতে হবে। অবিলম্বে আমরা যদি সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়ি এবং আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তবে তা কেবল আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে এবং সমাজে অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।

নির্বাচন আসন্ন এবং এর পেছনে রয়েছে এক বিশাল পরীক্ষা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর ঘটনা দেশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে এটিই শেষ নয়; এটি শুরু। এই সময় আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এর মাঝে আসতে পারে অনেক ষড়যন্ত্র। আমাদের সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে বিদেশের মাটিতে কীভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও আমরা দেখলাম, আমাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিভিন্নভাবে ভারতে বসে কূটকৌশল চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। পালিয়ে গেলেও বারবার বিভিন্ন অডিও বার্তায় দেশকে সংঘাতের দিকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছে। ‘চট করে ঢুকে পড়ব’ এমন কথাও তাকে বলতে শোনা গেছে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর ছবি নিয়েও মিছিল করতে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মীদের। আনসার, পল্লী বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে নানান বেশে তারা আন্দোলন করার চেষ্টা চালিয়েছে। তাই থাকতে হবে সজাগ, রাখতে হবে ইস্পাত কঠিন ঐক্য।
আন্দোলনে আমরা যারা অক্ষশক্তি ছিলাম, আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধান শত্রু হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ হতে পারে, কিন্তু হাসিনার শাসনকালের বিষয়ে আমাদের এক থাকতে হবে। দেশে হাসিনার মতো গণহত্যাকারীকে আর ফিরতে দেওয়া যাবে না। তার দল আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না। তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, তারা যত মানুষ হত্যা করেছে, তাতে তাদের মনে কোনো কষ্টের অনুভূতি নেই। এ কারণেই তাদের আর সামনে আসতে দেওয়া যাবে না।

বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে, আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা, সমালোচনা এবং মতবিরোধ হতে পারে, এটি স্বাভাবিক। তবে যখন পরাজিত শক্তির বিষয় আসে, তখন আমাদের এক হতে হবে। সরকারকে সমর্থন দেওয়া যেমন আমাদের কাজ, তেমনি আমাদের মধ্যে বিপ্লবের চেতনা বজায় রাখতে হবে। সরকার সংস্কারের জন্য বেশকিছু কমিশন গঠন করেছে এবং এগুলো যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। বর্তমান সরকার অনির্বাচিত এবং এই সরকারের ক্ষমতা প্রলম্বিত হওয়া দেশের জন্য ঠিক হবে না। যত দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব, ততই মঙ্গল।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
আরও

আরও পড়ুন

আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২

আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২

শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার

শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার

ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার

ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার

শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা

শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা

ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো  - বিটিভি মহা পরিচালক

ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো - বিটিভি মহা পরিচালক

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ

প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার

প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার

৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!

৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!

২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল

২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল

মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন

মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন

বড় দরপতনের পর সোনার দামে আবার বড় লাফ

বড় দরপতনের পর সোনার দামে আবার বড় লাফ

রাজবাড়ীতে ছাত্রদল নেতা অপহরণ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

রাজবাড়ীতে ছাত্রদল নেতা অপহরণ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট

ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট

মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ

মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনের হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনের হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের

সুরমা-কুশিয়ারার জন্য ১৭৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প

সুরমা-কুশিয়ারার জন্য ১৭৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প

নকলায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

নকলায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক