মুক্তিযুদ্ধ ও জিয়াউর রহমান
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ এএম | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ এএম
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে কোনো ভূখন্ড ছিল না। এখন যে অংশটুকু নিয়ে বাংলাদেশ তা ১৯৪৭ সালের আগষ্ট পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারত ভাগ হলে এই অংশটুকু পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়। ফলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব প্রায় বারোশ মাইল, যা আবার তিন দিকে ইন্ডিয়া ও অন্যদিকে মায়ানমার দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরকম ভৌগোলিক ভাগাভাগি পৃথিবীতে বিরল এবং থাকলেও সব সময় অস্থিরতা থাকাটাই স্বাভাবিক। জাতিগতভাবে ৯৮.৭% পূর্ব পাকিস্তানী মানুষের চেহারা একই। প্রায় ৯০% মানুষ একই ধর্মে বিশ্বাস করে, কমপক্ষে ৯৮% ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটা কলোনি হিসেবে ট্রিট করত বিধায় এ অংশের মানুষের প্রতি তাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বৈষম্যমূলক। সেজন্য শোষণ বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা, ভয়-ভীতি, গুলি, সন্ত্রাস, জেল-জুলুম, হত্যা ইত্যাদি ছিলো পূর্ব পাকিস্তানীদের কপালে সয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। যদি ইতিহাস ঘাঁটা যায়, তাহলে দেখবো, এই অংশের মানুষের ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত কেটেছে মৌলিক অধিকার যেমন গণতন্ত্র, কথা বলার স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ, ন্যায়বিচার ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। এ সকল আন্দোলন সংগ্রামে অত্যন্ত সংগঠিত দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তী ১৯৭০ সালটি ছিল পাকিস্তান এক থাকবে না ভেঙ্গে যাবে তার নির্ধারক সময়কাল। ঘটলও তাই, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পেলেও ক্ষমতা না দিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। যে দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলার কথা ছিল, সেই দলের প্রধান শেখ মুজিবর রহমান আত্মসমর্পণ করে প্লেনে চড়ে চলে গেলেন পাকিস্তানে, সাথে সাথে তার নির্বাচিত সদস্যরা ভারতে চলে গেলেন। এদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ নিরস্ত্র অসহায় জাতির উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ল, মেজর জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহকারী কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত। মেজর জিয়ার কমান্ডিং বস ছিলেন লে. কর্নেল জানজুয়া। ২৫ মার্চ রাত আনুমানিক ১১টায় চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তানী অস্ত্রের জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস তদারকি করার জন্য জানজুয়া জিয়াকে নির্দেশ দেন। তিনি দু’জন পাকিস্তানী অফিসার সাথে নিয়ে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে রওনা দেন। আগ্রাবাদে এসে ট্রাকটি যখনই ব্যারিকেডে থেমে গেল, তখনই অন্যপ্রান্ত হতে মেজর খালিকুজ্জামান জিয়াউর রহমানের কাছে এসে জানালেন পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্টে থাকা বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের উপর হামলা করছে। সাথে সাথে তিনি We revolt বলে তাঁর সাথে থাকা অফিসার দু’জনকে নিরস্ত্র করলেন। তিনি ক্যান্টনমেন্টে ব্যাক করে সকল বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের সাথে নিয়ে তাঁর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে এরেস্ট ও হত্যা করে পুরো সেনানিবাসের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দিলেন, ও গধলড়ৎ তরধ, I Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sheik Mujibur Rahman, the Independence of Bangladesh. দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণামূলক উক্তি ছিল ‘উই রিভোল্ট’ এবং স্বাধীনতার ঘোষণা। মেজর জিয়া ব্যর্থ হলে তাকে পাক আর্মি হত্যা করতো, মুজিবকে নয়। অথচ, তাঁর মৃত্যুদ-ে দ-িত হওয়ার ভয় ও ঝুঁকি কোনটাই ছিল না। এই পার্থক্যটুকু কতজন বোঝেন? কার জীবনের ঝুঁকি বেশি ছিল? কে বেশি সাহস দেখিয়েছিলেন? জিয়াউর রহমান না শেখ মুজিব? শেখ মুজিবকে অধিক সম্মান দেখাতে গিয়ে যারা জিয়াউর রহমানকে খাটো করে এতোদিন কুটুক্তি করেছেন তাদের জন্যই আমার এই কথা।
যুদ্ধক্ষেত্রে মেজর জিয়ার বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সর্বদা সামনে থাকতেন এবং কমান্ডারদের সৈনিকদের সামনে থাকতে অর্ডার দিতেন। সেজন্যে দেশপ্রেমিক অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে তুলতে জেড ফোর্সের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এ ফোর্স গঠনের পর (৭ জুলাই, ১৯৭১) থেকে একটানা ২৮ জুলাই পর্যন্ত সামরিক অভিযানে অভিজ্ঞ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ যুদ্ধকে জোরদার করার জন্যে ডাই-হার্ড-স্ট্যামিনা আর ডু-আর-ডাই আত্মবিশ^াসে উজ্জীবিত করতে প্রায় সারাদিন মেজর জিয়া ট্রেনিং ও যুদ্ধের রণকৌশল শিক্ষা দিতেন। বৃহত্তর রংপুর জেলার রৌমারী, জামালপুর মহকুমার দেওয়ানগঞ্জ থানার উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম, নাগেশ^র ও ভূরুঙ্গামারি থানার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল রৌমারী মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস এই অঞ্চলটি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীমুক্ত ছিল। এই মুক্তাঞ্চলকে ধরে রাখা, সৈন্যদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া ও বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ঐ মুক্তাঞ্চল হতে প্রায় ১৮ হাজার গেরিলা যোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জেড ফোর্সই একমাত্র ব্রিগেড, যার সকল সদস্য তাদের অমূল্য জীবন বাজি রেখে বিখ্যাত সব সম্মুখ যুদ্ধে সফল হয়েছে। যেসব যুদ্ধ মেজর জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও রণকৌশলে হয়েছিল তার মধ্যে কামালপুরের প্রথম যুদ্ধ, বিলোনিয়ার যুদ্ধ, নকশী বিওপির যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ, দেওয়ানগঞ্জ থানা আক্রমণ, চিলমারি উভচর অভিযান, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়ানঘাট, টেংরাটিলা, গোবিন্ধগঞ্জ, সালুটিকার বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলি-ময়দান, এমসি কলেজের যুদ্ধ, ভানুগাছ যুদ্ধ, কানাইঘাট যুদ্ধ, বয়মপুর যুদ্ধ, ফুলতলা চা-বাগান যুদ্ধ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
জুলাই ‘৩৬’-এর গণঅভ্যুত্থানে পলাতক সাইকোপ্যাথ ইতিহাসের নিকৃষ্ঠতম লেডি স্বৈরাচার হাসিনা বলতেন, জিয়াউর রহমান নাকি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেননি? অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর জিয়া সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ ও ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ৩১ জুলাই ১৯৭১ ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের সাথে রণাঙ্গনে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতি উপজেলার কামালপুর গ্রামের নকশী বিওপিতে (বর্ডার আউট পোস্ট) পাকিস্তানী বাহিনীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ রেজিমেন্ট ৩১ বালুচ-এর বিপক্ষে অপারেশন চালান। ঐ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) ও ঢাকা বিশ^ বিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুজ্জামান (বীর উত্তম) শহীদ হন। কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্য জেড ফোর্সের ২৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক পদক পেয়েছেন, যা এস বা কে ফোর্স দূরের কথা মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে আর একটিও নেই। মেজর জিয়া সরাসরি ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের বিপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর সিলেটের গৌরিপুরে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ঐ দিন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন হাফিজ (বর্তমানে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য) যে ব্যাংকারে অবস্থান করছিলেন, তা থেকে মাত্র ১০০ গজ পূর্ব দিকে শত্রুপক্ষের ছোড়া একটি গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হন। শত্রুপক্ষের ছোড়া গোলাটি যদি ১০০ গজ পশ্চিমে পড়ত, তাহলে স্বাধীনতার ঘোষক ও একজন সেক্টর কমান্ডার ঐদিন শহীদ হতেন।
প্রবাসী সরকার মেজর জিয়ার মিলিটারি ট্যালান্সি দেখে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ও পরে জেড ফোর্সের মতো অদম্য একটি গেরিলা কমান্ডের অধিনায়ক করেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য তিনি স্ত্রীসহ দুই শিশুপুত্রকে আল্লাহর জিম্মায় রেখে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মরনপণ যুদ্ধ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেলেন বেঁচে থাকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘বীর উত্তম’। মুক্তিযুদ্ধ ও জিয়াউর রহমান সমার্থক। তারই নেতৃত্বে গড়া ওঠা জেড ফোর্স হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রেখেছে স্বর্ণালি স্বাক্ষর। এই গৌরবের সত্যিকার ইতিহাস জেন-জি’দের কাছে তুলে ধরা অতীব জরুরি। কারণ, তারা বিগত দেড় দশক শহীদ জিয়াকে ভিলেন জেনেছে।
লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফের ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক মার্তিনেজ
ফিফার বর্ষসেরা ভিনিসিয়ুস
আইয়ুব-সালমানের রেকর্ড জুটিতে জয় দিয়ে শুরু পাকিস্তানের
পঞ্চদশ সংশোধনী রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি
বন্দরে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিজয় দিবস পালন
নির্বাচিত সরকারই সংসদে পরিপূর্ণ সংস্কার করবে : আমীর খসরু
সাংবাদিক সামাদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
টানা তৃতীয়বার সিডিপির সদস্য হলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
ছিনতাইকারীর কবলে সোনারগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি
খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ পাবে মৌলিক অধিকার
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে ইইউ’র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল সাবেক ডিবি প্রধান হারুন ও জাহাঙ্গীর-তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রেল যাত্রীদের ভোগান্তি
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি কমেছে, বেড়েছে ভিয়েতনাম-ভারত থেকে
বাংলাদেশে অংশীদারিত্বে বড় সম্ভাবনা দেখছি সুইডেনের : নিকোলাস উইকস
এশীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে
স্টিভ ব্যাননের দাবি : ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন
‘সমগ্র বিশ্ব রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে রয়েছে’ : রাশিয়ার পারমাণবিক সুরক্ষা বাহিনীর প্রধান নিহত
ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের