হালাল উপার্জন ও হালাল আহার
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম
আল্লাহর বানী- ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে ও আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা জুমুআহ, আয়াত-১০) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন: যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা ব্যবসায়িক কার্জকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়ো’।
ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমতপূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি মানুষের জন্য যা কল্যানকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এবং যাবতীয় অকল্যান ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতীকে সতর্ক করেছে। এতএব ইসলাম মানবজাতীর জন্য কল্যানের আধাঁর হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। মানবদেহের জীবনীশক্তি হিসেবে রক্তের যে গুরুত্ব রয়েছে মানবজীবনে অর্থের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও তেমনি তাৎপর্য পূর্ণ। ফলে অর্থ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা হিসেবে পরিগণিত।
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত (যেমন নামাজ) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষণে জমীনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে ব্রতী হয়। রাসুল (সা.) নিজের পরিশ্রম লব্দ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে নিশ্চয় উপার্জনের পন্থা শরীয়াত র্নিধারিত পন্থায় হতে হবে। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে, যাতে প্রতারনা মিত্যা, ধোকাবাজি, জনসাধারণের অকল্যান সর্বোপরি জুলুম রয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ ও সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে। নি¤েœ এসম্পর্কে আলোচনা প্রদত্ত হলো :
ইসলাম সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে হালাল উপার্জনকে ফরজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন : আল্লাহর ফরজসমূহ আদায়ের পর হালাল উপার্জনের অন্বেষণও অন্যতম ফরজ। (মেশকাত শরীফ)। তিনি আরো এরশাদ করেন: ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। (আত্তারগীব ওয়াতর্তাহীব)। হানাফী মাজহাবের নির্ভরযোগ্য ইমাম আল্লামা সারুখসী তাঁর আল-মাবসুত গ্রন্থের তৃতীয় খ-ে ‘আলকাস্ব’ বা উপার্জন শীর্ষক একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন’। এতে একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, এক হাদীস শরীফে রয়েছে, যে ব্যক্তি হালাল রুজি অন্বেষণে মৃত্যু বরণ করেন, তাকে ক্ষমা করা হবে। হযরত ওমর ফারুক (রা.) হালাল রুজি অন্বেষণকে জিহাদ থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। রাসুল (সা.) হালাল রুজি উপার্জন কারী সাহাবীর ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তার হস্ত চুম্বন করেছেন। একটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) হযরত সা’দ বিন মাআজের সঙ্গে কমরমর্দন করেন। তিনি তার হাতের কাঠিন্য অনুভব করলেন। প্রিয় নবীজি (সা.) এর কারণ জানতে চাইলেন। হযরত সা’দ (রা.) বললেন, স্বীয় সন্তানদের ভরণ পোষণের জন্য বেলচা ও শাবলের কাজ করি। প্রিয় নবী (সা.) তার হাত চুম্বন করেন এবং বললেন, এ ধরনের হাতের তালুকে আল্লাহ পছন্দ করেন।
হযরত সা’দ (রা.) হালাল উপার্জনের কারণে আল্লার রাসুল (সা.) এর নিকট সম্মানিত হলেন। ইমাম গাজ্জালী (রা.) স্বীয় ‘ধারবাঈন’ গ্রন্থে ইবাদাতের দশটি সোপানের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন : নামাজ, যাকাত, রোজা, হজ্ব, তিলাওয়াতে কোরআন, যে কোন অবস্থায় আল্লাহর জিকির করা, হালাল উপার্জনের প্রচেষ্টা চালানো, প্রতিবেশী ও সঙ্গীর হক আদায়, মানুষকে সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা এবং রাসুল (সা.) এর সুন্নাতের অনুসরণ করা। হালাল উপার্জন সম্পর্কে আরো কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদীস নি¤েœ বর্ণিত হলো। ১। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেন: স্বীয় হস্তের উপার্জন করা আহারের চেয়ে উত্তম আহার কেউ কোনোদিন ভক্ষণ করেনি এবং আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) তাঁর স্বীয় হস্তের কর্ম দ্বারা উপার্জিত অর্থে আহার করতেন। (বোখারী শরীফ)। ২। ইমাম আহমদ, আল বাজ্জাজ এবং তিবরানী: বর্ণনা করেন রাসুল (সা.) কে উত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি বললেন, প্রত্যেক সৎ ব্যবস্থা এবং স্বীয় হস্ত দ্বারা উপার্জিত আয়। ৩। হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ঐ আহার সবচেয়ে উত্তম যা তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে করে থাক।
৪। ইবনে হাব্বান তাঁর ছহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে হালাল সম্পদ উপার্জন করে তারপর নিজে তা ভক্ষণ করে অথবা তা থেকে স্বীয় পরিধানের ব্যবস্থা করে অথবা নিজেকে ব্যতীত আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টিকে আহার করায় কিংবা তার পরিধানের ব্যবস্থা করে এটা তার গোনাহ থেকে পবিত্রতা অর্জনের উপায় হবে। ৫। হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, অনেক এমন গোনাহ রয়েছে যার কাফ্ফারা নামাজ, রোজা কিংবা ওমরা দ্বারা ও হয় না বরং জীবিকা উপার্জনের চিন্তা ও কষ্টের দ্বারা হয়ে থাকে। (ইবনে আসাকের, তিবরানী)। ৬। হযরত কা’ব বিন উজরা থেকে বর্ণিত! সাহাবা কেরামগণ এক ব্যক্তিকে দেখলেন সে খুব তাড়াতাড়ি কোন কাজে যাচ্ছে তার বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) যতি এটা আল্লাহর রাস্তায় হতো, তাহলে কতোই না ভালো হতো। রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন, যদি এ লোক তার পৌষ্য ছোট ছেলে-মেয়েদের জীবন জীবিকার নিমিত্তে বের হয়ে থাকে, তার এ চেষ্টাও আল্লাহর রাস্তায় বলে পরিগণিত হবে। যদি সে নিজ বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য বের হয়ে থাকে, তাও খোদার রাহে বলে পরিগণিত হবে। আর যদি লোকটি স্বীয় উপার্জনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকে, যাতে করে অন্যের নিকট হাত পাতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে এটাও খোদার রাহে বলে পরিগণিত হবে। হ্যাঁ যদি সে লোক দেখানো কিংবা গর্ব করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকে, তাহরে এটা শয়তানের রাস্তা বলে পরিগণিত হবে। (তিবরানী)
৭। ইমাম তিবরানী বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন: যতি কোন ব্যক্তি স্বীয় হস্তে কাজ করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বিকেলে ফিরেন, তার এ কাজ তার জন্য ক্ষমার কারণ হবে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ছহীহ হাদীস শরীফে হালাল জীবিকা অর্জনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আল্লামা ইউসুফ কারদাভী (রহ.) বলেন : প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি, যিনি ছাগল পালন করেননি। সাহাবা কেরামগণ জিজ্ঞাস করলেন : আপনি কি হে রাসুল (সা.) ছাগল চড়িয়েছেন? তিনি বললেন, আমি ও চুক্তি ভিত্তিক বেতনে মক্কাবাসীদের ছাগল চড়িয়েছি। মোহাম্মাদ রাসুল (সা.) এবং সমস্ত নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী বকরী চড়াতেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ বকরীগুলো তার নিজের ছিলনা, মক্কাবাসীর অন্য কারো ছিল যা নির্ধারিত বেতনের বিনিময়ে তিনি চড়াতেন। রাসুল (সা.) তাঁর অনুসারীদের নিকট এ কথা বর্ণনা করেছেন, তাদেরকে এ কথা শিক্ষা দেয়ার জন্য যে গৌরব ঐলোকের জন্য জিনি কাজ করেন। যারা আরাম প্রিয় ও অলস তাদের জন্য নয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত দাউদ (আ.) যুদ্ধের বর্ম তৈরি করতেন। হযরত আদম (আ.) কৃষিবিদ ছিলেন। হযরত নুহ (আ.) কাঠ মিস্ত্রি ছিলেন। হযরত ইদ্রিস (আ.) সেলাই কাজ করতেন এবং হযরত মুসা (আ.) রাখাল ছিলেন। (আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম পৃ: ১৩৯)। অতএব, হালাল রুজি অন্বেষণ করা এবং নিজ পরিবার পরিজনের খোরপোষের জন্য শরিয়তের বিধি-বিধান মতো প্রচেষ্টা চালানো মুসলমানের জন্য শুধু ফরজই নয় বরং ইহা অন্যতম ইবাদাত ও নবীদের সুন্নতও বটে। হযরত লোকমান (আ.) থেকে বর্ণিত, তিনি স্বীয় সন্তানকে বলেন : সৎ উপার্জন দ্বারা স্বীয় দারিদ্র থেকে মুক্তি অর্জন কর। কেননা, যে ব্যক্তি দারিদ্র থাকে তাকে তিনটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ধর্মীয় কাজে উদাসীনতা, জ্ঞানের দুর্রলতা, মনুষ্যত্বের পরিসমাপ্তি এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, জনগণ তাকে হেয় জ্ঞান করে। (দ্বীনুল ইলম শরহু আইনিল ইলম পৃ: ২৪০)। (চলবে)
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বগুড়ায় কনসার্টের ভীড়ে ছুরিকাঘাতে যুবকের মৃত্যু
অনলাইন জুয়ার প্রচারণায় বুবলী
রিংয়ে আমিনুল-সানজিদাদের উৎসব
চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত
আওয়ামী লীগকে কবর দিয়েছেন শেখ হাসিনা
রোচ-গ্রেভস জুটি ভাঙতে পারছে না বাংলাদেশ
মোমবাতি প্রজ্বলনে তাজরীন ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণ
সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ১৩ মামলার আসামী আ‘লীগ নেতা লায়েক গ্রেফতার
যার হাত ধরে পরীমনি এসেছিলেন চলচ্চিত্রে,তার মরণ দিনে করলেন খাসি জবাই
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন হচ্ছে লেকের নাম, নতুন নাম ‘মুগ্ধ সরোবর’
সোনারগাঁয়ে বিএনপির কার্যালয় উদ্বোধন
সেনবাগে ইসলামী আন্দোলনের গণ সমাবেশে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবী
পঞ্চগড়ে সিন্ডিকেট ভাঙতে তেঁতুলিয়ায় ৫৫ টাকায় আলু বিক্রি
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক ধর্ম উপদেষ্টা ড.খালিদ হোসেন
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!