থার্টিফার্স্ট নাইট : অপসংস্কৃতির বিষবাষ্প
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
খ্রিষ্টবর্ষের সর্বশেষ রাতের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উদযাপন করা হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট নামের অশ্লীল সংস্কৃতি। নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাতে সারারাত ধরে চলে নৃত্য, গান-বাজনা ও আনন্দ-উৎসব। নতুন ভোরকে বরণ করতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠনের আয়োজন করে থাকে। কেউ মাখায় রং, কেউ ফোটায় পটকা-বোম, কেউ লাগায় রঙিন বাতি এবং কেউ-বা করে আতশবাজি। রং-বেরঙের আলোতে সারা আকাশ রঙিন করে তোলে। খুশির আমেজে, আনন্দের আতিশয্যে শিশু-কিশোর-যুবারা জয়ধ্বনি তোলে। এভাবেই নাচ-গান, হই-হুল্লোড় ও নানা আয়োজনে একটি রাত পার করে।
একটা সময় এ সংস্কৃতি কেবল অমুসলিমরা পালন করলেও ক্রমশ তা মুসলিমদের সংস্কৃতিতেও জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমানে তো অমুসলিমদের চেয়ে নামসর্বস্ব মুসলিমরাই এ সংস্কৃতি পালনে অধিক অগ্রগামী, বেশি আগ্রহী। যাদের সংস্কৃতি, তাদের চেয়ে অন্যদের উচ্ছ্বাসই যেন বেশি! বিধর্মীরা যা করে, মুসলিমরা ঠিক তা-ই অনুসরণ করে। জন্মসূত্রে মুসলিম পরিচয় ছাড়া বিধর্মীদের সাথে তাদের কাজে বিশেষ কোনো পার্থক্য নজরে পড়ে না। বস্তুত শাশ্বত দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞতা, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিজাতীয় সংস্কৃতির কুফল সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই উম্মাহর আজ এমন করুণ অধঃপতন।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের সূচনা ও ইতিহাস : নববর্ষ পালনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সর্বপ্রথম মেসোপটেমীয় সভ্যতার লোকেরা নতুন বর্ষ উদযাপন শুরু করেছিল। তারা তাদের নিজস্ব গণনায় বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করত। এর বেশি তাদের ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না। এরপর ব্যক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম পারস্যের সম্রাট জামশেদের কথা জানা যায় যে, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দে ‘নওরোজ’ নামে নববর্ষ পালনের প্রথা চালু করেছিল। প্রাচীন পারস্যের মূল ভূখ- ইরানে এ ধারাবাহিকতা আজও বহাল আছে এবং ইরানে ‘নওরোজ’ (নতুন দিবস) ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে রোমে নববর্ষ পালন শুরু হয়। এর প্রায় একশ বছর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করে। তার সময়ে রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে বছরের প্রথম দিনটিকে ঔধহঁং (জানুস) দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো। রোমানরা এ দেবতাকে এড়ফ ড়ভ নবমরহহরহমং বা শুরুর স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করত। এ দেবতার নামানুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় ঔধহঁধৎু (জানুয়ারি)। এ মাস শুরু হলে তারা সেলিব্রেট করে তাদের দেবতা ঔধহঁং কে খুশি করে, যেন সে তাদের বছরটি মঙ্গলময় করে।
এটা হলো যিশু বা ইসা আলাইহিস সালাম এর জন্মের আগে নববর্ষ পালনের ইতিহাস। ইসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তাঁর জন্মের বছরকে সূচনাকাল ধরে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার আনে, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়ে থাকে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ও আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুসারে জানুয়ারি মাসের প্রথম তারিখ থেকেই শুরু হয় নতুন ইংরেজি বা খ্রিষ্টবর্ষের গণনা। এরপর ঊনিশ শতক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিউ ইয়ার’ পালন শুরু হয়। এই হলো থার্টি ফার্স্ট নাইটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ থেকে জানা যায়, নববর্ষ পালন বিজাতীয় সংস্কৃতি ও বিধর্মীদের কালচার। এর সাথে ইসলামের কোনোই সম্পর্ক নেই। বস্তুত রোমের মুশরিক সম্প্রদায় ও পারস্যের অগ্নিপূজারী জাতি হলো নববর্ষ পালনের উদ্ভাবক। তাই একজন মুসলিম হিসেবে তাদের অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও খ্রিষ্ট নববর্ষ পালনের সাথে শিরকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেননা, জানুস দেবতার নামে মাসের নাম ‘জানুয়ারি’ রেখে সেটার প্রথম তারিখকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে সেলিব্রেট করা হতো। তাই এ উৎসব থেকে আমাদের বিরত থাকা একান্ত জরুরি।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের ক্ষতিকর দিকসমূহ : মুসলিম হিসেবে আমাদের সবারই এ বিশ্বাস থাকা অপরিহার্য যে, ইসলামে যা কিছু হালাল বা অনুমোদিত, তার সব কিছুতেই রয়েছে মানব জাতির সমূহ কল্যাণ ও নানাবিধ উপকার। পক্ষান্তরে ইসলামে যা কিছু হারাম বা নিষিদ্ধ, তার সব কিছুতেই রয়েছে মানব সম্প্রদায়ের জন্য সুনিশ্চিত অকল্যাণ ও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি। সাধারণ মাসআলা হিসেবে যেহেতু আমাদের সবারই জানা যে, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ইসলামে নিষিদ্ধ, তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এতে অনেক অকল্যাণ ও ক্ষতি রয়েছে। নি¤েœ আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইটের কিছু দৃশ্যমান অকল্যাণ ও স্পষ্ট ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করছি।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে অশ্লীলতার ব্যাপক সয়লাব ঘটে। এ রাতে এমন সব অশ্লীলতা প্রকাশ পায়, যা বছরের অন্যান্য সময়ে খুব কমই দেখা যায়। মফস্বলের তুলনায় শহরে অশ্লীলতার মাত্রা থাকে বেশি। শহরের অভিজাত ক্লাব, আবাসিক হোটেল ও বাসা-ফ্ল্যাটে রাতভর চলে অসামাজিক কর্মকা-ের মহড়া। কী থাকে না এতে? বস্তুত যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য যা দরকার, তার সবই থাকে এসব অনুষ্ঠানে। গান, বাজনা, ডিজে (উলঙ্গ নৃত্য), আতশবাজি, যুবক-যুবতীদের বাধাহীন উল্লাস, মাদকদ্রব্য সেবনসহ এমন সব কর্মকা-ের আয়োজন করা হয়, যা তাদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম করতে প্রলুব্ধ করে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে অনেক যুবতীর সর্বনাশ ঘটে। অনেকে জেনে-বুঝে সর্বনাশা এ পথে পা বাড়ায়, আর কেউ-বা সরল বিশ্বাসে নিজের সর্বস্ব হারায়। সাময়িক উত্তেজনার মোহে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের খেসারতে শত শত মেয়ের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়। আলট্রা মডার্ন শহুরে তরুণীটি এ রাতের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বের হয়ে বাসায় ফেরে অপবিত্রতার চিহ্ন গায়ে লাগিয়ে। মফস্বলের সহজ-সরল বালিকাটিও বান্ধবীদের কথায় অনুষ্ঠানে গিয়ে রাতশেষে ক্যাম্পাসে ফেরে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। বস্তুত ভোগের লালসায় এ রাতে বখাটে ছেলেরা ফাঁদ পাতে—হয়তো বন্ধুত্ব দেখিয়ে, নয়তো শক্তি খাটিয়ে।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে চারদিকের হই-হুল্লোড় ও বিশৃঙ্খলায় রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। অসহনীয় শব্দদূষণ ও পটকাবাজির বিকট আওয়াজে শিশুদের ঘুম ভেঙে যায়। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে সে আতঙ্কিত চোখে। অসুস্থ লোক বিছানায় উঠে বসে থাকে নীরব রাতের অপেক্ষায়। পরীক্ষার্থী ছাত্রের পড়া থমকে যায়। নির্ঘুম রাত কাটে তার পড়াহীন অবস্থায়। শেষ রাতে তাহাজ্জুদগুজার বান্দার ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে। বারবার তার মনোযোগ নষ্ট হয়। শারয়ি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তো আছেই, অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকেও এভাবে মানুষকে কষ্ট দেওয়াটা যে কতটা অমানবিক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! থার্টি ফার্স্ট নাইটে প্রচুর অর্থের অপচয় করা হয়। রঙের খেলা, আতশবাজি, পটকাবাজি, নাচ-গান, বিভিন্ন পদের খাবার, হোটেল বুকিং, আনন্দ শোভাযাত্রা, দলবদ্ধভাবে বাইক চালনা ইত্যাদির জন্য অপ্রয়োজনীয় প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। ধনীর দুলালরা তো এসব অর্থ বাবার পকেট থেকে সহজেই সংগ্রহ করে, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত ছেলেদের এটার জন্য অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আফসোসের বিষয় হলো, কষ্টার্জিত এসব টাকা নিজের কল্যাণে ব্যয়িত না হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও নির্মল চরিত্র ধ্বংসের কাজে ব্যয়িত হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইট বর্তমানে যেভাবে ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু আয়োজকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং এর উত্তাপ ধীরে ধীরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এমন বস্তাপচা সংস্কৃতি যত বেশি বিস্তার লাভ করবে, আমাদের সন্তানসন্ততি ও পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা তত বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এমন সংস্কৃতির কারণে তাদের মাঝে বিজাতীয় কালচারের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেবে; ফলে নিশ্চিতভাবেই তারা বিধর্মীদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে এবং নিজেদের শাশ্বত দ্বীন, নির্মল চরিত্র ও সুস্থ সংস্কৃতিকে পুরোপুরিভাবে পরিত্যাগ করবে।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বগুড়ায় কনসার্টের ভীড়ে ছুরিকাঘাতে যুবকের মৃত্যু
অনলাইন জুয়ার প্রচারণায় বুবলী
চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত
আওয়ামী লীগকে কবর দিয়েছেন শেখ হাসিনা
রোচ-গ্রেভস জুটি ভাঙতে পারছে না বাংলাদেশ
মোমবাতি প্রজ্বলনে তাজরীন ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণ
সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ১৩ মামলার আসামী আ‘লীগ নেতা লায়েক গ্রেফতার
যার হাত ধরে পরীমনি এসেছিলেন চলচ্চিত্রে,তার মরণ দিনে করলেন খাসি জবাই
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন হচ্ছে লেকের নাম, নতুন নাম ‘মুগ্ধ সরোবর’
সোনারগাঁয়ে বিএনপির কার্যালয় উদ্বোধন
সেনবাগে ইসলামী আন্দোলনের গণ সমাবেশে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবী
পঞ্চগড়ে সিন্ডিকেট ভাঙতে তেঁতুলিয়ায় ৫৫ টাকায় আলু বিক্রি
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক ধর্ম উপদেষ্টা ড.খালিদ হোসেন
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা