আহলান সাহালান মাহে রমজানুল মোবারক ১৪৪৫
১৬ মার্চ ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪, ১২:১৫ এএম
মাহে রমজান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত এমনই এক বরকতময় ও নেয়ামতপূর্ণ মাস, যার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অন্য কোনো মাসেরই তুলনা চলে না। হিজরি চান্দ্রবর্ষের নবম মাসের আরবি নাম রমাদান ১৪৪৫ হিজরি ২০২৪। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা উচ্চারণে এটি হয় রমজান। রমাদান বা রমজান শব্দের অর্থ হলো প্রচ- গরম, সূর্যের খরতাপে পাথর উত্তপ্ত হওয়া, সূর্যতাপে উত্তপ্ত বালু বা মরুভূমি, মাটির তাপে পায়ে ফোসকা পড়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া, কাবাব বানানো, ঘাম ঝরানো, চর্বি গলানো, জ্বর, তাপ ইত্যাদি। রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রমজান। (লিসানুল আরব)।
স্বাগত রমজান : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (মুসলিম)। নবী করিম (সা.) এভাবে রমজানকে স্বাগত জানাতেন: ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (বুখারি)। এ মাসে রোযা রাখা আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর ফরজ হয়েছে তা না, অন্যান্য নবির উম্মতের উপরও তা ফরজ ছিল। রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংযম-পরহেজগারির মাধ্যমে বান্দার তাকওয়া অর্জন। কুরআনে কারীমের ঘোষণা, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা-১৮৩)। রমজান মাস কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন যেমন মহা মূল্যবান, রমজানও তেমনি মহামর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালার ইরশাদ, ‘রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। এ মাসটিতে এমন এক রাত রয়েছে, যে রাতে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি উত্তম। রমজান অত্যন্ত বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসে রহমতের অঝোরে বৃষ্টি নেমে আসে। জাহান্নাম তালাবদ্ধ হয়। শয়তান আটকে পড়ে। প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন, ‘রমযান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, শয়তানকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়।’ (বুখারী, ১৮৯৯)। এ মহান মাসে বান্দার জন্য রহমতের দরোজা খুলে যায়। হাদিসের ইরশাদ,‘রমজান মাস আসলে জান্নাতের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারী,১৮৯৮, মুসলিম, ১০৭৯)।
পূর্ববর্তীদের রোজা : এই আয়াতে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো, রোজা শুধু সর্বশেষ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়নি। অন্য ধর্মের অনুসারীদের ওপরও রোজা পালন করার বিধান ছিল। পৃথিবীর প্রথম নবী আদম (আ.) রোজা পালন করতেন। নুহ (আ.)-এর সময় প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার বিধান চালু ছিল। দাউদ (আ.) তাঁর শিশুপুত্রের অসুস্থতার সময় সাত দিন রোজা পালন করেন। মুসা (আ.) এবং ঈসা (আ.) ৪০ দিন করে রোজা রেখেছেন। আমাদের প্রিয়নবী মোহাম্মদ (সা.) রোজা ফরজ হওয়ার আগে মহররমের নবম ও দশম তারিখ রোজা রাখতেন। হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজানের রোজা ফরজ হিসেবে ঘোষিত হয়।তাহলে সহজেই অনুধাবন করা যায়, মাহে রমজানের রোজা পালন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই কেউ কোনো কারণ ছাড়া রোজা না রাখলে সে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য হবে। আর রোজা অস্বীকার করলে সে কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে।
রোযাদারের পুরস্কার : রোযাদারের রোযা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। রোযা লৌকিকতা বিবর্জিত এক আমল। যে আমল রিয়া বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত। এজন্য রোযার পুরস্কারও বিরাট। নবীজি সা ইরশাদ করেন.. যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী, ১৮০২) রোযার ইখলাসে বদৌলতে আল্লাহর কাছে (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) রোযাদারের মুখের দূর্গন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয়। রোযা এমন একটা মহান আমল, যার পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতেই দিবেন। প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন, যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ! রোযাদারের (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের (এক প্রকার দামি সুগন্ধি) চেয়েও অধিক প্রিয়। কারণ (আল্লাহ তায়ালা বলেন) রোযাদার কেবল আমার জন্যই পানাহার ও প্রবৃত্তির বাসনায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। রোযা কেবল আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (আর প্রত্যেক) সৎকাজের সওয়াবই দশগুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। (বুখারী : ১৮৯৪, মুসলিম, ১১৫১)।
রোযাদারের বিশেষ দু’টি আনন্দের কথা রাসূল সা বলেছেন, দু’টি আনন্দ রয়েছে, যা রোযাদারকে আনন্দিত করে। এক, যখন সে ইফতার করে। দুই, যখন সে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাত করবে, তখন (আল্লাহ প্রদত্ত) রোযার (প্রতিদানের) কারণে সে আনন্দিত হবে। (বুখারী, ১৯০৪, মুসলিম, ১১৫১)। কিয়ামতের দিন রোযাদারদের বিশেষ সম্মান অর্জিত হবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘জান্নাতে ‘রাইয়্যান’ নামক একটি দরজা রয়েছে, কিয়ামতের দিন যা দিয়ে শুধু রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কারোর এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার নেই। রোযাদাররা প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারি, ১৮৯৬, মুসলিম, ১১৫২)।
রমজানে গুনাহ মাফ : মাহে রমজানের মাস তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম ১০ দিন রহমত, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত এবং তৃতীয় ১০ দিন নাজাতের সময়। রমজান মাসে আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য অশেষ রহমত ও করুণা লাভের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেন। অতীতের সব গুনাহ মাফ পাওয়ার সুযোগ আসে রমজান মাসে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। রমজানের রাতে নামাজ আদায় করে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি)।
রমজানে ওষুধ সেবন : রমজানের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি অন্যতম। রোজা পালন ও তারাবির নামাজ আদায়ের জন্য এই উভয় প্রকার প্রস্তুতি খুবই প্রয়োজনীয়। যাঁরা নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ সেবন করেন, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি নির্ধারণ করে নেবেন। যাঁদের শারীরিক ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে হয়, তাঁদেরও সেই উপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। রমজানে হালাল খাদ্যের আয়োজন করতে হবে; ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবারের বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে। ইফতার ও সেহরির সুন্নত পালন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি যতœবান থাকতে হবে, যাতে ইবাদতের অসুবিধা না হয়। ইবাদতের অনুকূল ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্নতি লেবাসের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
পরিশেষে, মাহে রমজানের প্রতিটি ক্ষণ আমাদের অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে কাজে লাগানো উচিত। সারা বছরের পাথেয়, এমনকি সারা জীবনের পাথেয় অর্জন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় রোজা। রোজার মাসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের যে অনন্য উপহার ঘোষণা করা হয়েছে, তা যেন আমরা যথাযথভাবে লাভ করতে পারি, তার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। পরিতাপের বিষয় হলো, এ মাসেই একশ্রেণির ব্যবসায়ী সততা আর ন্যায়নীতি ভুলে অতি মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় নামে। তারা রমজান মাসকে মুনাফা লোটার প্রায় হাতিয়ার করে ফেলে। যথেচ্ছভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর এই প্রবণতা আমাদের ব্যবসায়ীদের কৃচ্ছ্র আর আত্মশুদ্ধির বিপরীতে নিয়ে গেছে যেন। রমজানে বিশেষ কিছু খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যায়। পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা দোকানিরা এই বাড়তি চাহিদাকে মুনাফা লোটার হাতিয়ার করে তোলে। অসৎ ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়।
রমজানের শিক্ষা অনুসরণের বদলে তারা যেন আরও সুযোগসন্ধানী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার হওয়া প্রয়োজন। সর্বসাধারণের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এ সময়ে চাল-ডাল-চিনি-ভোজ্যতেল-ছোলা-বুটসহ প্রধান খাদ্যশস্যের দামের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে। রমজানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংকট মানুষের দুর্ভোগের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নগরজীবনে অপরিহার্য উপকরণগুলোর সংকট কবে নিরসন হবে কে জানে! আমরা শুধু বলব, অন্তত রমজান মাসে যে কোনো উপায়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে নেওয়া হোক কার্যকর পদক্ষেপ। যানজট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে পুলিশ প্রশাসনকে।তাই আমাদের রোজা শুধুই যেন উপবাসের শামিল না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আসুন, রোজার মাসকে স্বাগত জানাই।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আওয়ামী দোসররা মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে: তানভীর হুদা
ফিলিস্তিনিদের জন্য কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে মিশরে পৌঁছেছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল
১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি
বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ
ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম