মানিক বন্দ্যোপাধ্যাপয়ের ‘চিহ্ন’

সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার অসামান্য শিল্পস্মারক

Daily Inqilab ড. মুসাফির নজরুল

১৬ মে ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১৬ মে ২০২৫, ১২:০৭ এএম

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়র ‘চিহ্ন’ (১৯৪৭) একটি নির্ভেজাল রাজনৈতিক উপন্যাস। ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের বিষয় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতা। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ-শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় তুমুল বিক্ষোভ। এ বছরের নভেম্বর মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের তিন সেনাসদস্যের দ-ের প্রতিবাদে দেশজুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন । ‘১৯৪৫ সালের ২১-২৩ নভেম্বরে আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবস উপলক্ষে কলকাতার ধর্মতলা মোড়ে সংঘটিত সাধারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলন, অবস্থান, পুলিশের লাঠিচার্জ, গুলি, মৃত্যু প্রভৃতি সত্যঘটনা ‘চিহ্নে’র পটভূমি। অবশ্য ১৯৪৬ সালের ১১-১৬ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ ফৌজ সদস্য রসিদ আলির দ-াজ্ঞা বাতিল ও মুক্তির দাবিতে সংঘটিত জনবিদ্রোহও এই উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাসে ব্যবহার করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।’ (গিয়াস শামীম, উপন্যাসের শিল্পস্বর)।
কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পাশর্^বর্তী ধর্মতলার মোড় চিহ্ন উপন্যাসের পটভূমি। মাত্র দু’দিনের সময়-পরিসরকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে এর ঘটনাংশ। ধর্মতলার মোড়ে ছাত্রদের অব¯’ান ধর্মঘট, দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, পুলিশের লাঠিচার্জ, অশ^ারোহী পুলিশ কর্তৃক সাধারণ জনতার ওপর নির্বিচার হামলা, গুলি, বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা, এবং পরিশেষে সংঘশক্তির বিজয় প্রভৃতি ঘটনার চিত্রাঙ্কনে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ। 
‘চিহ্ন’ উপন্যাসে আদ্যন্ত সমগ্র কোনো প্লট নেই। কোনো একটি কাহিনিকে কেন্দ্র করে এটি গড়ে ওঠেনি। এখানে রক্তমাংসময় কোনো নায়ক চরিত্রও নেই। এখানে আছে অজ¯্র ধারা, অজ¯্র চরিত্র। প্রত্যেকটি ধারা এসে পরিশেষে মিশে গেছে ধর্মতলার মোড়ে; বিপুল জনতার অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য এইখানে যে, প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলেও পরিশেষে তারা একটি একক ও নির্দিষ্ট ঐক্যে একীভূত হয়েছে  এবং লেখকের জীবনাদর্শের অভিমুখী হয়েছে। 
চিহ্ন উপন্যাসের কাহিনি আরম্ভ হয়েছে একুশ-বাইশ বছরের যুবক গণেশকে নিয়ে। সে কলকাতায় ‘বিদ্যুৎ লিমিটেড’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এন. দাশগুপ্ত চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত। তার ছিল অবৈধ মদ ও নারীব্যবসা। এই প্রতিষ্ঠানেই পণ্য সরবরাহের কাজ করে গণেশ। ধর্মঘটের দিনে গণেশকে জেমস স্ট্রিটের এল. ক্যামারন নামক জনৈক বিদেশির কাছে মদ পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিয়েছিল দাশগুপ্ত। কিন্তু রাজপথে বিপুল সংখ্যক মানুষের অবস্থান আর পুলিশি মহড়া দেখে সে থমকে যায়। গলির ধারের নিরাপদ ¯’ানে অব¯’ান করে সে বিপুল বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে তাদের গতিবিধি দেখতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে জনতার এই অব¯’ানকে হাঙ্গামা মনে করলেও একপর্যায়ে সে তার অজান্তেই এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। জনতার আন্দোলন-সংগ্রামে একাত্ম গণেশ গুলিবিদ্ধ হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর প্রাক-পর্যায়ে অচেনা ওসমানকে সে ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে : ‘এরা এগোবে না বাবু ?’ 
উপন্যাসে গণেশের মৃত্যুসূত্রে গ্রন্তি হয়েছে ওসমান-রসুল প্রসঙ্গ। ওসমান কারখানা-শ্রমিক, থাকে শিয়ালদার নিকটবর্তী একটি বস্তিতে। সে-ই গুলিবিদ্ধ গণেশকে পৌঁছে দিয়েছিল হাসপাতালে। তার চেতনায় বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল গণেশের শেষ উচ্চারণ - ‘এরা বসে দাঁড়িয়ে থাকবে বাবু? এগোবে না?’ 
পরদিন ভোরে ওসমানের ঘুম ভাঙে। এদিন সে ধর্মঘটের সমর্থনে কাজে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বস্তির অন্য শ্রমিকরাও তার সিদ্ধান্তে সায় দিলে বৃদ্ধ ওসমানের মনোবল বেড়ে যায় আরও বহুগুণ। অন্যদিকে ধর্মঘটের সুযোগে হানিফ ও বুধুলালের মতো গু-াশ্রেণি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। তারা দোকানপাট ভাংচুর ও লুটপাট করার চক্রান্ত করে। তবে ওসমানের নেতৃত্বে বস্তিবাসীরা এদের অপচেষ্টা প্রতিহত করে। ওসমান এরপর গণেশের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। হাসপাতালের পথে ওসমান অগণিত মানুষের জটলা দেখে। বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে এবং স্লোগান দিচ্ছে Ñ ‘জয় হিন্দ!’ ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ।’ ‘সা¤্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।’ 
‘চিহ্ন’ উপন্যাসের লেখক সচেতনভাবেই শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক সংগ্রামের কথাও তুলে ধরেছেন। দুর্ভিক্ষের সময় কলেজ-পড়–য়া রসুল লেখাপড়া ছেড়ে চলে আসে নিজগ্রাম চিরবাগীতে। সে দুর্ভিক্ষ-জর্জরিত গ্রামবাসীর জন্য ‘রিলিফ সেন্টার’ খোলার চিন্তা করে। তবে তার কাজের বিরোধিতা করে ‘অন্যায় অনাচার নোংরামি চোরাকারবারি’র সঙ্গে যুক্ত জমিদার শ্রীচপলাকান্ত বসু। রসুলকে নিবৃত্ত করতে তিনি তাঁর নায়েব নকুড় ভট্টাচার্যের পরিবর্তে নিয়োগ দেন জিয়াউদ্দীনকে। 
রসুল নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় জমিদার তার পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দেয় এবং তাকে আহত ও রক্তাক্ত করে।  শোষকশ্রেণির বাস্তব ও বিকৃত রূপকে মানিক তুলে ধরেছেন এখানে। শোষকের চরিত্র গ্রাম কিংবা শহরে অভিন্ন। তারা শোষণপ্রক্রিয়াকে নির্বিঘœ রাখার জন্য হীনচক্রান্ত করতেও দ্বিধাবোধ করে না, এমনকি রাষ্ট্রীয় শক্তিকেও তারা নানাভাবে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে দাশগুপ্ত, জমিদার শ্রী চপলাকান্ত ও খান বাহাদুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন। গণেশ, রসুল, আবদুল, হাবিব তাদের শোষণের শিকার। কলকাতা শহরেও রসুল থেমে থাকেনি। আন্দোলনের একপর্যায়ে তার ডানহাত গুলিবিদ্ধ হয়। প্রবল যন্ত্রণাকে সামলে নিয়ে এসময় সে নির্বিকারচিত্তে সহযোদ্ধা ওসমানকে উদ্দেশ্য করে বলে- ‘বাঁ হাতে সব হয়তো আবার অভ্যাস করতে হবে। সাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতে অসুবিধে হবে না এক হাতে কিন্তু-’
রাতের অন্ধকারে পুলিশের পাহারা এড়িয়ে রসুল মাকে দেখার জন্য হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসে। সন্তানের রক্তাক্ত হাত দেখে আমিনা বিলাপ শুরু করে। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ‘ছেলেটা আজাদির জন্য অনায়াসে মরতে পারে, মরবার জন্য তৈরি হয়ে আছে, টের পাবার পর থেকে আমিনার মনের এই জোরটা হু হু করে বেড়ে গেছে।’  শেষরাত্রে আবদুল রসুলকে ফিরিয়ে নিতে এলে মা আমিনার মনে হয় তিনি কেবল রসুলেরই মা নন, আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত সবারই তিনি মা। 
উপন্যাসে গণেশ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে এন. দাশগুপ্তের ব্যবসা প্রসঙ্গ। বিদ্যুৎ লিমিটেডের আড়ালে তার রয়েছে বেনামি ঘরোয়া হোটেল, নাইট ক্লাব ও বার। যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ কীভাবে সম্পদশালী হয়েছে তা এ-প্রসঙ্গে প্রদর্শন করেছেন মানিক। এসব ব্যবসায়ী মানবিক অনুভূতি হারিয়ে যে পশুত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গণেশের মৃত্যুপরবর্তী পর্যায়ে তার পরিবারের সঙ্গে এন. দাশগুপ্তের বিরূপ আচরণসূত্রে। গণেশের মৃত্যুর জন্য নয়, দাশগুপ্তের সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেবলই তার ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে। দেশ, মানুষ কিংবা মানবমুক্তির আন্দোলনের প্রতি তার কোনো আগ্রহই নেই। 
রাজপথে আন্দোলনরত ‘বজ্জাত ছোকরাগুলো’র প্রতি এন. দাশগুপ্তের কোনো আগ্রহ কিংবা সহানুভূতি নেই, বরং সে হাসপাতাল থেকে চোরাই মাল উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে সে পরামর্শ করে ‘পরম বিশ^াসী ধূর্তশ্রেষ্ঠ’ কর্মচারী চন্দ্রের সঙ্গে; কারণ তার প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে চন্দ্র। যুদ্ধের বাজারে দশগুপ্তের মতো সেও অনৈতিক পন্থায় অঢেল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে। যে-মুহূর্তে গণেশ হাসপাতালের মর্গে, ঠিক সে-মুহূর্তে মধুখালী গ্রামে তার পরিবার যাপন করছে ভয়ার্ত ও বিপর্যস্ত জীবন। শেষে গোলযোগময় কলকাতায় অজয় নামের এক যুবকের সহযোগিতায় গণেশের বাবা-মা-বোন পৌঁছে যায় ‘বিদ্যুৎ লিমিটেডে’র নির্ধারিত ঠিকানায়। 
হেমন্তের বক্তব্যের পাল্টা-উত্তর অনুরূপার জানা নেই। তিনি কর্মজীবী ও বুদ্ধিমতী নারী; দুটি ছেলে হেমন্ত-জয়ন্ত ও মেয়ে রমাকে নিয়ে তাঁর সংসার। গানের টিউশনি করে তিনি পারিবারিক ব্যয়নির্বাহ করেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের ঘনঘটা তার পরিবারকে আক্রান্ত করুক- এটি তিনি চান না। তাঁর মনে হয়, ওসব ‘দূরের বিপদ, বহু দূরের’। তাঁর এ ছোট্ট সংসারে এর আঁচড় লাগবে না। কিনতু দেশপ্রেমের কাছে তাঁর এই অন্তর্গত আকাক্সক্ষা শেষাবধি তুচ্ছ প্রমাণিত হয়। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জয়ন্তও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেও তার সমবয়সীদের সঙ্গে রাজপথে ‘ইনক্লাব, জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম্’ - স্লোগান দিতে থাকে। 
‘চিহ্ন’ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র অক্ষয়। উপন্যাসে অক্ষয় মদের নেশায় আসক্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি প্রতিদিন স্ত্রী সুধার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেন মদ খাবেন না বলে, অথচ প্রতিদিনই বাড়ি ফেরেন নেশায় বুঁদ হয়ে। রাজপথের আন্দোলনে তাঁরও মনোজগতে পরিলক্ষিত হয় বিস্ময়কর পরিবর্তন; প্রাত্যহিকতায় ঘটে ছেদ। অক্ষয়ের মনে হয়, আজকের এই ব্যতিক্রমী দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হলেও তাঁর মদ্যপান প্রয়োজন। যে-মুহূর্তে অক্ষয় মদ খাওয়া-না খাওয়ার দ্বন্দ্বে দ্বিধাগ্রস্ত ঠিক সে-মুহূর্তে অফিসের সহকর্মী মনমোহনের সঙ্গে ফুটপাথে দেখা হয় তাঁর। অন্যদিনের মতো অক্ষয়কে এড়িয়ে যায় না মনমোহন; বরং একটুখানি মমতা বোধ করে। 
চিহ্ন উপন্যাসে অমৃত মজুমদার প্রসঙ্গে সমকালীন কতিপয় রাজনীতিবিদের সুবিধাবাদিতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। এরা যশ, খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি অর্জনের প্রতিযোগিতায় ছিল ব্যস্ত। জনকল্যাণের নামে তারা ব্যক্তিগত ধন-সম্পদের পাহাড় গড়তে চায়। রাজপথের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করলেও নেতৃত্বদানের স্পৃহা তাদের মধ্যে ছিল প্রবল। উপন্যাসে এই নেতাদের একজন বসন্ত রায়। তাঁর বার্তা নিয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘট নিবৃত্ত করতে যান অমৃত মজুমদার। ছাত্রদের তিনি পুলিশি নির্যাতনের স্মৃতি ভুলে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দেন। পুলিশের লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণের পর এমন পরামর্শ ছাত্ররা তৎক্ষণাৎ অগ্রাহ্য করে। তাই অমৃত মজুমদার হতাশ হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরেন। এই পর্যায়ে স্ত্রী অরুণা মজুমদার তাঁকে তিরস্কার করেন এবং বসন্তবাবুর অনুপস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের নেতৃত্ব বাগিয়ে নেয়ার জন্য স্বামীকে পরামর্শ দেন। স্ত্রীর উপর্যুপরি তাগিদে উৎসাহিত হয়ে অমৃত অতঃপর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং সভাস্থলে গিয়ে পুনরায় বক্তৃতা করার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পথিমধ্যে স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ শুনে তিনি নিবৃত্ত হন। স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর নেতা হওয়ার বাসনা শেষ পর্যন্ত অপূর্ণই থেকে যায়। 
‘চিহ্ন’ উপন্যাসে অজয় একজন সামান্য কেরানি। সংসারের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হওয়ায় সে শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখে চাকরিতে যোগ দেয়। ধর্মঘটীদের ওপর পুলিশের গুলি সে মেনে নিতে পারেনি। এজন্য অফিসে না গিয়ে সে মিছিলে যোগ দেয়। অজয়েরই বোন মাধু। দরিদ্র পরিবারে মায়ের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। অবশেষে জীবনকে সে জয় করতে সক্ষম হয়েছে। জীবনের সর্ববিধ বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে সে বুঝে নিয়েছে সংঘ-শক্তিতে জাগ্রত হতে পারলেই কেবল মানবমুক্তি সম্ভব। এজন্য ভাই অজয় ও তার বন্ধু নিরঞ্জনের সঙ্গে সেও প্রতিবাদী জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। 
‘চিহ্ন’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাম ও শহরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভিন্ন সূত্র উদ্ঘাটন করেছেন। শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য শোষিত মানুষের সংগ্রামের অনিবার্যতাকেই শেষাবধি তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। উপন্যাসে যাদবকন্যা শোষকশ্রেণি কর্তৃক নির্যাতিত হলে গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে। গ্রামবাসীর সম্মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হয় শোষক শক্তি। শোষকশক্তির এ-পরাজয় যে ক্ষণস্থায়ী তাও তিনি স্পষ্ট করেছেন যাদব পরিবারের গ্রামত্যাগের তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে। অবশ্য এর মাধ্যমে যাদবের মনোলোকে উন্মোচিত হয়েছে এক নতুন সত্য।
‘চিহ্ন’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শোষক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বজনীন প্রতিবাদের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে কোনো চরিত্রকেই এককভাবে প্রাধান্য দেননি। কোনো রক্তমাংসময় নায়ক চরিত্রও এ-উপন্যাসে নেই। রাজপথই হয়ে উঠেছে এ-উপন্যাসের ঘটনাধারার নিয়ন্ত্রক-শক্তি। গণেশ, ওসমান, রসুল, অক্ষয়, রজত, সীতা, হেমন্ত, আমিনা, জয়ন্ত, মনমোহন, নারায়ণ, শান্তি, আবদুল- প্রত্যেকটি চরিত্র তাদের প্রবল উপস্থিতি ও প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে রাজপথে হয়ে গেছে একাকার। অপরদিকে অমৃত মজুমদার, অরুণা মজুমদার, এন. দাশগুপ্ত, চন্দ্র, যাদব, গণেশের মা, সুধা, রাণী, পরীবানু, অলকা, অনন্ত প্রমুখের মাধ্যমে উপন্যাসের কাহিনি অর্জন করেছে বিশ^াসযোগ্য ভিত্তি। ‘মিছিলের ও ব্যাপক গণ-সংগ্রামের জোয়ারকে কেন্দ্র করে এই বইটি রচনা করতে গিয়ে লেখক বহু চরিত্রের উপস্থাপন করেছেন এবং তারা এক একটি স্কেচের মতো মনে হলেও সামগ্রিকভাবে একটি যুগ ও যুগের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করতে পেরেছে।’
উপন্যাসের শুরুতে আহত ও রক্তাক্ত গণেশের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা- ‘এরা  এগোবে না বাবু?’ - পরিশেষে এভাবেই সম্পূর্ণতা পেয়েছে; এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অভীপ্সা অর্জন করেছে যৌক্তিক ভিত্তি। ‘চিহ্ন’ উপন্যাসটি তাই হয়ে উঠেছে সংঘশক্তির চিহ্ন, রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতার চিহ্ন, সর্বস্তরের মানুষের জাগরণের চিহ্ন, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অভীপ্সার চিহ্ন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার আক্ষেপ ক্লাব বিশ্বকাপে ঘোচাতে চায় ইন্টার

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার আক্ষেপ ক্লাব বিশ্বকাপে ঘোচাতে চায় ইন্টার

বিজিবির অভিযানে মে মাসে ১৩৩ কোটি ১১ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ

বিজিবির অভিযানে মে মাসে ১৩৩ কোটি ১১ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ

পরিবহন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ৭টি ওমরাহ কোম্পানি স্থগিত

পরিবহন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ৭টি ওমরাহ কোম্পানি স্থগিত

রাশিয়ার হামলায় কিয়েভে মার্কিন নাগরিকসহ নিহত ১৪

রাশিয়ার হামলায় কিয়েভে মার্কিন নাগরিকসহ নিহত ১৪

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল না হলে আন্দোলন চলবে

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল না হলে আন্দোলন চলবে

জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া ‘বিশাল ভুল’ ছিল: ট্রাম্প

জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া ‘বিশাল ভুল’ ছিল: ট্রাম্প

সাকিব আল হাসানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

সাকিব আল হাসানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

এস আলমের ২০০ একর জমি জব্দের নির্দেশ আফতাবুলের ৯৪ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

এস আলমের ২০০ একর জমি জব্দের নির্দেশ আফতাবুলের ৯৪ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

নগর ভবন অচলাবস্থার জন্য এই সরকার দায়ী : ইশরাক

নগর ভবন অচলাবস্থার জন্য এই সরকার দায়ী : ইশরাক

বাবার যত্নে ওষুধ, মেডিকেল টেস্ট, হেলথ চেকআপে বিকাশ পেমেন্টে ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাক

বাবার যত্নে ওষুধ, মেডিকেল টেস্ট, হেলথ চেকআপে বিকাশ পেমেন্টে ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাক

শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস ও পাঠ্যবই রচনা করেছিল: রিজভী

শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস ও পাঠ্যবই রচনা করেছিল: রিজভী

‘ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারবে না’

‘ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারবে না’

ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার দাবীতে বিশ্বনাথে স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ-দোয়া মাহফিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার দাবীতে বিশ্বনাথে স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ-দোয়া মাহফিল

দোয়ারাবাজারে সড়ক দূর্ঘটনায় গরুটি মৃত্যু  আহত ৪

দোয়ারাবাজারে সড়ক দূর্ঘটনায় গরুটি মৃত্যু আহত ৪

জুবাইদা রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে ২ দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন

জুবাইদা রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে ২ দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন

সুন্দরগঞ্জে জামের গাছ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু

সুন্দরগঞ্জে জামের গাছ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু

ভবিষ্যতে ছেড়ে দেব এমন কথা বললে তালাক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে।

ভবিষ্যতে ছেড়ে দেব এমন কথা বললে তালাক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে।

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্ন

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্ন

সকলের দৃষ্টি এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে

সকলের দৃষ্টি এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে