ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫ | ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

খরা ও কাক

Daily Inqilab বিচিত্র কুমার

১৩ জুন ২০২৫, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:১৪ এএম

পৃথিবীর আকাশটা আগের মতো নীল থাকে না আজকাল। আগুনের মতো সূর্য মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে দুপুরবেলায়, চারপাশে শুধু হাঁসফাঁস করা বাতাস আর তপ্ত ধুলো। গাছেরা নির্বাক, নদী শুকিয়ে গেছে, মাঠে ফাটল পড়েছে, আর পুকুরে কেবল কাদার গন্ধ। এমন এক ভয়ংকর গরম আর খরায় পুড়ে যাওয়া সময়ে, বাংলাদেশের এক গ্রামে ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা একটা সাধারণ কাক হয়ে উঠল শিক্ষকের মতো, জাগিয়ে তুলল সবাইকে।

গ্রামটার নাম মাটিকাটা। একসময় চারদিকে সবুজে ঘেরা এই গ্রাম এখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ছে। টিউবওয়েলগুলো শুকিয়ে গেছে, ছোট ছোট পুকুরে আর এক ফোঁটা জলও নেই। মাঠঘাট চৌচির, ফসল ফলছে না। মানুষেরা শহরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে দলে দলে—জলের খোঁজে, জীবনের খোঁজে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, “ঈশ্বর রাগ করেছেন। বৃষ্টি আসছে না কেন?” কেউ বলছে, “সব গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল!” কিন্তু প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ আসলে কিসের ফল, তা গভীরভাবে ভাববার মতো সময় বা চেতনা যেন আর কারও নেই।
গ্রামের মাঝখানে একটা শুকনো তালগাছের মাথায় বসে থাকত একটি কাক। কালো, সাধারণ, আর পাঁচটা কাকের মতোই, কিন্তু তার কিছু অভ্যাস ছিল একটু অন্যরকম। তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না, কিন্তু একটা ছোট ছেলে মজা করে নাম দিয়েছিল “বুড়ো কাক”। সেই নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে সে।

বুড়ো কাকের চোখে যেন একটা বোধ ছিল চারপাশের পরিবর্তনটা সে টের পাচ্ছিল। তাকে দেখা যেত একা একা শুকনো পুকুরের ধারে ঘুরতে, মাঝেমাঝে ধুলোময় জমিতে ঠোঁট দিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে, আর কোনো অদ্ভুত কারণে মাটির ছোট ছোট গর্তে কিছু একটা পুঁতে রাখতে। প্রথমে কেউ এইসব খেয়াল করত না। কিন্তু একদিন এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, রাশেদ মাস্টার, যিনি শহরের বড় কলেজে পড়িয়ে এই গ্রামে ফিরে এসেছেন, বুড়ো কাকের অদ্ভুত আচরণ লক্ষ করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, কাকটি শুকনো মাটির গর্তে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো আর পাথর রেখে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে সে পুরনো কুয়োর ধারে গিয়ে কিছু একটা সরানোর চেষ্টা করছে।

রাশেদ মাস্টার ছিলেন চিন্তাশীল মানুষ। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। আগেও অনেকবার তিনি গ্রামে বসে বলার চেষ্টা করেছিলেন “এই খরা প্রাকৃতিক নয়, এটা আমাদের কাজের ফল। বন কেটেছি আমরা, জ্বালানি পোড়াচ্ছি আমরা, শহর বানাতে গিয়ে গাছপালা ধ্বংস করেছি আমরা। এখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে।” কিন্তু গ্রামের মানুষ এসব শুনে হাসত। কেউ পাত্তা দিত না।

কিন্তু একদিন ঘটনা এমনভাবে মোড় নিল, যা সবাইকে স্তব্ধ করে দিল।
সেইদিন রাশেদ মাস্টার সকালে হাঁটতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের একদম প্রান্তে। সেখানে একটা পুরনো কলাবাগান ছিল, পাশে একটা মরা ঝর্ণার মতো জায়গা। বহু বছর আগে সেখানে পানি ছিল, এখন সেখানে কেবল পাথর আর শুকনো মাটি। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, সেই জায়গা থেকে একটু একটু করে জল গড়িয়ে পড়ছে একটা ছোট গর্তে। আর আশ্চর্যজনকভাবে বুড়ো কাকটা রোজ সকালে এসে একটা বড় পাথর ঠোকর মেরে সরে নিচ্ছে, যার নিচেই জল আটকে ছিল।

তিনি কয়েকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করলেন—প্রতিদিন ভোরবেলা কাকটা এসে পাথরটা ঠোকরায়, জল বের হয়, আর সে চঞ্চলভাবে তার ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। এই দৃশ্য রাশেদ মাস্টারের চোখে জল এনে দেয়। তিনি বুঝলেন এটা কোনো সাধারণ কাক নয়, প্রকৃতি যেন নিজের ভাষায় এই পাখিটার মাধ্যমে একটা বার্তা পাঠাচ্ছে। মানুষ যেখানে শুধু অভিযোগ করছে, সেখানে একটা কাক সমাধান খুঁজে চলেছে!

তিনি ছুটে গেলেন পঞ্চায়েত কার্যালয়ে। সব গ্রামের মানুষকে ডেকে বললেন, “বন্ধুরা, তোমরা ঈশ্বরের উপর রাগ করছ, প্রকৃতিকে দোষারোপ করছ। কিন্তু আমরা নিজেরা কী করেছি তা একবার ভেবে দেখেছো? এই কাক, যাকে তোমরা অশুভ ভাবো, সে আজ আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়।”

প্রথমে সবাই হাসল। কেউ বিশ্বাস করল না। কিন্তু রাশেদ মাস্টার সবার হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন কাকের কর্মকা-। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ সচেতন হতে শুরু করল। যারা এতদিন অলস বসে থাকত, তারা কুয়ো পরিষ্কার করতে শুরু করল। পুকুর খোঁড়া শুরু হলো। শহরের একটা পরিবেশবাদী সংগঠন এসে জল সংরক্ষণের পদ্ধতি শেখাল ছাদে জল ধরে রাখার ট্যাংক, রান্নার জল রিসাইক্লিং, শুষ্ক টয়লেট এসব নতুন ধারণা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা ছিল মনোভাবের। মানুষ বুঝতে শুরু করল, কেবল প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে কিছু হবে না। গাছ লাগাতে লাগাতে তারা ভাবল এই কাক আমাদের মতো খাবারের জন্য লড়েনি, আশ্রয়ের জন্য কাঁদেনি, শুধু চেষ্টা করেছে। নিজের সামান্য শক্তিতে, নিজের মতো করে।

একদিন হঠাৎ করেই বুড়ো কাক আর দেখা গেল না। কেউ বলল সে অন্য কোথাও চলে গেছে, কেউ বলল বুড়ো কাক আর নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে সে এক প্রতীক হয়ে উঠল পরিবর্তনের, সচেতনতার, আর প্রকৃতির ভাষার।

রাশেদ মাস্টার একদিন নিজের খাতায় লিখলেন “প্রকৃতি নিজের কথা বলছে। আমরা শুনছি কি?”
আজ মাটিকাটা গ্রাম অনেকটাই বদলে গেছে। ফসল আবার উঠছে, পানির স্তর কিছুটা হলেও বেড়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রজেক্ট করছে। রাশেদ মাস্টার এখনও বলেন, “আমাদের বাঁচিয়েছিল একটা কাক। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সে আসলে ছিল প্রকৃতির দূত। আমাদের কেবল দরকার ছিল চোখ খোলা রাখা, আর মন দিয়ে শুনা।”

এই গল্প কোনো রূপকথা নয়, এটা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই আজ বুড়ো কাকেরা আছে কখনো গাছ হয়ে, কখনো পাখি হয়ে, কখনো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে। প্রশ্ন হলো আমরা কি তাদের কথা শুনছি?


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জুলাই-আগস্টে গণহত্যা: হাসিনা-কামালের বিচার শুরুর আদেশ

জুলাই-আগস্টে গণহত্যা: হাসিনা-কামালের বিচার শুরুর আদেশ

আবারও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বেজে উঠল সাইরেন

আবারও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বেজে উঠল সাইরেন

অর্থকষ্টে ফর্ম ফিলাপ করতে না পারা শিক্ষার্থীর পাশে ইবি ছাত্রদল নেতা

অর্থকষ্টে ফর্ম ফিলাপ করতে না পারা শিক্ষার্থীর পাশে ইবি ছাত্রদল নেতা

১০০ বছর পূরণ করলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির

১০০ বছর পূরণ করলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির

শ্রমিক কল্যাণে বেক্সিমকো ফার্মার ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অনুদান

শ্রমিক কল্যাণে বেক্সিমকো ফার্মার ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অনুদান

দুমকীতে জেলা বিএনপির নবনির্বাচিত নের্তৃবৃন্দের সৌজন্যে সাক্ষাৎ

দুমকীতে জেলা বিএনপির নবনির্বাচিত নের্তৃবৃন্দের সৌজন্যে সাক্ষাৎ

বাবার চিকিৎসার জন্য গিয়ে ভারতীয়দের রোষানলে বাংলাদেশি যুবক! ভিডিও ভাইরাল

বাবার চিকিৎসার জন্য গিয়ে ভারতীয়দের রোষানলে বাংলাদেশি যুবক! ভিডিও ভাইরাল

ফরিদপুরে ডেঙ্গুসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগী হাসপাতাল ঠাঁসা , রোগী সুস্থের ফল আপেল- মাল্টা - আঙুর বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে

ফরিদপুরে ডেঙ্গুসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগী হাসপাতাল ঠাঁসা , রোগী সুস্থের ফল আপেল- মাল্টা - আঙুর বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে

আরও সাতটি দেশের পণ্যে নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প

আরও সাতটি দেশের পণ্যে নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প

ইয়েমেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হতচকিত ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র

ইয়েমেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হতচকিত ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র

চিরিরবন্দরে ডাম্পট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ইপিজেড কর্মী নিহত

চিরিরবন্দরে ডাম্পট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ইপিজেড কর্মী নিহত

এবার সউদী আরবে সম্পত্তি কিনতে পারবে প্রবাসীরা

এবার সউদী আরবে সম্পত্তি কিনতে পারবে প্রবাসীরা

অবশেষে ২০ দিন পর খুলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ

অবশেষে ২০ দিন পর খুলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ

‘হাসিনাকে রক্ষা করা অনৈতিক’—ভারতের প্রতি প্রেস সচিবের কড়া বার্তা

‘হাসিনাকে রক্ষা করা অনৈতিক’—ভারতের প্রতি প্রেস সচিবের কড়া বার্তা

বকশীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নারীসহ সাত জনকে পুশইন

বকশীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নারীসহ সাত জনকে পুশইন

হাসিনার গুলির নির্দেশ: ফাঁস হওয়া অডিও যাচাইয়ের পদ্ধতি প্রকাশ করল বিবিসি

হাসিনার গুলির নির্দেশ: ফাঁস হওয়া অডিও যাচাইয়ের পদ্ধতি প্রকাশ করল বিবিসি

হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আজ

হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আজ

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের তিন দিনের শুল্ক আলোচনা শুরু

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের তিন দিনের শুল্ক আলোচনা শুরু

হাবিপ্রবিতে কর্মকর্তাদের মধ্য হতে রেজিস্ট্রার, পরিচালক নির্ধারিত পদে নিয়োগের দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি

হাবিপ্রবিতে কর্মকর্তাদের মধ্য হতে রেজিস্ট্রার, পরিচালক নির্ধারিত পদে নিয়োগের দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি

জুনিয়রদের সমকামিতায় বাধ্য করায় সাত ইসরায়েলি সেনা আটক

জুনিয়রদের সমকামিতায় বাধ্য করায় সাত ইসরায়েলি সেনা আটক