সউদী-ইরানের নতুন করে বন্ধুত্ব কতটা শক্তিশালী হবে

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০৮ জুন ২০২৩, ০১:২৩ পিএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩, ০১:২৩ পিএম

সাত বছর পর রিয়াদে মঙ্গলবার খুলেছে ইরানের দূতাবাস। ধারণা করা হচ্ছে খুব দ্রুত তেহরানেও খুলছে সউদী দূতাবাস। যে দুই দেশের শত্রুতা আর রেষারেষি গত চার দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে বিপর্যস্ত করেছে সেই ইরান আর সউদী আরব মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় এক চুক্তি করার পর থেকে যেভাবে দ্রুত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বিস্মিত হওয়ার মতো।

তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে যাত্রী বিমান চলাচল শুরু হচ্ছে। একজন ইরানি সউদী আরবে ৮ লাখ ডলারের কোরান তেলাওয়াতের এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। ইরান থেকে সউদী আরবে ইস্পাত রপ্তানি শুরু হয়েছে। সুদানে আটকে পড়া ৬০ জন ইরানি নাগরিককে সউদী নৌবাহিনী উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর ইরান ও সউদী কর্মকর্তাদের কোলাকুলি করতে দেখা গেছে। এবং ইরানের সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে খুব শিঘ্রি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রিয়াদ সফরের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই সফর হলে তা হবে ২০০৭ সালের পর কোনো ইরানি নেতার সউদী সফর।

এসব উদ্যোগের পেছনে কপটতা দেখেছেন না বিশ্লেষকরা, তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সউদী আরব আর ইরানের এই সখ্যতার ভিত্তি কতটা শক্ত? কতদিন তা টিকবে? এই সন্দেহের মূলে রয়েছে এই দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের দীর্ঘ ইতিহাস যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে কম-বেশি বিপর্যস্ত করেছে। যে টানাপড়েনের মূলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব নিয়ে শিয়া ইরান এবং সুন্নি সউদী আরবের অব্যাহত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে আরব বিশ্বে ইরানের বিরুদ্ধে সন্দেহ বহুগুণে বেড়ে যায়। বিশেষ করে সউদী আরব এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো ভয় পেয়ে যায় আয়াতোল্লাহ খোমেনি হয়তো এখন তার ধর্মীয় বিপ্লবের রেসিপি আশপাশে রপ্তানি শুরু করে দেবেন। ফলে, তখন থেকেই ইরান এবং প্রতিবেশী সুন্নি আরব দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা আর রেষারেষি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের সারাহ জাইমি সম্প্রতি তার এক গবেষণা নিবন্ধে লিখেছেন ১৯৮০র দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ থেকে শুরু করে একে এক লেবানন, ইয়েমেন এবং সবশেষে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের মূলে রয়েছে সেই রেষারেষি।

ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত শিয়া হুতি মিলিশিয়াদের বিদ্রোহ দমনে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সউদী আরব। লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া হিজবোল্লার প্রভাব খর্ব করতে সেদেশের সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে সউদীরা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারের সমর্থনে ইরান অস্ত্র আর যোদ্ধা পাঠাতে শুর করলে সউদীরাও আসাদ বিরোধীদের সাহায্য-সহযোগিতায় নেমে পড়ে।

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সাদি হামদি বিশ্বাস করেন ইরান ও সউদী আরবের মধ্যে এই বৈরিতা এবং সন্দেহ এতই গভীর যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে একটি বোঝাপড়ায় তা দূর হবেনা। ‘এটি সাময়িক একটি সন্ধি, সমাধানের কোনো সূচনা নয়। বড় কোনও অগ্রগতি নয়। সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা আগেও একাধিকবার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট খাতামি সউদী আরবে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ গিয়েছিলেন। তখন সম্পর্ক নিয়ে ভালো ভালো কথা হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন পর আবার যা তাই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন হামদি।

কিন্তু কেন এখন এই সন্ধি করতে উদ্যোগী হলো দুই দেশ? হামদি মনে করেন বিশেষ করে সউদী আরব চাপে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়েই এই পথে গেছে। নয় বছর ধরে যুদ্ধের পরও সউদী আরব ইয়েমেনে তাদের সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে ব্যর্থ হয়েছে। হুতিদের বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হচ্ছে। সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাতের চেষ্টায় কাজ হয়নি।

সেই সাথে, সউদী তেলের উপর আমেরিকার নির্ভরতা কমার সাথে সাথে গত প্রায় দশ বছর ধরে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ছে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। সউদীদের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি করেন বারাক ওবামা। ২০১৯ সালে সউদী আরবের সবচেয়ে বড় তেলের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে ইরানের হাত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে কিছুটা বাধ্য হয়েই চিরশত্রু ইরানের সাথে একটি বোঝাপড়ার পথে গেছে সউদী আরব। অর্থনীতির প্রয়োজনও সউদী সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে।

ভিশন ২০৩০ (টুয়েন্টি থার্টি) যুবরাজ মোহামেদ সালমানের এখন ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নেয়া তার ঐ উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনায় গত ছয় বছরে পশ্চিমাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ তিনি পাননি। উপরন্তু ইয়েমেন এবং ইরাক থেকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা সউদী আরবের নিরাপত্তা যেভাবে হুমকিতে ফেলেছে তাতে তিনি বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনতে পারছেন না। ‘বিনিয়োগের জন্য যুবরাজ মোহামেদ অস্থির হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তার জন্য তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। ফলে, সউদীরা দুর্বল একটি অবস্থান থেকে ইরানের সাথে এই সমঝোতা করছে,’ বলেন সাদি হামদি।

ইরান কেন আগ্রহী হলো? স্পষ্টতই আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে রেষারেষিতে গত কয়েকবছরে সউদীদের অনেকটাই চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে ইরান। তাহলে তারা এই সমঝোতায় কেন রাজী হলো? অধিকাংশ বিশ্লেষকই বলছেন দেশের ভেতর ক্রমবর্ধমান জনরোষ এবং সেইসাথে বছরের পর বছর ধরে কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ভঙ্গুর এক অর্থনীতির জেরে ইরানের ইসলামি সরকার প্রচণ্ড চাপে পড়েছে। তাই তারা ভাবছে সউদী আরব এবং অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ঐ দুর্দশা লাঘবে সাহায্য করবে।

সাদি হামদি মনে করেন ইরানের এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি কৌশলগত উদ্দেশ্যও হয়তো রয়েছে। ‘ইরান মনে করছে সউদীদের সাথে একটি সমঝোতা হলে লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন বা সিরিয়ায় তাদের যেসব প্রক্সি (সহযোগী) রয়েছে তাদের ওপর চাপ কিছুটা কমবে, এবং সেই সুযোগে তারা তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক অর্জন সংহত করার বাড়তি সময় পাবে।’ ফলে, তার মতে, সউদী আরব আর ইরানের এই সমঝোতা নেহাতই কৌশলগত একটি সন্ধি, এবং দুপক্ষের মধ্যে মৌলিক বিরোধগুলো তাতে ঘুচবে না। রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তারা সরবে বলে ভরসা নেই হামদির। সে কারণে, তার মতে, এই বোঝাপড়া মৌলিকভাবে ভঙ্গুর।

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্যে যেভাবে রদবদল ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যও তার প্রভাব পড়বেই। এ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় আমেরিকার একচ্ছত্র প্রাধান্য দ্রুত কমছে। আর এর পরিণতিতে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের চিরাচরিত হিসেব-নিকেশ বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া, সউদী আরব-ইরানের সমঝোতায় চীনের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতাও এই সমঝোতাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে বলে অনেক মনে করছেন। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ
টাকার বিছানায় ঘুম
চশমার যাদুঘর
গ্রেফতার সেই কুমির
শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর তৈরি করবে চীন
আরও

আরও পড়ুন

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে  রুখে দিতে হবে

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে রুখে দিতে হবে

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

টাকার বিছানায় ঘুম

টাকার বিছানায় ঘুম

চশমার যাদুঘর

চশমার যাদুঘর

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

গ্রেফতার সেই কুমির

গ্রেফতার সেই কুমির

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?