সিআইএ এজেন্ট ছিলেন সিকিমের রাণী?

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৮ জুলাই ২০২৩, ০২:১৪ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩, ০২:১৪ পিএম

 

 

পশ্চিমবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিংয়ে ১৯৫৯ সালের এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। অভিজাত হোটেল উইন্ডামেয়ারের সামনে একটা মার্সিডিজ গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়িটা ছিল সিকিমের যুবরাজ থণ্ডুপের। হোটেলের লাউঞ্জে বসে নিজের পছন্দের মদের অর্ডার দিলেন যুবরাজ। তার চোখ পড়ল লাউঞ্জের কোণে বসা এক তরুণীর দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে তার কাছে খবর চলে এল ওই তরুণীর ব্যাপারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এক ছাত্রী, ছুটি কাটাতে ভারতে এসে ওই অভিজাত হোটেলে কিছুদিনের জন্য উঠেছেন। তরুণীর নাম হোপ কুক।

যুবরাজ থণ্ডুপ দেখা করলেন হোপ কুকের সঙ্গে, আর মুহূর্তেই দুজনে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। যুবরাজের বয়স তখন ৩৬, আর হোপ কুক মাত্র ১৯। কিছুদিন আগেই যুবরাজের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তিনটি সন্তানের পিতা থণ্ডুপ বেশ লাজুক ছিলেন। একটু তোতলাতেনও যুবরাজ। প্রথম দেখা হওয়ার পরে প্রায় দু'বছর দু'জনের মধ্যে আর দেখা হয় নি। হোপ কুক আবার ভারতে আসেন দু'বছর পরে আর দার্জিলিং-এ এসে তিনি সেই উইন্ডামেয়ার হোটেলেই উঠেছিলেন।

আত্মজীবনী 'টাইম চেঞ্জ'-এ হোপ কুক লিখেছিলেন, ‘আমি জানি না যুবরাজ কীভাবে জানতে পারলেন যে আমি উইন্ডামেয়ার হোটেলে রয়েছি। আমি একা একাই চা খাচ্ছিলাম, সেই সময়ে তিনি হোটেলের পার্লারে প্রবেশ করলেন।’ ‘তিনি গুর্খা রেজিমেন্টের একজন সাম্মানিক অফিসার ছিলেন আর একটি সামরিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গ্যাংটক থেকে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি আমাকে জিমখানা ক্লাবে তার সঙ্গে নাচার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে রাতে তিনি খুব ভাল মেজাজে ছিলেন। তিনি আমাকে ফিসফিস করে বললেন একদিন ভিয়েনায় আমরা একসঙ্গে ঘুরবো।’

সেই রাতেই, নাচ করার সময় যুবরাজ হোপ কুককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি তাকে বিয়ে করার কথা বিবেচনা করবেন কিনা। হোপ কুকের বয়স তখনও ২১ পেরয় নি। তিনি যুবরাজের প্রস্তাব মেনে নেন। কয়েকদিনের মধ্যেই থণ্ডুপ কুককে গ্যাংটকে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদ দেখে কুক তো হতবাক। হোপ কুক যখন ১৯৬৩ সালে সিকিমের যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম তার প্রতি ভীষণ সম্মান দেখাতে শুরু করল। তাকে হলিউড অভিনেত্রী গ্রেস কেলির সাথে তুলনা করা হতে থাকল। গ্রেস কেলি মোনাকোর যুবরাজ তৃতীয় রেইনিয়াকে বিয়ে করেছিলেন।

টাইম ম্যাগাজিন 'সিকিম: আ কুইন রিভিজিটেড' শিরোনামে ১৯৬৯ সালে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল হোপ কুককে নিয়ে। ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে “হোপ কুক সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর তিনি বিদেশ থেকে আনা পত্র-পত্রিকা পড়েন। পরের চার ঘণ্টা লাগে বিভিন্ন মানুষকে চিঠি লিখতে, খাবারের মেনু তৈরি করতে আর প্রাসাদের ১৫জন কর্মচারীকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিতে ব্যয় করেন। তার সন্ধ্যাগুলো কাটে এক সেট টেনিস খেলে আর পার্টি করে। রাতের খাবারের আগে স্কচ এবং সোডা ওয়াটার নেওয়ার অভ্যাস ছিল তার। ‘তিনি নিজের মার্সিডিজ গাড়িতেই গ্যাংটকের সর্বত্র চলাফেরা করেন, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের সময়ে শুধুমাত্র ইকোনমি ক্লাসেই যেতে পছন্দ করেন,’ লিখেছিল টাইম পত্রিকা।

থণ্ডুপ ও হোপে কুকের বিয়ের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলিতে, বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে হাল্কাভাবে, আর সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে, তাদের নিয়ে আলোচনা চলেছিল। কুকও এমন আচরণ করতে শুরু করলেন, যেন তিনি স্বাধীন সিকিমের রাণী হতে চলেছেন। নিউজউইকের ২ জুলাই, ১৯৭৩ সালের এক প্রতিবেদনে লেখা হয় "হোপ জ্যাকলিন কেনেডির স্টাইলে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করেছেন। তিনি 'আমি'-এর বদলে 'আমরা' শব্দটা ব্যবহার করছেন এবং আশা করেন যে রাণীদের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয় তার সঙ্গে সেরকমই ব্যবহার করা হবে।“

হোপ কুকের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া বিদেশি অতিথির সংখ্যা বাড়ছিল। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সিনেটর চার্লস পার্সি কুকের সঙ্গে দেখা করার জন্যই গ্যাংটকে এসেছিলেন। জিবিএস সিধু ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর বিশেষ সচিব ছিলেন। তার বই 'সিকিম - ডন অফ ডেমোক্রেসি' বইতে সিধু লিখেছেন, ‘বিদেশিদের সঙ্গে হোপের এই বৈঠকগুলির প্রভাব এতটাই ছিল যে পশ্চিমা দেশগুলিতে ভারতের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার শুরু হয়েছিল যেন ভারতই সিকিমের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে।’

‘এখানে উল্লেখ্য, ভারতকে ১৯৫০ সালের চুক্তি বদল করতে বাধ্য করার পিছনে চোগিয়ালের (সিকিমের রাজাদের সাম্মানিক উপাধি) হাত ছিল, কিন্তু তার স্ত্রী হোপ কুক বিষয়টিকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু করতে সাহায্য করেছিলেন,’ লিখেছেন সিধু। সেই সময়ে দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ইউএস ফরেন সার্ভিস অফিসার উইলিয়াম ব্রাউন লিখেছেন, ‘৬০-এর দশকে আমাদের সামনে ভারতকে কটূক্তি করার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করেননি হোপ কুক।’

নামগিয়াল ইনস্টিটিউটের জার্নালে ১৯৬৬ সালে হোপ কুক একটি প্রবন্ধ লেখেন 'সিকিমিজ থিওরি অফ ল্যান্ড-হোল্ডিং অ্যান্ড দ্য দার্জিলিং গ্রান্ট' শিরোনামে। এ প্রবন্ধে, তিনি ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দার্জিলিং জেলা দিয়ে দেয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার যুক্তি ছিল দার্জিলিং শুধুমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া হয়েছিল। যেহেতু ওই এলাকা সিকিম রাজপরিবারের অধিকার রয়েছে, তাই দার্জিলিংকে সিকিমে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। ওই প্রবন্ধ একটি রাজনৈতিক বিস্ফোরণ ঘটায়।

প্রবন্ধটির দিকে সবার নজর এই কারণেও গিয়েছিল কারণ নামগিয়াল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-এর সম্পর্ক সবারই জানা ছিল। কেন কনভয় তার বই 'দ্য সিআইএ ইন টিবেট’-এ লিখেছেন, "তিব্বত অপারেশনে জড়িত সিআইএ এজেন্টরা এই ইনস্টিটিউটেই ইংরেজির শিক্ষা নিয়েছিল"। এ প্রেক্ষাপটে হোপ কুকের প্রবন্ধটি ছাপার ঘটনাটি হিমালয় অঞ্চলে সিআইএ-রই পরিকল্পনা হিসাবে দেখা হয়েছিল।

অ্যান্ড্রু ডাফ তার বই 'সিকিম রিকুয়েম ফর এ হিমালয়ান কিংডম'-এ লিখেছেন, "যদিও হোপ কুক তার আত্মজীবনীতে স্পষ্ট করেছেন যে প্রবন্ধটি শুধুমাত্র একটি একাডেমিক বিতর্কের জন্ম দেয়ার উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন, কিন্তু লেখাটির প্রভাব হয়েছিল বিপরীত। লেখাটি পড়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মনে হয়েছিল যে তিনি যেন দার্জিলিং-এর ভারতে থাকার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। ভারতীয় সংবাদপত্রে শিরোনাম লেখা হয়েছিল এভাবে: 'সিআইএ এজেন্টের ডানা গজিয়েছে’ বা 'গ্যাংটকের দরজায় ট্রয়ের ঘোড়া কড়া নাড়ছে’ ইত্যাদি।

কিছুদিনের মধ্যেই হোপ কুকের লেখা প্রবন্ধটি ইন্দিরা গান্ধীর ডেস্কে পৌঁছে দেয়া হয়। ওই প্রবন্ধটি ইন্দিরা গান্ধীর জন্য একটি বিপদসঙ্কেত ছিল। বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুনন্দ দত্ত রায় তার 'স্ম্যাশ অ্যান্ড গ্র্যাব' বইতে লিখেছেন, ‘যখন ভারতের সংসদে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধী সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে দার্জিলিং-এর উপর সিকিমের অধিকারের দাবিটি কোনও দায়িত্বশীল মহল থেকে আসে নি। ইন্দিরা গান্ধী হোপ কুকের শিশুসুলভ বক্তব্য সম্পর্কে গ্যাংটককে একটা স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।’ "এমনকি গ্যাংটকেও, চোগিয়াল তার স্ত্রীর অবস্থান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে ঘোষণা করেছিলেন, ‘নামগিয়াল ইনস্টিটিউট এবং তাদের পত্রিকার সহায়তা ছাড়াই আমার দেশ আর দেশের মানুষের অধিকারগুলি রক্ষা করতে সক্ষম আমার সরকার,’ লিখেছেন দত্ত রায়।

সিআইএ এজেন্ট হওয়ার অভিযোগ

ভারতের একটা মহল থেকে বলা হত যে, সামরিক কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের রাজা যখন দার্জিলিং-এর একটি হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের এক তরুণীর প্রেমে পড়েছেন, সিআইএ কীভাবে এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে! তবে ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করতেন না যে হোপ কুক একজন সিআইএ এজেন্ট ছিলেন যাকে এজেন্সি গ্যাংটকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য স্থাপন করেছিল। ‘র’-এর প্রাক্তন বিশেষ সচিব জিবিএস সিধু লিখেছেন, "সিআইএ যদি সত্যিই সিকিমের স্বাধীনতার জন্য কিছু কাজ করতে চাইত, তবে তারা এই অপারেশনের আরও ভাল মতো পরিকল্পনা তৈরি করত৷ যদি সত্যিই এটি সিআইএ-র কাজ হত, তাহলে হোপ কুক দক্ষিণ এবং পশ্চিম সিকিমে তার উপস্থিতি আরও বাড়াতেন।“

‘তিনি নেপালি বংশোদ্ভূত অবহেলিত মানুষের জন্য হাসপাতাল, স্কুল ইত্যাদি খুলে চোগিয়ালের প্রতি তাদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা চালাতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি সত্যিই সিআইএর হয়ে কাজ করতেন, তাহলে তিনি চোগিয়ালকে পরামর্শ দিতেন যে প্রশাসনের উপর তার কড়া নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কিছু ক্ষমতা ভাগ করে নেয়ার। বিপরীতে, তিনি চোগিয়ালকে তার নিজের লোকদের থেকে, বিশেষ করে নেপালি বংশোদ্ভূত লোকদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।’

হোপ কুক তিব্বতের রাণীর মতো আচরণ করতেন, তাদের মতো সামাজিক শিষ্টাচার শিখেছিলেন আর তাদের মতোই পোশাক পরতে শুরু করেছিলেন। সিধু আরও লিখেছেন, ‘যদি ধরেও নিই যে তিনি একজন সিআইএ এজেন্ট, তার হ্যান্ডলাররা একেবারেই আনাড়ি ছিল, যাদের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। আবার চোগিয়ালের কাছ থেকে সিআইএর খুব বেশি কিছু তথ্যের দরকার ছিল না কারণ চোগিয়াল এবং তার গোয়েন্দা প্রধান কর্মা তোপদেনের ব্যাপারে কলকাতার সিআইএ অফিসারদের কাছে অনেক তথ্যই থাকত।’

"চোগিয়াল পঞ্চাশের দশকে যুবরাজ হিসাবে দু'বার তিব্বত সফর করেছিলেন। কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপ-দূতাবাসে নিযুক্ত সিআইএ অফিসাররা দু'বারই তিনি ফিরে আসার পরে তাকে ডিব্রিফ করেন। কলকাতায় যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-দূতাবাস, কলকাতায় এলে সেই এলাকাতেই থাকতেন চোগিয়াল,” লিখেছেন সিধু। তার কথায়, "সেই সময়েই সিআইএ আর এমআই সিক্সের গুপ্তচররা তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারতেন। হোপ কুকের মতো একজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি, যার ওপরে সারা বিশ্বের নজর রয়েছে, এমন একজনের কাছ থেকে খবর যোগাড় করার থেকেও অনেক বেশি তথ্য যোগাড় করা সিআইএর মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে অনেকটাই সহজ।“

চোগিয়ালের পতনের আগেই সিকিম ত্যাগ

হোপ কুক চোগিয়ালের থেকে অনেক বুদ্ধিমতি ছিলেন। ভারতের সঙ্গে ৮ মে, ১৯৭৩ সালে যে চুক্তি হয় সিকিমের, তার পরিণতি তিনি ভালই বুঝে গিয়েছিলেন। তাই অগাস্ট মাসেই তিনি চিরতরে সিকিম ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি স্বামীর চূড়ান্ত পতন চোখে দেখার দুঃখজনক ঘটনাটা এড়াতে পেরেছিলেন। হোপ কুক ১৯৭৩ সালের ১৪ অগাস্ট চিরতরে সিকিম ছেড়ে চলে যান। বিডি দাস, যিনি সিকিমের প্রধান নির্বাহী ছিলেন, তার আত্মজীবনী 'মেমোয়ার্স অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাট'-এ লিখেছেন, ‘চোগিয়াল অনুরোধ করেছিলেন যে হোপ যেন তাকে এই কঠিন সময়ে ছেড়ে না যান। কিন্তু তিনি চোগিয়ালের অনুরোধ রাখেন নি। আমি হোপ কুককে হেলিপ্যাডে বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম। তার শেষ কথা ছিল, দাস, আপনি আমার স্বামীর খেয়াল রাখবেন।’

‘হোপ কুক অনেকের কাছেই রহস্যময়ী ছিলেন। কেউ কেউ তাকে সিআইএ এজেন্ট বলতেন। কিন্তু কেউ সত্যটা জানত না। তবে এটাতে কোনও সন্দেহ নেই যে তিনিই চোগিয়ালকে বলেছিল। কিন্তু আসল ঘটনা কেউ জানে না। তবে কোনও সন্দেহ নেই যে তিনিই চোগিয়ালকে ভারত বিরোধী অবস্থান নিতে প্ররোচিত করেছিলেন। তিনি স্কুলের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করিয়ে ভারত বিরোধী কাহিনী আর কার্টুনকে জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় নেতা ও কর্মকর্তাদের সামনে রানীর মতো আচরণ করতেন, কিন্তু তাদের আড়ালে তিনি ভারতকে নিয়ে গালিগালাজ করতেন।’

চোগিয়ালের অবিশ্বাস

কিছু দিন পরে, হোপ কুক চোগিয়ালের কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন। চোগিয়ালের সঙ্গে তার বিয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের যে নাগরিকত্ব তিনি ছেড়ে এসেছিলেন, সেটাও ফিরে পান তিনি। তবে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে সম্পর্কে অবনতির কারণেই হোপ কুক চোগিয়ালের কাছ বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন। চোগিয়াল এক বিবাহিত বেলজিয়ান নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পরেই দু'জনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। হোপ কুকের প্রথম সন্তানের জন্মের আগে তিনি বেলজিয়ামে গিয়েছিলেন ওই নারীর সঙ্গে দেখা করতে।

হোপ কুক তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "তার বান্ধবী তাকে প্রেমপত্র লিখতেন।" "অনেকবার যখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন, আমি অনুভব করতে পারতাম যে তার ড্রেসিং গাউনের পকেটে কিছু কাগজ রয়েছে। প্রায়ই সেই প্রেমপত্রগুলি তার পকেট থেকে পড়ে যেত, যা আমি তুলে নিয়ে পড়তাম।" চোগিয়ালের অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাসও তার থেকে হোপ কুককেদূরে সরিয়ে দিয়েছিল। একবার মাতাল হয়ে চোগিয়াল তার রেকর্ড প্লেয়ারটি জানালা থেকে নিচে ফেলে দেন।

ভারতীয় সৈন্যরা প্রাসাদ ঘিরে ফেলে

দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে চোগিয়ালের আলোচনা ব্যর্থ হয় ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন। সেদিনই সিকিমের ভারতে যোগদান চূড়ান্ত হয়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী সিকিমের প্রাসাদ ঘিরতে শুরু করে নয় এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে। জিবিএস সিধু লিখেছেন, ‘প্রাসাদের মূল ফটকে অবস্থানরত রক্ষী বসন্ত কুমার ছেত্রী ভারতীয় সৈন্যদের থামানোর জন্য তার রাইফেল তুলে নিয়েছিলেন। ভারতীয় সৈন্যরা তাকে গুলি করে উড়িয়ে দেন।’

"চোগিয়াল আতঙ্কিত হয়ে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, গুরবচন সিংকে টেলিফোন করে জানতে চাইছিলেন যে কি ঘটছে, কিন্তু টেলিফোনের রিসিভারটি বাড়িয়ে দেয়া হয় জেনারেল খুল্লারের দিকে। তিনি গুরবচন সিংয়ের পাশেই বসেছিলেন। জেনারেল খুল্লার চোগিয়ালকে বললেন যে তিনি যেন ‘সিকিম গার্ড’দের অস্ত্র সমর্পন করার আদেশ দেন। ‘সিকিম গার্ড’-এর ২৪৩ জন সদস্যকে ভারতীয় সৈন্যরা ঘিরে রেখেছিল। তারা তাদের অস্ত্র নামিয়ে রেখে হাত ওপরে তুলে দিল। পুরো অপারেশনটি মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়েছিল," লিখেছেন জিবিএস সিধু।

সিকিমের ভারতে যোগদান

সেই দিন, ১২টা ৪৫ মিনিটে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে সিকিমের পরিচিতির সমাপ্তি ঘটে। হ্যাম রেডিওর মাধ্যমে চোগিয়াল এই বার্তা সম্প্রচার করে দেন। যুক্তরাজ্যের একটি গ্রামের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার আর জাপান ও সুইডেনের আরও দুই ব্যক্তি তার সেই বার্তা শুনতে পান। এরপর চোগিয়ালকে তার প্রাসাদে গৃহবন্দী করা হয়। সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করার জন্য সংবিধান সংশোধনী বিলটি ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাশ করানো হয়। তিন দিন পরে, ২৬ এপ্রিল, বিলটি রাজ্যসভায় পাশ হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ সম্মতি দিয়ে সাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল সিকিমে নামগিয়াল রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে।

ওই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি চোগিয়াল। তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই ২৯ এপ্রিল, ১৯৮২ সাল, সকালবেলায় মারা যান চোগিয়াল পালডেন থণ্ডুপ নামগিয়াল। চোগিয়ালের মৃত্যুর পর হোপ কুক যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যান। তিনি সিকিমের সঙ্গে তার সম্পর্ক বজায় রাখলেও সেখানে কখনও ফিরে আসেননি। তিনি ১৯৮৩ সালে ইতিহাসবিদ মাইক ওয়ালেসকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু সেই বিয়েও ভেঙ্গে যায়। এখন নিউইয়র্কেই থাকেন হোপ কুক। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ
থিনেস্ট স্বাস্থ্যের
বলিভিয়ায় নিহত ১৩
মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার থেকে আসা যোদ্ধারা
আরও

আরও পড়ুন

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

বিহারিরা কেমন আছে

বিহারিরা কেমন আছে

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

কিউবায় সমাবেশ

কিউবায় সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে দূর্বৃত্তের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আহত

ঈশ্বরদীতে দূর্বৃত্তের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আহত

থিনেস্ট স্বাস্থ্যের

থিনেস্ট স্বাস্থ্যের