অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা, একটি নীরব বিপদ
১৬ মে ২০২৫, ০৪:৪৭ পিএম | আপডেট: ১৬ মে ২০২৫, ০৪:৫৫ পিএম

অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যা, যা প্রায়শই "বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডার" (Binge Eating Disorder, BED) নামে পরিচিত, এটি একটি স্বীকৃত মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে ভুক্তভোগী বারবার অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রচুর খাবার খেয়ে ফেলেন, এমনকি যখন ক্ষুধা নেই তখনও। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি খাবার খেয়ে সাময়িক প্রশান্তি পেলেও পরে প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভোগেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অভ্যাসটি ছাড়তে পারেন না। অনেকটাই যেন মাদকাসক্তির মতো—ক্ষতিকর জেনেও বারবার একই কাজ করে যাওয়া। অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যা সাধারণত কৈশোর বা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, তবে যে কোনো বয়সে এটি হতে পারে।
সমস্যা শুরু হয় যেভাবে
অতিরিক্ত খাওয়ার ব্যাধি সাধারণত দেখা দেয় মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, বা অতীতের কোনো ট্রমার প্রেক্ষাপটে। এটি সাধারণত ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও, যেকোনো বয়সেই শুরু হতে পারে। এই খাওয়ার পেছনে প্রকৃত ক্ষুধার ভূমিকা খুবই সামান্য। এটি মূলত মানসিক প্রশান্তি খোঁজার একটি ব্যর্থ চেষ্টার ফলাফল। মানুষের মন যখন কোনো যন্ত্রণা বা কষ্টে ডুবে থাকে, তখন অনেকেই নিজের অজান্তেই খাবারকে একটি সহায়ক পন্থা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন—আর এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় বিইডি (BED)।
সমস্যার লক্ষণ কী কী?
অতিরিক্ত খাওয়ার ব্যাধির বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যা শুরুতে হয়তো খেয়াল করা কঠিন, তবে ধীরে ধীরে এগুলো পরিস্কার হয়ে ওঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত একবারে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলেন। অনেকেই এই খাওয়া গোপনে করেন, যাতে কেউ জানতে না পারে। খাওয়ার পর তারা তীব্র অপরাধবোধে ভোগেন, লজ্জা পান, হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। সাধারণত ব্যক্তিটি খাওয়ার সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, এবং পরে মনে রাখতে পারেন না কতটা খেয়েছেন। এমনকি পেট ব্যথা বা অস্বস্তি হওয়া পর্যন্ত খেয়ে ফেলা হয়। যদি এই ধরনের খাওয়ার অভ্যাস সপ্তাহে অন্তত একবার ঘটে এবং তা একটানা কয়েক মাস চলে, তবে একে বিইডি ( BED) হিসেবে ধরা হয়।
এই ব্যাধির পিছনের যত কারণ
অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যার পেছনে রয়েছে জটিল মানসিক ও সামাজিক বিষয়সমূহ। অনেক সময় মানসিক চাপ, একাকিত্ব, বিষণ্নতা বা ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ খাবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যাঁরা শৈশবে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পারিবারিক অভ্যাসও এতে ভূমিকা রাখে—যেমন জোর করে খাওয়ানো, খাওয়া নিয়ে উপহাস, কিংবা খাবার দিয়ে পুরস্কার-শাস্তি দেওয়ার মতো আচরণ। এসব অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে খাদ্য নিয়ে বিকৃত ধারণা তৈরি করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে হরমোন বা নিউরোকেমিক্যাল ভারসাম্যহীনতা, বিশেষ করে ডোপামিনের মাত্রা বেশি থাকলে, খাবার খাওয়াকে নেশার মতো আনন্দদায়ক করে তোলে। আবার অনেকে কঠোর ডায়েট মেনে চলার পর হঠাৎ সেটি ভেঙে দিয়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে খেয়ে ফেলেন, যা পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হয়।
ব্যক্তির শরীর ও মনের উপর এর প্রভাব
অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যার প্রভাব শুধু মানসিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি শরীরের উপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ওবেসিটি বা স্থূলতা, যা অনেক ক্ষেত্রেই BED-এর একটি সরাসরি ফলাফল। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে যাওয়ায় টাইপ ২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, লিভারের সমস্যা এবং হজমজনিত জটিলতা দেখা দেয়। মানসিকভাবে ভুক্তভোগী নিজেকে দোষী ভাবেন, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, আয়নায় নিজের শরীর দেখতে অপছন্দ করেন এবং অনেক সময় সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই একাকিত্ব ও আত্মঅবিশ্বাস থেকে অনেকেই বিষণ্নতায় ডুবে যান, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
চিকিৎসার পথ কী হতে পারে?
আশার কথা হলো, অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যা সম্পূর্ণভাবে চিকিৎসাযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন পেশাদার মানসিক সহায়তা, ধৈর্য, এবং নিজের প্রতি সদয় মনোভাব ও আত্মবিশ্বাস। সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে Cognitive Behavioral Therapy (CBT) চিকিৎসা নেয়া। এতে রোগী তার খাদ্যাভ্যাসের পেছনে থাকা মানসিক বাধাগুলো বুঝে উঠতে শেখেন এবং ধীরে ধীরে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। কখনো কখনো মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগ কমাতে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যদিও তা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা উচিত নয়। গ্রুপ থেরাপিও একটি কার্যকর উপায়—এতে একে অপরের অভিজ্ঞতা শুনে উৎসাহ পাওয়া যায়। পাশাপাশি ডায়েটিশিয়ানের সহায়তায় স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য পরিকল্পনা করা হয়, যাতে খাবার নিয়েই দুশ্চিন্তা না থাকে। যোগব্যায়াম ও মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন মানসিক চাপ কমিয়ে খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সচেতনতা ও প্রতিরোধের কৌশল
অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের এই সমস্যা প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে ছোটবেলা থেকেই খাওয়ার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে খাবারের পুষ্টিগুণ এবং নিজের সচেতনতা সম্পর্কে শেখানো দরকার। কেউ যদি অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতায় ভোগে, তাহলে তাকে তিরস্কার না করে সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যাটি বুঝতে সাহায্য করা জরুরি। মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম, সময়মতো ঘুম, এবং স্বাস্থ্যকর জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। যারা ডায়েট করছেন, তাঁদের জন্য পরামর্শ হলো—নিজের উপর অত্যধিক চাপ না দেওয়া, বরং ধীরে ধীরে সুস্থ অভ্যাস গড়ে তোলা।
পরিশেষে বলা যায়, অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যা নিছক একবারে বেশি খেয়ে ফেলার বিষয় নয়—এটি একটি গভীর মানসিক ও শারীরিক সংকট, যা অনেক সময় একজন মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু আশার কথা হলো, এটি সময়মতো শনাক্ত ও চিকিৎসা করা হলে পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব। আমাদের উচিত নিজের আশপাশের মানুষদের আচরণ খেয়াল রাখা, এবং কেউ যদি এই সমস্যায় ভোগেন, তবে তাকে তিরস্কার না করে সাহস জোগানো। অতিরিক্ত খাওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব—যদি আমরা সময়মতো সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিই এবং সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দিই।
বিভাগ : লাইফস্টাইল
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার আক্ষেপ ক্লাব বিশ্বকাপে ঘোচাতে চায় ইন্টার

বিজিবির অভিযানে মে মাসে ১৩৩ কোটি ১১ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ

পরিবহন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ৭টি ওমরাহ কোম্পানি স্থগিত

রাশিয়ার হামলায় কিয়েভে মার্কিন নাগরিকসহ নিহত ১৪

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল না হলে আন্দোলন চলবে

জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া ‘বিশাল ভুল’ ছিল: ট্রাম্প

সাকিব আল হাসানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

এস আলমের ২০০ একর জমি জব্দের নির্দেশ আফতাবুলের ৯৪ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

নগর ভবন অচলাবস্থার জন্য এই সরকার দায়ী : ইশরাক

বাবার যত্নে ওষুধ, মেডিকেল টেস্ট, হেলথ চেকআপে বিকাশ পেমেন্টে ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাক

শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস ও পাঠ্যবই রচনা করেছিল: রিজভী

‘ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারবে না’

ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার দাবীতে বিশ্বনাথে স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ-দোয়া মাহফিল

দোয়ারাবাজারে সড়ক দূর্ঘটনায় গরুটি মৃত্যু আহত ৪

জুবাইদা রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে ২ দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন

সুন্দরগঞ্জে জামের গাছ থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু

ভবিষ্যতে ছেড়ে দেব এমন কথা বললে তালাক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে।

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এবং জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্ন

সকলের দৃষ্টি এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে