বিশ্ব নাগরিকের জীবন গগণের কিছু রোদ-ছায়া
১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০১ এএম
সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪। মৃত্যু ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। তিনি রম্য সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান। প্রবাদপ্রতীম কথাসাহিত্যিক বিশ্বনাগরিক। কর্মজীবন ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৪। স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ১৯৫১ থেকে ১৯৭৪। উভয়ের মৃত্যুসাল ১৯৭৪। তখন মুজতবা ভারতের নাগরিক আর স্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক।
মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন (১৯২১-১৯২৬)। প্রথম দেখায় রবীন্দ্রনাথ এ সুন্দর বাকপটু ছেলেটিকে বলেছিলেনÑ ‘ওহে ছেলে, আমি নিশ্চিত তুমি পূর্ববঙ্গের সিলেটের বাসিন্দা। কারণ, তোমার কথা থেকে তো কমলালেবুর ঘ্রাণ পাচ্ছি।’
এর আগে ১৯১৯ সালে সিলেট সফরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্থানীয় ছাত্রদের উদ্দেশে ‘আকাঙ্খা’ বিষয়ের উপর বক্তৃতা করেন। কিশোর মুজতবা আলী বিশ্বকবিকে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, “আকাঙ্খা উচ্চ করতে গেলে কী করা প্রয়োজন।” এক সপ্তাহ পরেই আসমানি রঙের খামে জবাব পেলেন “আকাঙ্খা উচ্চ করিতে হইবে, এই কথাটির মোটামুটি অর্থ এইÑ স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়।
তোমার পক্ষে কী করা উচিত তা এত দূর থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।”
দ্বিতীয় মুসলিম ছাত্র হিসেবে মুজতবা শান্তিনিকেতনে জার্মান, ফরাসি,ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি,ফারসি, রুশ ও ইতালিয় ভাষা আয়ত্ত করেন। গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো ইংরেজি আর বাংলা ক্লাসে।তিনি পড়াতেন শেলি,কিটস আর বলাকা।রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল। শান্তিনিকেতনের জীবনের সব কথা মুজতবা লিখেছেন ‘গুরুদেব ও শান্তি নিকেতন’ গ্রন্থে।
পরবর্তীতে মুজতবা আলী আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়,জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।কর্মজীবনে কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে, বরোদার মহারাজার আমন্ত্রনে সেখানকার কলেজে,দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেন।পঞ্চাশের দশকে ‘ আকাশবাণী’ রেডিওর ডিরেক্টর ছিলেন।
চাকরি ছেড়ে ১৯৫৭ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। বড় বড় পত্রিকা থেকে লেখার তাগিদ পেতেন আর পেতেন সম্মানী। কিন্তু ভালো বেতনে পত্রিকায় কাজ করার সাড়া না পেয়ে ক্ষোভে তিনি কলকাতা ছেড়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কিন্তু এখানেও মুজতবা শান্তি পাননি।ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি বিক্রি করে খরচ নির্বাহ করতেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পরবর্তী শান্তিনিকেতনে প্রাণপ্রাচুর্যহীন নিরানন্দ পরিবেশ তাঁকে পীড়িত করতো। চারদিকে ঈর্ষা আর হীনমন্যতা তাঁকে বিচলিত করে তুললো।
এসময় ‘দেশ’ পত্রিকায় মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বই লেখার পরিকল্পনাও বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা চাহিদার চাপে বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত লেখার সম্মানীই ছিল তাঁর জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম।
এসময় বিশ্বভারতীর নতুন উপাচার্য বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাস মুজতবাকে ১ হাজার ১শ’ টাকা বেতনে বিশবিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও জার্মান ভাষা বিভাগে রিডার পদে নিয়োগ করেন। ১৯৬৫ সালের ৩০ জুন কর্তৃপক্ষ তাঁকে অব্যাহতি দেন।
এসময় শুরু হয় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। অপপ্রচারকারীরা বলতে থাকে ‘মুজতবা আলী আসলে পাকিস্তানের চর’। কারণ তাঁর স্ত্রী পাকিস্তান সরকারের চাকুরে। ফলে পুলিশ তাঁর বোলপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে। তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুজতবার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পান।এর ছয় বছর পর ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব সপ্তম শ্রেণীতে সিলেটে মুজতবা আলীর সহপাঠী ছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে লুসাই ভাষা শেখার চেষ্টা করেন।তিনি আবিষ্কার করেন যে, লুসাই ভাষাতে বাংলা বহু শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই। ১৫ বছর বয়সে মেজ ভাই সৈয়দ মুর্তজা আলীর সাথে মিলে ‘কুইনিন’ নামে পত্রিকা বের করেন।
সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেকে ভাবতেন বিশ্ব নাগরিক। একবার সরস্বতী পূজার সময় এক মহিলার আয়োজনে পুরোহিত না পেয়ে গঙ্গার ঘাটে মুজতবাকে যেতে বলা হলো বিশেষ অনুরোধে। বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে পুজার যাবতীয় আচার সারলেন মুজতবা। বাড়ির লোকজন খুশি হয়ে খাইয়ে দক্ষিণা দিয়ে তাঁকে বিদায় করলেন। অথচ জানলেননা তিনি মুসলিম।
সৈয়দ মুজতবা আলী স্মৃতিচারণ করে লিখলেন, “জানি না মা সরস্বতী এই বিধর্মীর পুজোয় অসন্তুষ্ট হলেন কিনা? তবে আশা করি তিনি উপোসী বাচ্চাটির শুকনো মুখের দিকে চেয়ে এই অধমকে ক্ষমা করবেন।”
কাবুল কৃষি বিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষকের চাকরি করেন। কলকাতা থেকে কাবুল সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেন ‘দেশে-বিদেশে’ ভ্রমণকাহিনী। সে জনপদের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা ও আর্থসামাজিক পটপরিবর্তন চিত্র তুলে ধরেন সূক্ষ্ম রসবোধের মিশেলে। ১৯৪৯ সালে এ গ্রন্থ প্রকাশে প্রকাশকের সাথে বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
‘দেশে-বিদেশে’ ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালের আফগানিস্তান ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে লেখা এবং ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এটি প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আফগানিস্তানের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলও বটে। লেখকের রম্যরসের সাথে মিশে যাওয়া বর্ণনার মাধ্যমে তিনি ভ্রমণকাহিনিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ‘দেশে-বিদেশে’ সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম প্রকাশিত বই এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে। ১৯২৭-১৯২৯ সাল পর্যন্ত লেখকের আফগানিস্তানে অবস্থানের অভিজ্ঞতা এই বইয়ের উপজীব্য। এটি কেবল একটি ভ্রমণকাহিনী নয়, আফগানিস্তানের তৎকালীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনজীবনের একটি অনবদ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য ও রসাত্মক বর্ণনা শৈলীর জন্য বইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে লেখকের দেখা ও শোনা বিভিন্ন ঘটনা, পরিচিত ও অপরিচিত মানুষের সাথে তার রসালাপ এবং বিভিন্ন স্থানের বর্ণনার পাশাপাশি আফগানিস্তান ছেড়ে আসার কাহিনীও অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটি বাংলা সাহিত্যের ভ্রমণকাহিনি ধারায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে এবং আজও পাঠক মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘দেশে-বিদেশে’ বইয়ে আবদুর রহমানকে এক আদর্শ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যিনি তার সরলতা ও মানবতাবোধে সকলের মন জয় করেন। লেখক তাঁর বইতে আবদুর রহমানের প্রশস্ত বপু, পিঠে বিরাট বোঁচকা এবং বরফাচ্ছাদিত পথের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, আবদুর রহমানের পাগড়ী ময়লা হলেও তাঁর হৃদয় ছিল শুভ্রতম। আবদুর রহমান তার জন্মস্থান পানশিরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করতো। পানশিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রহমান সগৌরবে বলতে পেরেছে ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম’- মানে এইতো আমার দেশ।” কুইনিন জ্বর সারাবে বটে কিন্তু কুইনিন সারাবে কে” জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ এ উক্তি প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালে সত্যপীর, ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শীসহ নানা ছদ্মনামে মুজতবা লিখতেন দেশ, আনন্দ বাজার, বসুমতী, সত্যযুগ ও মোহাম্মদী পত্রিকায়। লেখায় তিনি শ্লোক ও রূপকের যথাযথ ব্যবহার করতেন।
জনপ্রিয় লেখক হয়েও লেখার প্রতি ছিল মুজতবার অনীহা। তিনি বলতেন, “হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না। আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না।”
সিলেট মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন মুজতবা আলী। তখন তিনি দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তিনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল বর্ণনা দেন তিনি। তাঁর সে অসামান্য বক্তব্য ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।এ বক্তব্যের জন্যে মুজতবা ও তাঁর পরিবারকে হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হতে হয়।
জীবন সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেন”..... অভিজ্ঞতা সমষ্টির নাম জীবন।.... এক প্রকার অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি- মালা হয় তারই নাম জীবন।”
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সংগঠক
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এনসিপির ঢাকা অফিসে ব্রিটিশ হাইকমিশনার, নির্বাচন ইস্যুতে নাহিদের সঙ্গে বৈঠক
আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গুলির খোসা উদ্ধার
প্রধান উপদেষ্টা কাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন
ছাগলনাইয়ায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষে আর্থিক সহায়তা
মেহেরপুরে পুলিশ সুপারের বাসভবনে আগুন
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মদিনার ইসলামে বিশ্বাসী, মওদুদীর ইসলামে নয়: হাফিজ ইব্রাহিম
২৯৯ আসন বিএনপিকে উপহার দিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে : দীপেন দেওয়ান
চট্টগ্রাম বন্দর ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি সাক্ষর
কমলগঞ্জে শখের বসে শেখা বাঁশিই এখন কৃষ্ণ দাসের জীবিকা
দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও গোয়েন্দাপ্রধান গ্রেফতার
কমলগঞ্জে রেললাইনে স্লিপার ফেলে ট্রেন দুর্ঘটনার চেষ্টা
এবার ধোলাইপাড়ে বাসে আগুন
জাতীয় নির্বাচনে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা : তারেক রহমান
দিনাজপুরের হাকিমপুরে ফার্মেসীতে মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ
স্বাধীনতা হারাতে পারে বিচার বিভাগ, বর্ধিত ক্ষমতা ও আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রেলওয়ের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
১৩ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি
নকলায় তিন বেকারিকে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত
নাশকতা প্রতিরোধে আমিনবাজারে পুলিশের বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন