ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনাফাখোরের প্রতি সতর্কবাণী

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

২৮ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৯ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৩৩ পিএম

পবিত্র রমযান মাস আসলে অনিবার্যভাবে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এর ইতিবাচক দিক হল, ব্যবসায়ী মহল ব্যাপকভাবে যাকাত ফিতরা দান সদকা দেন। তাতে সমাজের গরীব অসহায় মানুষের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়া লাগে। দেশের অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়।

নেতিবাচক দিকটি হল, রমযানে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বর্ধিত চাহিদার সুযোগটা লুফে নেয়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বি হয়। ফলে সাধারণ মানুষের; বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে পড়ে।
শোনা যায় পৃথিবীর অমুসলিম দেশগুলোতে জাতীয় উৎসবে, ধর্মীয় উপলক্ষগুলোতে দ্রব্যমূল্যে বিরাট ছাড় ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা আসে যুগপৎ ব্যবসায়ী ও সরকারী মহল থেকে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিটি পরতে যেখানে আল্লাহর ওয়াস্তে দান ও আত্মত্যাগের শিক্ষা মিশে আছে সেখানে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল রমযানের রোযা পালন করার সময় এলে গণমানুষের উপর জুলুম শোষণের স্টীমরোলার চালাতে মুনাফাখোরদের বিবেকে বাধে না। আবার তারাই যাকাতের শাড়ী লুঙ্গী বিতরণের মহড়া দিয়ে ঈদের মাঠে ভালো মানুষের চেহারায় আবির্ভুত হয়।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ানো নিশ্চিতভাবেই মিথ্যা বা ঠকবাজিরই নামান্তর। কাজটি কত গর্হিত, আল্লাহর কত অপছন্দনীয় এবং এর পরিণতি কত ভয়াবহ তা অসাধু ব্যবসায়ীরা চিন্তা করে দেখে না। কুরআন মজীদে আল্লাহ পাক অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন :

‘চরম দুর্ভোগ তাদের জন্য (বা ওয়াইল নামক দোযখে যেতে হবে তাদেরকে) যারা মাপে কম করে। (আল্লাহ পাক আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলছেন) যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণমাত্রায় নেয়। (নিজের হিসাবটা ঠিক মত বুঝে নেয়)। যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। (ঠকায়। ব্যবসায়ে প্রতারণা ও ঠকবাজির এই কাজটি কাফেরদের চরিত্রের মতো। আল্লাহ পাক জিজ্ঞাসা করেন) তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা (মরণের পর) পুনরায় উত্থিত হবে। যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ^ পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়। নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জিনে আছে। (সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত-১-৮)

আমরা মনে করি, নামায না পড়লে, রোযা না রাখলে, হজ না করলে, বা যাকাত না দিলে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। অথচ লক্ষ্য করুন, ব্যবসায়ে প্রতারণা ও ঠকবাজি করলে পাপী হিসেবে সাব্যস্ত হতে হবে। উক্ত আয়াতে তাদেরকে পাপী হিসেবে জাহান্নামীদের কাতারে দাঁড় করানো হয়েছে।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, আমরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করি নিরূপায় হয়ে। যারা বড় বড় ব্যবসায়ী, তারা বাজারের চাহিদা বুঝে পণ্যের মজুদ গড়ে তোলে, তারপর নাম বাড়িয়ে দেয়ার পর বাজারে ছাড়ে। কাজেই আমরা বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য। আরেকটি গোষ্ঠী আছে যাদের পণ্য মজুদ করার বা ধরা ছোঁয়ার কষ্টও করতে হয় না। রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি বাজারে মাল আসার আগে পথে পথে চাঁদাবাজি বা দালালি করে। ব্যবসায়ীরা তখন মোটা অংকের টাকা তাদের পকেটে তুলে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে তাদের কাছে জিম্মি। শরীয়তের বিধানে এই শ্রেণীটি ঠকবাজ প্রতারক ব্যবসায়ীদের চেয়েও মারাত্মক। এরা পাপী, মজুতদার।

মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বাজারে চাহিদা আছে এমন পণ্য গুদামজাত করে রাখা এবং মূল্যবৃদ্ধির পর তা বাজারে সরবরাহ করার নাম মজুতদারী। একাধিক হাদিসে নবী করিম (সা) এই মজুতদারীর পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। কুরআন মজীদে যে অর্থে কারুন ফেরাউনকে আল্লাহ তাআলা পাপী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মজুতদাররাও সেই হিসেবে পাপী। হযরত মা‘মার (রা) হতে বর্ণিত হাদিসে নবীজি বলেছেন, পাপী লোক ছাড়া কেউ মজুদদারী করে না। (মুসলিম)

নবী করিম (সা) সতর্ক করেছেন, যে ব্যক্তি মুসলিম সমাজে (বর্ধিত মূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে) খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র দিয়ে শাস্তি দিবেন। (ইবনে মাজাহ)
কাজটি কত গুরুতর ও গোনাহের তা আরেকটি হাদিস দ্বারা অনুমান করা যায়। নবীজি বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কোনো পণ্য চল্লিশ দিন মজুদ রাখলে যে গোনাহ হবে পরে সম্পূর্ণ মাল সদকা করে দিলেও সে গুনাহ মোচন হবে না।’

মজুতদারের চেয়েও ভয়াবহ হল দালাল শ্রেণী, চাঁদাবাজ বা বাজার সিন্ডিকেটের কুশিলব। তাদের বেলায়ও কুরআন হাদীসের একই সতর্কবাণী প্রযোজ্য।

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘যারা বিক্রি করার জন্য (বাইরে হতে) খাদ্যজাত সামগ্রী নিয়ে বাজারে আসছে, তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মিলিত হবে না। (অর্থাৎ তাদের মাল ক্রয় করে নেবে না। কাজটি সম্পূর্ণ অবৈধ) কেউ এরূপ করলে বিক্রেতা বাজারে পৌঁছার পর তার জন্য বিক্রয়চুক্তি ভঙ্গ করার সুয়োগ থাকবে। (মুসলিমের বরাতে মিশকাত, ২৭২৩)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বিক্রি সামগ্রী বাজারে এসে পৌঁছার আগে ক্রয়ের জন্য সামনে এগিয়ে যেও না। (বুখারী ও মুসলিমের বরাতে মিশকাত ২৭২৪) এ মর্মে বর্ণিত হাদিস দ্বারা দালালি, চাঁদাবাজি ও বাজার সিন্ডিকেট নিষিদ্ধ এবং হারাম হওয়া প্রমাণিত।

প্রশ্ন হল, এদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ আছে কিনা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সাধাণত সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর পেছনে যুক্তিও আছে। সরকার পণ্যের উপর আরোপিত কর হ্রাস করার মতো সিদ্ধান্ত দিলে অনেক ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যায়। তবে অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ বা পণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তাহলে পণ্যের মূল্য আরো বেশি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ব্যবসায়ীরা কখনো লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করে না। এমন পরিস্থিতি হলে তারা পরিষ্কার বলবে, পণ্যটি আমাদের কাছে নেই। আবার বর্ধিত মূল্য পেলে গোপনে বিক্রি করবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি শাশ্বত এবং সকল রোগের প্রতিষেধক। ইসলামের নীতি মুক্তবাজার। অর্থাৎ উৎপাদনকারীকে তার পণ্য সরাসরি বাজারে এনে বিক্রি করার সুযোগ করে দিতে হবে। পথে পথে চাঁদাবাজি, দালালি বা সিন্ডিকেটের জাল বিছানো থাকলে ছিন্ন করতে হবে। এ দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকে। উপরোক্ত দুটি হাদিসে এ কথাই বলা হয়েছে। পণ্যদ্রব্য যদি মুক্তভাবে বাজারে প্রবেশ করতে পারে বাজারই দাম ঠিক করে দেবে। বিক্রেতা ও ক্রেতার দামাদামিতে সঠিক মূল্য নির্ণিত হবে।

পবিত্র মাহে রমযানে প্রত্যেকের মনে আল্লাহর ভয় ও সমাজের প্রতি দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হোক। ইসলামের এ শিক্ষা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়–কÑএই কামনা করছি।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এমবাপে-দেম্বেলের জোড়া গোলে পিএসজির অনায়াস জয়

এমবাপে-দেম্বেলের জোড়া গোলে পিএসজির অনায়াস জয়

হিন্দুদের মুসলমানদের কবর জিয়ারত করা প্রসঙ্গে।

হিন্দুদের মুসলমানদের কবর জিয়ারত করা প্রসঙ্গে।

সংস্কারের পর ফিরছে বিটলস নিয়ে নির্মিত ‘লেট ইট বি’

সংস্কারের পর ফিরছে বিটলস নিয়ে নির্মিত ‘লেট ইট বি’

বিয়ে না করেই সংসার করছেন মিমি চক্রবর্তী!

বিয়ে না করেই সংসার করছেন মিমি চক্রবর্তী!

দর্শক টানতে টিকেটের সাথে বিরিয়ানি ফ্রি

দর্শক টানতে টিকেটের সাথে বিরিয়ানি ফ্রি

শিল্পী সমিতির সদস্যদের ফ্রি চিকিৎসার ঘোষণা

শিল্পী সমিতির সদস্যদের ফ্রি চিকিৎসার ঘোষণা

পিকআপে রাখা বিশেষ কায়দায় ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার

পিকআপে রাখা বিশেষ কায়দায় ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার

ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে গীতিকবি আসিফ ইকবালের সর্বাধিক গান

ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে গীতিকবি আসিফ ইকবালের সর্বাধিক গান

সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় শিল্পী সমিতির দুঃখ প্রকাশ

সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় শিল্পী সমিতির দুঃখ প্রকাশ

রবি’র ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

রবি’র ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

আত্মীয়ের জানাজা শেষে বাড়ি ফেরা হলো না মা-ছেলের, সড়কে গেল প্রাণ

আত্মীয়ের জানাজা শেষে বাড়ি ফেরা হলো না মা-ছেলের, সড়কে গেল প্রাণ

শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ চাই

শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ চাই

আত্রাই নদীর অস্তিত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে

আত্রাই নদীর অস্তিত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে

সুপারশপের বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে

সুপারশপের বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে

টেন মিনিট স্কুলের কোর্স ফি-তে বিকাশ পেমেন্টে ২০০ টাকা পর্যন্ত ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাক

টেন মিনিট স্কুলের কোর্স ফি-তে বিকাশ পেমেন্টে ২০০ টাকা পর্যন্ত ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাক

সোনালী লাইফে প্রশাসক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত

সোনালী লাইফে প্রশাসক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত

সাসটেইনেবিলিটি এক্সিলেন্সের জন্য ‘ইকোভাডিস সিলভার মেডেল’ পেল সিগওয়ার্ক

সাসটেইনেবিলিটি এক্সিলেন্সের জন্য ‘ইকোভাডিস সিলভার মেডেল’ পেল সিগওয়ার্ক

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে সাব্বির আহমেদকে নিয়োগ দিল ভিসা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে সাব্বির আহমেদকে নিয়োগ দিল ভিসা

গণকবরে লাশ খুঁজছেন শত শত ফিলিস্তিনি মা

গণকবরে লাশ খুঁজছেন শত শত ফিলিস্তিনি মা