সিন্ডিকেটের ‘মেডিকিট’ ধরা খেলো
১৮ মে ২০২৫, ১২:৫২ এএম | আপডেট: ১৮ মে ২০২৫, ১২:৫২ এএম

বিতর্কিত ও অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্রপাতি সরবরাহের দায়িত্ব দেয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। হাসপাতালটিতে এমআরআই ও সিটিস্ক্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পেয়েছিল ‘মেডিকিট’ নামে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। শর্ত অনুযায়ী, যন্ত্রপাতি সরবরাহে জালিয়াতির দায়ে প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতার সনদ বাতিল করা হয়েছে। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সরকারী কর্মচারী হাসপাতালকে পাঁচ শ’ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. সিদ্দিকুর রহমান এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জিডি-১০ প্যাকেজের আওতায় থাকা এমআরআই ও সিটিস্ক্যান মেশিন আর সরবরাহ করতে পারবে না। নতুন করে দরপত্র আহ্বান ও মেশিন সরবরাহ করা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এতে করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা এমআরআই ও সিটিস্ক্যান পরীক্ষা করাতে পারবেন না। বেসরকারি হাসপাতালে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দরিদ্র রোগীদের পক্ষে এ ব্যয় নির্বাহ করে চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। ফলে ভোগান্তি বাড়বে দরিদ্র রোগীদের। সংশ্লিষ্টরা এ জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রকল্প পরিচালককে দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে এ হাসপাতালের কেনাকাটা একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই সিন্ডিকেটটি কমিশন বাণিজ্য করে অনভিজ্ঞ ও বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর ওই সিন্ডিকেটকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপরই যন্ত্রপাতি সরবরাহে অনিয়মের বিষয়টি নজরে এসেছে।
প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ (এম সংশোধিত) প্রকল্পের পণ্য প্যাকেজ জিডি-১০ : রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য মেডিকিট করপোরেশনের সাথে প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দরপত্র ও চুক্তির শর্ত মোতাবেক কান্ট্রি অব ম্যানুফেকচারিং, কান্ট্রি অব অরজিন এবং কান্ট্রি অব শিপমেন্ট একই হওয়ার কথা থাকলেও জিই হেলথকেয়ার ব্র্যান্ডের এমআরআই ১ দশমিক ৫ টেসলা মেশিন, সিটি স্ক্যান, বোন মিনারেল ডেনসিটোমেটারি (বিএমডি), রেডিওলজি কালার ডপলার ইউএসজি ইউথ ইলাস্ট্রোগ্রাফি, রেডিওলজি কালার ডপলার ইউএসজি আইটেসসমূহের শর্ত ভঙ্গ করে যথাক্রমে আমেরিকা, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও নরওয়ের পরিবর্তে সিঙ্গাপুর থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এমআরআই ১ দশমিক ৫ টেসলা মেশিন শিপমেন্টের আগে পিএসআই করানো হয়েছে আমেরিকায় ও সিটিস্ক্যান পিএসআই করানো হয় জাপানে। ক্রয়সংক্রান্ত রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য বিল অব এন্ট্রির কপি দাখিল করার জন্য কয়েকটি চিঠি দেয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ নভেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেডিকিট করপোরেশন থেকে দাখিলকৃত বিল অব এন্ট্রি ঢাকা কাস্টমস হাউজ থেকে যাচাই করা হয়। যাচাইকৃত বিল অব এন্ট্রিসমূহে উক্ত জালিয়াতির বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া দাখিলকৃত বিল অব এন্ট্রিতে কনসাইন অথবা এক্সপোর্টারের স্থলে সিঙ্গাপুর শব্দটি মুছে দিয়ে দাখিল করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বাস্তবায়নাধীন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের রোল মডেল হাসপাতাল করার জন্য কাজ করা হচ্ছে সেখানেই অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কান্ট্রি অব ম্যানুফেকচারিং, কান্ট্রি অব অরজিনের পরিবর্তে সিঙ্গাপুর থেকে শিপমেন্ট করে অধিকন্তু বিল অব এন্ট্রি টেম্পার করে দাখিল করায় চুক্তিভঙ্গ ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ওই জালিয়াতি চিহ্নিত হওয়ার পর তাকে কারণ দর্শানো হয়। কিন্তু জবাব সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। বর্ণিত জালিয়াতির মাধ্যমে মেডিকিট করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী দেশের অসুস্থ রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীদেরর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ কারণে স্বাস্থ্য খাতের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি সরবরাহের/ব্যবসার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছেন। এ অবস্থায় পণ্য প্যাকেজ জিডি-১০-এর আওতায় ইজিপি সিস্টেমে ইস্যুকৃত অভিজ্ঞতার সনদ বাতিল করা হয়।
এর আগে বিতর্কিত ও অনভিজ্ঞ দুই প্রতিষ্ঠানকে রাজধানীর সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার কাজ দেয়ার অভিযোগ উঠে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়, মেডিকিট করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠানটির এমআরআই ও সিটিস্ক্যানের মতো ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার মতো অভিজ্ঞতা নেই। অন্যদিকে ওভারসিস মার্কেটিং করপোরেশন (ওএমসি) বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা করোনা মহামারির সময় কিট কেনায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল।
হাসপাতালটিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। এমআরআই ও সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ওই বছরের ৬ মার্চ একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এগুলো হলোÑ বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ, ড্যাফোডিল মেডি ওয়ার্ল্ড, লাইফস্ট্রিম ইন্টারন্যাশনাল, মেডি গ্র্যাফিক ট্রেডিং লিমিটেড ও মেডিকিট করপোরেশন। সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ টাকা কাজ পায় মেডিকিট করপোরেশন।
কেন্দ্রীয় ঔষাধাগার সূত্রে জানা গেছে, রক্তের গ্যাস বিশ্লেষক এবিজি মেশিনসহ ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতা আছে মেডিকিট করপোরেশনের। এমআরআই ও সিটি স্ক্যানের মতো ভারী যন্ত্রপাতি তারা কখনো সরবরাহ করেনি। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ ছিল, দরপত্রে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল, তাতে মেডিকিট করপোরেশন ছাড়া অন্যরা অযোগ্য বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা) ভঙ্গ করা হয়েছে। কাজ পাওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতা মেডিকিট করপোরেশনের ছিল না।
দরপত্রে অংশগ্রহণ করা একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত কোনো প্রকল্প চলাকালীন প্রকল্প পরিচালককে সরানোর নজির কম। বড় কোনো কারণ ছাড়া কখনো প্রকল্প পরিচালককে সরানো হয় না। কিন্তু দরপত্র আহ্বান করার পরপরই প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মনিরুজ্জামনকে সরিয়ে যুগ্মসচিব ফরহাদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেন।
হাসপাতালের পৃথক একটি দরপত্রে ওভারসিস মার্কেটিং করপোরেশন (ওএমসি) জেনেসিস ট্রেডিং করপোরেশন, এইচটিএমএস লিমিটেড এবং এমএস হারামাইন এন্টারপ্রাইজ অংশগ্রহন করে। সর্বনি¤œ দরদাতা ছয় কোটি ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় কাজ পায় হিসেবে ওএমসি। প্রতিষ্ঠানটি সিটি স্ক্যান ছাড়াও অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, অটো ইউরিন অ্যানালাইজার, অটো ইমিউনোসে অ্যানালাইজার, অটো হেমাটোলজি অ্যানালাইজার ও অ্যাপারেসিস মেশিন সরবরাহ করবে।
২০২১ সালে করোনা মহামারির সময় কিট সরবরাহের নামে সরকারের ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে ওএমসির বিরুদ্ধে। ওই সময় তারা ৪০০ টাকা মূল্যের কিট সাড়ে তিন হাজার টাকার কিনতে বাধ্য করেছিল সরকারকে।
চলতি বছরের ২৫ মার্চ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরো পাঁচটি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করেছে। এ পাঁচটি প্যাকেজ হলোÑ জিডি-১২এ, জিডি-১২বি, জিডি-১১বি, জিডি-১১সি এবং জিডি-১১ই। প্রত্যেকটিতেই মেডিকিট করপোরেশন নামের এই প্রতিষ্ঠানটি অংশগ্রহণ করেছে। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে মেডিকিট করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী শামীম আশরাফী ইনকিলাবকে বলেন, জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি। মো. সিদ্দিকুর রহমান নামে একজন প্রকল্প পরিচালক কার্যাদেশ বাতিল করেছিলেন। তবে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। ইতোমধ্যে বিলও হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সার্বিক বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. রফিকুল হকের সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার কথা বলতে চাইলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

তিন সেঞ্চুরিতে ভারতের ৪৭১,পোপের ব্যাটে জবাব দিচ্ছে ইংল্যান্ড

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

উচ্চ আদালত খুলছে আজ

ফরাসি সংস্থাকে তাড়িয়ে ইউরেনিয়াম খনি জাতীয়করণ করছে নাইজার

তুর্কি সাংবাদিক উজায় বুলুতের প্রবন্ধ প্রোপাগান্ডামূলক ও ভিত্তিহীন : প্রেস উইং

ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক এরদোগানের

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামী শক্তির ঐক্য অপরিহার্য

উৎসবমুখর পরিবেশে অভয়নগরে বিজ্ঞানমেলা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে : ঝিনাইদহে প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

হাতিয়ায় তাঁতীদল নেতার বিরুদ্ধে অন্যের জমিতে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ

মৌলভীবাজার জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সভা

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

চৌদ্দ বা আঠারো মার্কা নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না- মাওলানা এটিএম মাসুম

"দখলদার দের বিরুদ্ধে আন্দোলন, খুনিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন"

এনবিআরে ফের কলম বিরতি

লক্ষ্মীপুরে ছালেহা হত্যার ক্লু ৬ দিনেও উদঘাটন হয়নি

সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বিএনপি

ওএসডি হলেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত জেলা প্রশাসক

হিলি স্থলবন্দরের পানামাপোর্টের শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালন

হিলি স্থলবন্দর আন্দোলন প্রত্যাহার কাজে ফিরেছে শ্রমিকীরা