জাতীয় নির্বাচন : এপ্রিল নয়, কেন ডিসেম্বর-জানুয়ারিই যুক্তিযুক্ত

Daily Inqilab ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল

১১ জুন ২০২৫, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ১১ জুন ২০২৫, ১২:১৭ এএম

জুলাই পরবর্তী ঐক্যমতের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ এখন রাজনৈতিক স্বচ্ছতার বড় পরীক্ষা। জনআস্থার প্রশ্নে নির্বাচন পেছানো কতটা যৌক্তিক?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন এক পরিবর্তনমুখী সন্ধিক্ষণে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান শুরুতে বলেছিলেন, সীমিত সংস্কার হলে নির্বাচন ডিসেম্বরেই সম্ভব; আর ব্যাপক সংস্কার হলে সময় গড়িয়ে যেতে পারে জুন পর্যন্ত। কিন্তু সর্বশেষ ঘোষণায় তিনি এপ্রিল মাসকে সম্ভাব্য নির্বাচনকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাহলে কি এখন ‘মধ্যম মাত্রার’ সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে? যদি তাই হয়, সেই সংস্কারের প্রকৃতি কী এবং তা বাস্তবায়নে অতিরিক্ত চার মাস সময়ের যৌক্তিকতাই বা কোথায়?

বাস্তবতা হলো, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন চায়। এ চাওয়া অগ্রাহ্য করে এপ্রিলের সময়সূচিকে প্রাধান্য দেয়া হলে তা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। জনগণ ও রাজনৈতিক অংশীজনের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ সৃষ্টি হবে যে, নির্বাচনের টাইমলাইন ঘিরে কোনো গোপন এজেন্ডা কি কাজ করছে?

১. ঐকমত্যের সংস্কার ও জুলাই সনদ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান একাধিকবার বলেছেন, যেসব সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেগুলো দ্রæত বাস্তবায়ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে কমিশনে তাদের মতামত দিয়েছে এবং সর্বসম্মতিক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কার কমিশন চাইলে স্বল্প সময়ের মধ্যে চ‚ড়ান্ত করা সম্ভব। এসব সংস্কার বাস্তবায়নে এক-দুই মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এছাড়া আসন্ন জুলাই সনদ ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মৌলিক সমর্থন অর্জন করেছে। এটি কেবল জুলাই গণহত্যার বিচারই নয়, বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো, নির্বাচনী পদ্ধতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে একটি ঐক্যমত্যভিত্তিক জাতীয় রূপরেখা। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে এপ্রিলে ঠেলে দেওয়া রাজনৈতিক আস্থার বিপরীতে একপ্রকার বার্তা বহন করবে। জনগণের মনে ধারণা দৃঢ় হতে পারে যে, কেউ কেউ সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করছে।

২. রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং অংশগ্রহণযোগ্য পরিবেশ : শীতকাল বাংলাদেশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক সহনশীল সময়। এ প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কারণ এ সময় জাতীয় পরীক্ষা থাকে না, আবহাওয়া শীতল থাকে এবং শহর-গ্রাম সর্বত্র মানুষের চলাচল স্বতঃস্ফ‚র্ত হয়। অন্যদিকে, এপ্রিল মাসে প্রচÐ খরতাপ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি নির্বাচনী অংশগ্রহণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। আরো উল্লেখ যে, ২০২৬ সনের মার্চ মাসের শেষ অবধি পর্যন্ত রোজা এবং ঈদের ছুটি থাকায় নির্বাচনী প্রচার ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। উপরন্তু, যদি এপ্রিলেও নির্বাচন সম্ভব না হয়, তবে পরবর্তী উপযুক্ত সময় হতে পারে নভেম্বর-ডিসেম্বর যা একটি দীর্ঘ অনির্বাচিত শাসনের ঝুঁকি তৈরি হবে।

৩. অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বাজেট প্রস্তুতি : নির্বাচন শুধুই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের সূচনাও। যদি ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হয়, তাহলে নতুন সরকার মার্চ-এপ্রিল নাগাদ পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা শুরু করতে পারবে। কিন্তু এপ্রিল মাসে নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার গঠন, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও বাজেট তৈরির জন্য সময় থাকবে মাত্র মাত্র দুই মাস। এটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করবে।

৪. আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ও ক‚টনৈতিক চাপ : জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান, কমনওয়েলথসহ অনেক কৌশলগত অংশীদার রাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনী রূপরেখা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচন হলে তা বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক, উন্নয়ন সহযোগিতা ও বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। অন্যদিকে নির্বাচন পেছালে আন্তর্জাতিক আস্থা ও সমর্থন দুর্বল হতে পারে।

৫. নির্বাচন বিলম্বের আড়ালে রাজনৈতিক এজেন্ডা? : জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও এখনো পর্যন্ত তাদের ঘোষিত রোডম্যাপ বা কর্মকৌশল স্পষ্ট নয়। বিশেষত নির্বাচন নিয়ে সময়সূচি পরিবর্তন ও দোদুল্যমানতা জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। এখন যখন সর্বদলীয় ঐকমত্য ও জুলাই সনদ গৃহীত হতে চলেছে, তখন নির্বাচনকে এপ্রিলে পিছিয়ে দেওয়া মানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বিলম্বের ইঙ্গিত। এ বিলম্বের আড়ালে নতুন কোনো রাজনৈতিক বলয় তৈরি, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস বা পূর্বনির্ধারিত শক্তিকে নির্বাচনী সুবিধা দেয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কা এখন শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সাধারণ জনগণের মধ্যেও প্রবল হচ্ছে।

উপসংহার :
গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ নির্বাচন ঐতিহ্যগতভাবেই শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই রীতি জনমনে সুসংহত হয়ে গেছে। সেখান থেকে অকারণে সরে আসা রাজনৈতিক স্বাভাবিকতাকে বিঘ্নিত করবে এবং স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। জাতীয় নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নয় এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ঐতিহাসিক সুযোগ। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন না হলে তা রাজনৈতিক আস্থার ভাঙন, অর্থনৈতিক দোলাচল এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে দূরত্বের জন্ম দিতে পারে। তাই এই মুহ‚র্তে অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্ণ সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি সময়মতো, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। এটি কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার খেলা নয়; এটি একটি জাতির স্বপ্ন পূরণের বাস্তব পথচলা।
লেখক : ফুল ফ্যাকাল্টি, সেন্টার ফর গেøাবাল অ্যান্ড লোকাল ইনফেকশাস ডিজিজেস, ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মানিকগঞ্জে করোনা মোকাবেলায় আগাম ব্যবস্থাপনা গ্ৰহন করা হয়েছে -  সিভিল সার্জন

মানিকগঞ্জে করোনা মোকাবেলায় আগাম ব্যবস্থাপনা গ্ৰহন করা হয়েছে - সিভিল সার্জন

তীব্র তাপদাহের পর অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি পাঁচবিবিতে

তীব্র তাপদাহের পর অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি পাঁচবিবিতে

নবীগঞ্জে চলন্ত বাসে এক কলেজ ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণে মেতে উঠলো চালক ও হেলপার : আটক চালক

নবীগঞ্জে চলন্ত বাসে এক কলেজ ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণে মেতে উঠলো চালক ও হেলপার : আটক চালক

দাউদকান্দিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা মানছে না ঠিকাদার , সংঘর্ষের আশঙ্কা

দাউদকান্দিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা মানছে না ঠিকাদার , সংঘর্ষের আশঙ্কা

শিক্ষকের ভুলে মাস্টার্সের ৯০ পরীক্ষার্থীর সবাই ফেল!

শিক্ষকের ভুলে মাস্টার্সের ৯০ পরীক্ষার্থীর সবাই ফেল!

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার মধ্যে জরুরি বৈঠকে জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার মধ্যে জরুরি বৈঠকে জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থা

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের যে ত্যাগ, সেই পথেই দেশ অগ্রসর হবে

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের যে ত্যাগ, সেই পথেই দেশ অগ্রসর হবে

যুদ্ধ নয়, শান্তি চায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন

যুদ্ধ নয়, শান্তি চায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন

তরুণদের সুখবর দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

তরুণদের সুখবর দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, অটুট সংহতিতে ইরান

ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, অটুট সংহতিতে ইরান

নীলফামারী সরকারী কলেজের জায়গা হস্তান্তর না করার দাবীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

নীলফামারী সরকারী কলেজের জায়গা হস্তান্তর না করার দাবীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

নাসিরনগর সড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ে সেনাবাহিনী নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান

নাসিরনগর সড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ে সেনাবাহিনী নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান

নারায়ণগঞ্জের বন্দরে গণপিটুনিতে নিহত ডাকাত , দোকান মালিক সহ আটক-২

নারায়ণগঞ্জের বন্দরে গণপিটুনিতে নিহত ডাকাত , দোকান মালিক সহ আটক-২

ইরানের পুনর্গঠন সক্ষমতায় বিস্মিত ইসরায়েল : মার্কিন বিশ্লেষক

ইরানের পুনর্গঠন সক্ষমতায় বিস্মিত ইসরায়েল : মার্কিন বিশ্লেষক

ধামরাই থানায় ৫ মাস যাবৎ পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত নেই

ধামরাই থানায় ৫ মাস যাবৎ পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত নেই

লন্ডন থেকে দেশে ফিরে যে বার্তা দিলেন আমীর খসরু

লন্ডন থেকে দেশে ফিরে যে বার্তা দিলেন আমীর খসরু

দুই উপদেষ্টার বক্তব্যে আমরা আশাহত" - এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সিলেটে বৃহত্তর জৈন্তিয়া উন্নয়ন পরিষদ

দুই উপদেষ্টার বক্তব্যে আমরা আশাহত" - এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সিলেটে বৃহত্তর জৈন্তিয়া উন্নয়ন পরিষদ

সাংবাদিকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলেন সমু চৌধুরী

সাংবাদিকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলেন সমু চৌধুরী

স্টেম ইনোভেশন লিগ ২০২৫ -এ প্রথম স্থান অর্জন করল গ্লেনরিচ সাতারকুল

স্টেম ইনোভেশন লিগ ২০২৫ -এ প্রথম স্থান অর্জন করল গ্লেনরিচ সাতারকুল

হামজার পর এবার দেশে আসলেন যুক্তরাজ্যের পিপি রেঞ্জার্স ক্লাবের ফুটবলার সিলেটের তানভীর

হামজার পর এবার দেশে আসলেন যুক্তরাজ্যের পিপি রেঞ্জার্স ক্লাবের ফুটবলার সিলেটের তানভীর