আল-কুরআনের যুগান্তকারী অর্থনীতি
১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম
মানবজীবনে অর্থ-সম্পদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সাধারণত খাদ্য-বাসস্থান ছাড়াও একজন মুসলমানের নামাজ আদায়ের জন্যও অতি প্রয়োজন কিছু অর্থের। কারণ সতর ঢাকার জন্য কাপড়, অজু-গোসলের জন্য পানি তো তাকে কিনতেই হবে। সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, সমরনীতি প্রভৃতি পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থের বিকল্প নেই। তাই প্রচলিত অর্থনীতিগুলোকে কুরআনের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের পূর্বে আমরা দেখব অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে কুরআন কী বলে?
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন গবেষণা করলে আমরা দেখতে পাই, অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা সবসময়ই ইতিবাচক। পবিত্র কুরআনে সম্পদকে ‘খাইর’ (উত্তম) বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, তোমরা যে (খাইর) সম্পদ ব্যয় কর তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য (ব্যয় করবে)। আর তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২১৫)। উক্ত আয়াতে সম্পদের দুটি দিক নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। (১) অর্থ উপার্জন, (২) তার ব্যয় ব্যবস্থাপনা। উক্ত আয়াতে উল্লেখিত ‘খাইর’-এর শাব্দিক অর্থই হল ভালো। আল্লাহপাক মুমিনের সম্পদকে ‘খাইর’ তথা উত্তম ও ভালো আখ্যা দিয়েছেন সঙ্গত কারণেই। কারণ মুমিন যা উপার্জন করবে তা তো উত্তমই হবে। সে তো মন্দ কামাই করবে না। অন্য আয়াতে সম্পদকে ‘ফদল’ (অনুগ্রহ) বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ আল্লাহর অনুগ্রহের (সম্পদের) সন্ধানে দেশভ্রমণ করবে’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : আয়াত-২০)। এ সম্পর্কে আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (সম্পদ) অন্বেষণ করবে’ (সূরা জুমুআ : আয়াত-১০)।
এর বিপরীতে অর্থ-সম্পদকে কুরআনে ‘কানজ’ (অনুমোদনহীন রিজার্ভ)ও বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভুত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও’ (সূরা তাওবা : আয়াত-৩৪)। উক্ত আয়াত নাজিল হলে সাহাবায়ে কেরামগণ ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্য কিছু না কিছু অনেকের কাছেই আছে। হযরত ওমর (রা.) রাসূল (সা.)-এর দরবারে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সা.) জবাবে বললেন, যে মালের যাকাত দেওয়া হয় না সেটাই হল ‘কানজ’। পক্ষান্তরে যে সম্পদের যাকাত দেওয়া হয়েছে সেটা ‘কানজ’ নয়। এতে বোঝা যায়, এখানে ‘কানজ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা কারুণের সম্পদকে ‘কানজ’ বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভাণ্ডার যার চাবিগুলো বহন করা একদল বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল’ (সূরা কাসাস : আয়াত-৭৬)।
দেখা যাচ্ছে, সঠিক পন্থায় আয় হলে এবং যথাযথ পন্থায় ব্যয় হলে কুরআনের দৃষ্টিতে অর্থ-সম্পদ অবশ্যই কল্যাণকর। তবে সঠিক পন্থায় উপার্জন ও ব্যয় না হলে সে সম্পদের মালিকের ভয়াবহ পরিণতির কথাও পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে। কুরআনে সম্পদের ক্ষেত্রে ‘ফিতনা’ শব্দের ব্যবহারও হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক ফিতনা বা পরীক্ষা’ (সূরা আনফাল : আয়াত-২৮)। আল্লাহপাক বিনা শর্তে কাউকে সম্পদ দেন না : বরং এ সম্পদ দিয়ে তিনি পরীক্ষা নেন। যাকে তিনি সম্পদ দেন তাকে কিছু দায়-দায়িত্বও দেন। ‘ফিতনা’-এর অর্থ এই নয় যে, বান্দা কোনো সম্পদ উপার্জন করতে পারবে না : বরং সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের পরীক্ষায় সে যেন উত্তীর্ণ হয় সেদিকেই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অর্থ-সম্পদ উপার্জনের মৌলিক ও স্বীকৃত যেসব পন্থা রয়েছে এর সবগুলোর আলোচনাই পবিত্র কুরআনে রয়েছে। যেমন, মানবজীবনের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য কৃষি খাতের কথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বিভিন্নভাবে বহু জায়গায় আলোচনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা যা বপন কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কী? তোমরা কী তা উৎপন্ন কর, না আমি তা ফলাই’ (সূরা ওয়াকিয়া : আয়াত ৬৩-৬৪)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তোমাদেরকে বসবাস করিয়েছেন’ (সূরা হুদ : আয়াত-৬১)। উক্ত আয়াতে ‘ইসতা’মারাকুম ফিহা’ অর্থ জমি আবাদ করা। ইমাম জাসসাস (র.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এ আয়াত দ্বারা কৃষি, ক্ষেত-খামার, বৃক্ষ রোপণ এবং ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য জমি আবাদ করা যে আবশ্যকীয় দায়িত্ব সে বিষয়টি সুস্পষ্ট’ (আহকামুল কুরআন)। উক্ত আয়াতে কৃষি থেকে শুরু করে খনিজ সম্পদ, জ্বালানি তেল, লোহা ইত্যাদি সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত। সম্পদ উপার্জনের স্বীকৃত পন্থাগুলোর অন্যতম হচ্ছে ব্যবসা। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৭৫)। কুরআনের সূরা জুমুআয়ও ইবাদত করার পাশাপাশি হালাল উপার্জন ও হালাল ব্যবসা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সূরা জুমুআ : আয়াত ৯-১১)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরে একে-অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে তোমাদের পারস্পরিক সন্তুষ্টি ক্রমে কোনো ব্যবসা করলে তা অবৈধ’ (সূরা নিসা : আয়াত-২৯)। উক্ত আয়াতে ব্যবসার নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে, ব্যবসা একপক্ষীয় নয়; বরং ব্যবসায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টি ও স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে।
অর্থ-সম্পর্দ উপার্জনের স্বীকৃত অন্যতম একটি পন্থা হল শ্রম। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন শ্রম ও শ্রমিকের কথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছে। কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জন করার পবিত্র নীতি নবী-রাসূলগণের মধ্যেও ছিল। পবিত্র কুরআনে হযরত মুসা (আ.)-এর শ্রমের ঘটনা বিধৃত হয়েছে এভাবে-‘তাদের (নারীদ্বয়ের) একজন বলল, ‘হে পিতা! তুমি ইহাকে মজুর নিযুক্ত কর। কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত। সে মুসাকে বলল, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই, এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে। মুসা বলল, আপনার ও আমার মধ্যে এই চুক্তি রইল। এই দুইটি মেয়াদের কোনো একটি আমি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকবে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলতেছি আল্লাহ্ তার সাক্ষী’ (সূরা কাসাস : আয়াত ২৬-২৮)। উক্ত আয়াতগুলোতে শ্রমের কথা, ভালো শ্রমিকের গুণের কথা এমনকি চুক্তির মেয়াদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ভালো শ্রমিকের দুটি গুণ যেমন শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত হওয়ার কথা উক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার মালিক পক্ষের আচরণ চাকুরে ও শ্রমিকের প্রতি কিরূপ হবে তাও উপরের আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ নিয়োগকর্তার দায়িত্ব হলো তার অধীনস্থদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে না দেওয়া। যদি কখনও কোনো ভারি কাজ তাদেরকে দেওয়া হয় তাহলে যেন তাদেরকে সাহায্য করা হয়। আর এজন্য রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমরা তাদের প্রতি কোনো ভারি কাজ অর্পণ কর তাহলে তাতে তাদেরকে সাহায্য করো’ (বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ঈমান : পৃষ্ঠা-০৯)। অর্থ উপার্জনের অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে শিল্প। পবিত্র কুরআনে সেই শিল্পের কথাও এসেছে বিভিন্নভাবে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি নাজিল করেছি লৌহ। যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ’ (সূরা হাদীদ : আয়াত-২৫)। আল্লাহ তায়ালা লোহার খনি দিয়েছেন। তখনকার এবং এখনকার বড় বড় সকল শিল্প লোহাভিত্তিক। আদিকাল থেকেই মানুষ লোহাকে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করে আসছে। যাতায়াত, বাসস্থান, যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্রসহ বহু শিল্পই লোহা ভিত্তিক। উক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হল অর্থ-সম্পদ উপার্জনের সকল পন্থাই বর্ণিত হয়েছে আল-কুরআনে। আর এসবকিছুর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে নবীজির হাদীসে।
অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে কুরআনের প্রথম কথা হল, সকল অর্থ-সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথাও তাই। সকল অর্থ-সম্পদের মূল মালিক যে মহান আল্লাহ সে বিষয়টি কুরআনে বার বার উচ্চারিত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘লিল্লাহি মা ফিস সামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদ’ অর্থাৎ আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর (সূরা বাকারা : আয়াত-২৮৪)। উক্ত আয়াতে ‘মা’ একটি ‘আম’ ব্যাপক শব্দ। কোনো কিছুই এর বাইরে নেই। অর্থ ও অর্থের উৎস দুটোই এর মধ্যে আছে। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘জিজ্ঞেস কর, এই পৃথিবী এবং ইহাতে যারা আছে তারা কার? যদি তোমরা জান? তারা বলবে ‘আল্লাহর’! বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’ (সূরা মুমিনুল : আয়াত ৮৪-৮৫)। আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান কর’ (সূরা নূর : আয়াত-৩৩)। উক্ত আয়াত দ্বারাও সুস্পষ্ট, মাল ও সম্পদের কেন্দ্রীয় ও নিরংকুশ মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আবার উক্ত আয়াত দ্বারা ব্যক্তি-মালিকানাও সুস্পষ্ট প্রমাণিত। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভবিষ্যতে পুতিনের সাথে সরাসরি কথা বলতে চান শলৎজ
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর ২২০০ সহিংসতা নিয়ে ভারতের তথ্য বিভ্রান্তিকর : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন হাফেজ কামরুল
ধামরাইয়ে ২টি ড্রেজার মেশিন জব্দ
রাবিতে অপরাধে জড়িত ৬ শিক্ষার্থী স্থায়ী বহিষ্কার, শাস্তি পেল মোট ৩৩ জন
রাণীশংকৈলে ফিল্মি স্টাইলে দোকান চুরি, ১৮ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও চোর ধরতে ব্যর্থ পুলিশ
মাগুরার শালিখায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন