হজের আহকাম ও আরকান এবং নিষিদ্ধ কার্যাবলি
০৮ মে ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৮ মে ২০২৫, ১২:১৩ এএম

আল্লাহর সন্তুষ্টি, প্রেম ও ভালোবাসা অর্জনের এক অনন্য প্রেমময় ও তুলনাহীন ইবাদত হজ্ব। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মুমিন বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি, ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের আশায় হজ্ব পালন করতে মক্কা মুকাররমায় ছুটে আসেন। বিশ্ব মুসলিমের এক অনন্য মহামিলনমেলা এ হজ্ব। অন্য কোনো জমায়েতই এর মত এত বড়, সার্বজনীন ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব উন্নয়নে সহায়ক নয়। লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবানের সমাবেশ ঘটে মক্কা নগরীতে এসময়। সকলের কণ্ঠে একই সুর, একই তালবিয়া, একই লেবাস সকলের পরনে। সবার অবস্থা যেন একরকম হয়ে যায়। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সবার কণ্ঠে এক লয়ে এক তালবিয়া, “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক”, অর্থ: “আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির, আপনার কোনো অংশীদার নেই, আমি হাজির। নিশ্চয় সকল প্রশংসা, নিয়ামত ও রাজত্ব আপনারই। আপনার কোন অংশীদার নেই।” আজকের কলামে আলোচনা করব হজ্বের প্রকারভেদ, হজ্ব ফরজ হওয়ার শর্তাবলি, হজ্বের প্রয়োজনীয় মাসআলা – মাসায়েল তথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত কাজসমূহ, হজ্বের ভেতর নিষিদ্ধ কাজসমূহ ও যেসব কারণে দম ওয়াজিব হয় সেসব বিষয়ে ইন শা আল্লাহ। হজ্বের সংজ্ঞা: ‘হজ্ব’ আরবি শব্দ। আরবি – বাংলা অভিধানে শব্দটির কয়েকটি অর্থ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো: ইচ্ছে করা, সংকল্প করা, ভ্রমণ করা, সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা এবং উলামায়ে কেরামের মতানুসারে মক্কা মুকাররমায় জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানসমূহে নির্দিষ্ট কতিপয় ইবাদতের সমষ্টিকে ‘হজ্ব’ বলা হয়। হজ্ব সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। আল্লাহ তাআলা এটি জীবনে একবার আদায় করা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর মানুষের উচিত আল্লাহর জন্য ঘরের (বায়তুল্লাহ শরীফ) হজ্ব করা, যারা সেখানে যেতে সক্ষম।”(সুরা আলে ইমরান:৯৭)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “আর তোমরা আল্লাহর জন্য হজ্ব ও উমরাহ পূর্ণ কর।” (সুরা বাকারা:১৯৬)
হজ্ব ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তম্ভ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, জাকাত আদায় করা, হজ্ব পালন করা এবং রমজান মাসের সাওম (রোজা) পালন করা।” (বুখারি, মুসলিম)
হজ্ব ফরজ হওয়ার শর্তাবলি: উলামায়ে কেরামের মতানুসারে হজ্ব ফরজ হওয়ার জন্য এমন কতিপয় শর্ত রয়েছে, যেগুলো একজন ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া গেলে তাঁর উপর হজ্ব ফরজ হবে এবং তিনি হজ্ব করার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। সেগুলো হচ্ছে: ১. মুসলিম হওয়া। কেননা কাফিরের উপর হজ্ব ফরজ নয়। সে ইসলাম থেকে বাহিরে থাকার কারণে তার উপর কোনো আমলই ফরজ নয় এবং কবুলযোগ্যও নয়। ২ ও ৩. আকেল ও বালেগ হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিন শ্রেণির লোকের উপর থেকে (শরয়ি দায়িত্বের) কলম উঠে গেছে: ঘুমন্ত ব্যক্তি সজাগ না হওয়া পর্যন্ত, শিশু তার স্বপ্নদোষ না হওয়া পর্যন্ত ও পাগল তার হুঁশ ফিরে না আসা পর্যন্ত।” (সুনানে আবু দাউদ) ৪.স্বাধীন হওয়া, সুতরাং ক্রীতদাসের উপর হজ্ব নেই। কেননা ক্রীতদাস তার মনিবের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত। ৫. সামর্থ্যবান হওয়া: অর্থাৎ মক্কা মুকাররমা মুকাররমার কাবা শরীফ যাওয়া পর্যন্ত শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যের অধিকারী হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর জন্য মানুষের উপর ঘরের (বায়তুল্লাহ শরীফ) হজ্ব আদায় করা উচিত, যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে।” (সুরা আলে ইমরান:৯৭) এখানে সামর্থ্য বলতে আল্লাহ তায়ালা শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্যকে বুঝিয়েছেন।
হজ্ব তাৎক্ষণিকভাবে ফরজ না বিলম্বের সাথে আদায় করা ফরজ: এ বিষয়ে ফকীহগণের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক (রহ:) এর মতে, হজ্ব তাৎক্ষণিকভাবে আদায় করা ফরজ। তাঁদের দলিল হলো আল্লাহর বাণী, “ মানুষের উপর আল্লাহর জন্য সে ঘরের (বায়তুল্লাহ শরীফ) হজ্ব করা উচিত, যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে।” (সুরা আলে ইমরান:৯৭) অন্যদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি হজ্ব আদায় করতে চায়, সে যেন দেরি না করে।” (মুসনাদে আহমাদ) জমহুর উলামায়ে কেরামের মতে এটিই বিশুদ্ধ মত।
হজ্বের প্রকারভেদ: উলামায়ে কেরামের মতে, হজ্ব সর্বমোট তিন প্রকার: ১. হজ্বে তামাত্তু: ভিন্ন ভিন্ন নিয়তে ও ইহরামে হজ্ব ও উমরাহ পালন করা, ২. হজ্বে ক্বিরান: একই নিয়ত ও ইহরামে হজ্ব ও উমরাহ পালন করা, ৩. হজ্বে ইফরাদ: শুধু হজ্ব পালন করা।
কোন হজ্ব উত্তম: কোন হজ্ব উত্তম, এ বিষয়ে ফকীহগণের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ:) এর মতে ক্বিরান হজ্ব সর্বোত্তম। কেননা এতে দীর্ঘদিন ইহরাম বেঁধে থাকতে হয়। এছাড়া নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্ব ছিল ক্বিরান হজ্ব। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি, বলেন, “আমি নবীজি (সা.) কে একত্রে হজ্ব ও উমরাহর তালবিয়া পাঠ করতে শুনেছি। তিনি বলছিলেন, “লাব্বাইকা উমরাতান ওয়া হাজ্জান”।” (মুসলিম) তবে ফোকাহায়ে কেরামের মতে যদি ক্বিরান হজ্ব পালনে দীর্ঘদিন ইহরামের নিষেধাজ্ঞাগুলো পালন করা সম্ভব না হয়, তবে তামাত্তু হজ্ব করাই উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামি)
হজ্বের ফরজ: হজ্বের ফরজ ৩টি: ১. ইহরাম বাঁধা। (সুনানে কুবরা:৯১৯০), ২.উকুফে আরাফা: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সূর্য হেলার পর থেকে ঈদুল আজহার দিন সুবহে সাদিক পর্যন্ত যেকোনো সময় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। এ সময়ের মধ্যে অতি অল্প সময়ও আরাফার ময়দানে অবস্থান করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। (তিরমিজি:৮১৪), ৩. তাওয়াফে জিয়ারত: আরাফায় অবস্থানের পর কাবায় সাতবার তাওয়াফ (চক্কর) করা।
হজ্বের ওয়াজিব সমূহ: হজ্বের প্রধানত ছয়টি ওয়াজিব কাজ রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে:
১.জিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সামান্য সময়ের জন্য হলেও মুজদালিফায় অবস্থান করা। (সুরা বাকারা:১৯৮, তিরমিজি:৮১৫), ২. সাফা মরওয়ায় সাতবার সায়ী করা বা চক্কর লাগানো। এটা সাফা থেকে শুরু হয়ে মারওয়ায় গিয়ে শেষ হবে। (মুসলিম:২১৩৭)
৩.যথাসময়ে রমি (শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ) করা। (মুসলিম:২২৮৬) ৪. তামাত্তু ও ক্বিরান হজ্বকারীরা দমে শোকর বা হজ্বের কুরবানি করা। ৫.হারামে কুরবানির দিনসমূহে মাথা মু-ানো বা চুল ছোট করা। (বুখারি, মুসলিম) ৬. মক্কাবাসী ছাড়া অন্যরা তাওয়াফে সদর বা তাওয়াফে বিদা করা। (মুসলিম)
হজ্বের সুন্নাতসমূহ: হজ্বের সুন্নাতসমূহ নি¤œরূপ:
১. ইহরাম বাঁধার সময় গোসল বা অজু করা ও শরীরে সুগন্ধি মাখা। (মুসলিম:৮/১০১, তিরমিজি:৭৬০)
২. নতুন বা পরিষ্কার চাদর পরা। সাদা হওয়া উত্তম। (তিরমিজি:৯১৫,২৭২৩)
৩. ইহরাম বাঁধার আগে দুরাকাত সালাত আদায় করা। (মুসলিম:২০৩১)
৪. বেশি বেশি তালবিয়া পড়া। (মুসলিম:২২৪৬)
৫.মক্কাবাসী ছাড়া অন্যরা হজ্বে ইফরাদ বা ক্বিরান করাকালে তাওয়াফে কুদুম করা। (মুসলিম:২১৩৯)
৬. মক্কায় থাকাকালীন বেশি বেশি তাওয়াফ করা। (তিরমিজি:৭৯৪)
৭. ‘ইজতিবা’ করা। এটা হলো তাওয়াফ শুরু করার আগে চাদরের এক দিককে নিজের ডান বাহুর নিচে রাখা এবং অপর দিককে বাম কাঁধের উপর পেঁচিয়ে দেওয়া। (তিরমিজি:৭৮৭)
৮.তাওয়াফের সময় রমল করা। রমলের পদ্ধতি হলো তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করের সময় ঘনঘন কদম ফেলা ও উভয় কাঁধ হেলাতে হেলাতে চলা। (বুখারি:১৫০১)
৯.কুরবানির দিনগুলোতে মিনায় রাতযাপন করা। (আবু দাউদ:১৬৮৩)
লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

মাগুরার গ্রামে সংঘর্ষে হাতবোমা বিস্ফোরণ বোমাবাজসহ তিনজন গ্রেফতার, আহত ১০ জন

সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মোদিকে মমতার চিঠি

পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ বিমান হামলা

মারা গেছেন শিল্পপতি সঞ্জয় কাপুর

ভারতের বিমান দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করলেন ট্রাম্প

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ২ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত

বিদেশী জিহাদী কাফেলা আখ্যা দিয়ে ‘কাফেলাতুস সুমুদকে’ প্রতিরোধের ঘোষণা ইসরাইলের

ঈদের ছুটি শেষ : সরকারি-বেসরকারি কলেজ খুলবে রোববার

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান নিহত

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা, পাল্টা জবাবের আশঙ্কায় ইসরাইলজুড়ে সতর্কতা

অবাধে চলছে রেনু পোনা শিকার, ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীব বৈচিত্র্য

তেহরানের আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল

ইরানে হামলা: ট্রাম্পের সহযোগী বলল ‘খেলা শুরু’

পটুয়াখালীর গলাচিপায় বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, বিএনপি অফিস ভাংচুর

মধ্যরাতে ইরানে ইসরায়েলের হামলা, উত্তেজনা তুঙ্গে

উইম্বলডনের প্রাইজমানি বাড়ল ৭ শতাংশ

ঈশ্বরগঞ্জে বিএনপির কর্মী সম্মেলনে মানুষের ঢল

যশোর রেলস্টেশনে ভারতীয় কসমেটিকসহ আটক ৩

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা

বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ছাগলনাইয়া মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ