রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আখলাক

Daily Inqilab এ.কে.এম ফজলুর রহমান মুন্সী

০৮ মে ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৮ মে ২০২৫, ১২:১৩ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
শিয়া এবং সুন্নীদের মতের মাঝে আকাশ-পাতাল প্রভেদ বিদ্যমান। সুন্নীগণ আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে মধ্যস্থরূপে একজন ইমামের প্রয়োজন মনে করেন না। তাদের মতে প্রত্যেক বিশ্বাসী প্রেমিকের পক্ষে আল্লাহর সাথে মিলন সম্ভবপর; সুতরাং শিয়াদের বিশ্বাস যথা মনোনীত ইমামের মধ্যে আল্লাহর খানিকটা সত্তার অবস্থিতি এবং সুন্নীগণের বিশ্বাসের মধ্যে প্রায় দুই বিপরীত মেরুর দূরত্ব বিদ্যমান। ঠিক এইভাবে মুসলমান সাধক পুরুষগণের প্রতি এই দুই দলেল সম্মান প্রদর্শনের মূল এবং উদ্দেশ্যও অনেকাংশে বিভিন্ন; সুতরাং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বৈপরীত্য ও সংঘর্ষের।এই দুই দলে মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ বৈপরীত্য ও সংঘর্ষের। এই দুই দলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ঘটে ‘হাল্লাজ’-এর হত্যার ব্যাপারে ইমামী শিয়া আবু সহল আল নাওবাখতী-এর সক্রিয় অংশগ্রহণে। হাল্লাজের এই দাবী যে, তিনি সেই যুগের গুপ্ত ইমামের ওয়াকীল-শিয়াদেরকে গুরুতরভাবে আঘাত করেছিল।

শিয়াগণ দার্শনিকগণকেও সন্দেহের চোখে দেখতেন। ‘গুলাত’-এর ব্যাপারে সমস্ত ইমামীগণ মনে করতেন দার্শনিক মতবাদ শিয়া মতবাদের ভিত্তিগাত্রে আঘাত হানতে পারে। তবে, এমন অনেক গুঢ়বাদী ও দার্শনিকও আছেন যারা খাঁটি শিয়া বলে পরিচিত এবং শুধু প্রচলিত বিতর্কের ধারায় তাদেরকে শিয়াদলের বহির্ভূত বলা যাবে না। শিয়া, সুন্নী এবং দার্শনিকদের মধ্যে পারস্পরিক অনুকরণ ও বিরাগ এবং আকর্ষণ ও বিকর্ষণের দৃষ্টান্ত পাশাপাশি বিরাজমান দেখা যায়। সে যাই হোক, ইমাম গাযযালী (রহ:) ইমামী বাতেনী শিয় মতবাদে বিশ্বাসী বন্ধুর সাথে মোনাজারাহ বা বির্তকের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে উপস্থাপন করতে গিয়ে “সঠিক দাঁড়িপাল্লার” দ্বারা বিচার বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং ইমামী বাতেনী মতবাদের অনুসারী বন্ধুকে হেদায়েতের পথে আনয়নে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইমামী বাতেনী শিয়াদের মাঝে আকীদাগত যে দিকটি তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আসার সুযোগ দিচ্ছে না, ইমাম গাযযালী (রহ:) সেই অন্ধকারের আবরণকে চিরতবে দূনীভূত করার পথ-নির্দেশনা প্রদান করেছেনÑআদাবুল আখলাক রিসালা-এর মাধ্যমে। মূল সত্যকে উদ্ঘাটন করার যে হিকমত তিনি বাতলে দিয়েছেন, এই দাঁড়িপাল্লার দ্বারা ঈমান ও আকীদা সংক্রান্ত সকল বিষয়ই ওজন করা যাবে এবং যথার্থ সত্য নিরূপণের পথ সহজতর হবে। এই হেকমত অনুধাবন করার তাওফীক সকলেরই নসীব হোক এই প্রত্যাশা আজকের একান্ত চাহিদা। “ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ”।

অবতরণিকা :
আখলাকে মুহাম্মদী (সা:)-এর বিশাল সমুদ্রে অবগাহন করা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। এই সমুদ্রের কূল নেই, কিনারা নেই, অতলতার পরিমাণ ও পরিমিতি নেই। কিন্তু এত কিছুর পরও ইমাম আবু হামিদ আল গাযযালী (রহ:) ‘আদাবুল আখলাক’ গ্রন্থে ভ্রমণকারীদের দিন-নির্দেশনাসূলভ সংকেত প্রদান করেছেন। এজন্য ভ্রমণেচ্ছুদের উচিত আখলাক সম্পর্কে জানা, এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া, নৈতিকতার ভিত্তি কি, তা অনুধাবন করা, ধর্মে নৈতিকতার বুনিয়াদ কতখানি তা উপলব্ধি করা এবং নৈতিক চরিত্র ও ইসলামের সম্পর্ক উদঘাটন করা। এ প্রসঙ্গে আল্লামা শিবলী নু’মানী উল্লেখ করছেন :

আখলাক সম্পর্কে জানা :
রাসূলে পাক (সা:)-এ পবিত্র নৈতিক চরিত্রের ঘোষণা মহান আল্লাহ পাক আল কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
অর্থাৎ তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। আখলাক খুলুক শব্দের বহুবচন খুলুক দ্বারা চরিত্র, স্বভাব ও মানদ- এবং নিয়ামত বুঝা যায়। এতদর্থে আখলাক বলতে সমষ্টিগত চরিত্র, স্বভাব ও মানদ-ের ব্যাপ্তিকে প্রকাশ করা হয়। কুরআনে পাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। সূরা শোআরায় মহান আল্লাহ আরো এরশাদ করেছেন :

অর্থাৎ এটা তো পূর্ববর্তীদেরই স্বভাব। সুতরাং সৃষ্ট জগতে আল্লাহর পছন্দনীয় সহজাত স্বভাব ও মানদ-ের অন্তর্ভূক্ত যাবতীয় কর্মকা- ও বিষয়াদিই আখলাকের অন্তর্ভূক্ত। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনযাত্রার সর্বত্রই আখলাকের রূপরেখা আছে। রাসূলে পাক (সা:)-এর নৈতিক চরিত্রের মানদ-কে বিকশিত ও উদ্ভাসিত করতে গিয়ে কুরআনে পাকে একটি বিশেষ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা অন্য কারো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। শব্দটি হল ‘উসওয়াতুন’ কুরআনে পাকে ঘোষণা করা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলে পাক (সা:)-এর মাঝে উসওয়াতুন হাসানাতুন বা উত্তম আদর্শ রয়েছে। এই উসওয়াতুন হাসানাতুন শব্দটি হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন : “তোমাদের জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ:) তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”এই আয়াতদ্বয়ের মর্মের প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায় যে, (ক) যারা আল্লাহকে ভয় করে। (খ) আখেরাতকে ভয় করে। (গ) আখেরাতকে অধিক সস্মরণ করে এবং যারা মিল্লাতে ইব্রাহীমের অনুসরণ করে, কেবলমাত্র তারাই রাসূলে পাক (সা:)-এর পরিপূর্ণ উত্তম আদর্শের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।

আখলাকের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ :
মহান আল্লাহ পাক কুরআনে পাকে ঘোষণা করেছেন যে, আমি দুনিয়ায় খলীফা বা প্রতিনিধি নিয়োগ করব। এ প্রসঙ্গে খলীফা বা প্রতিনিধির স্মরূপ কি এবং খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্ব ও কর্তব্য কি তা ভেবে দেখা দরকার। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী মুফাররাদাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, খেলাফতের আসল অর্থ হচ্ছে প্রতিনিধিত্ব বা নায়াবাত। তবে এই প্রতিনিধিত্বের তিনটি ছুরত বা প্রকরণ হতে পারে। কারণ খেলাফতের অর্থ হচ্ছে কারো স্থলাভিষিক্ত হওয়া। এখন এই স্থলাভিষিক্ততা হয়তো মূল ব্যক্তির অনুপস্থিতির জন্য হবে, তার মৃত্যুর কারণে হবে,অথবা তার পদ ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে অপারগতার জন্য হবে। অথবা স্থলাভিষিক্তকে প্রতিনিধিত্বের সম্মান ও মর্যাদা দানের জন্য হবে। ইমাম বাগেব এ প্রসঙ্গ বহু আয়াত উল্লেখ করেছেন। যারা আলোকে এই তৃতীয় অর্থটিই তার কাছে বেশী উপযোগী বলে মনে হয়েছে এবং এই অর্থটিই আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের জন্য সমধিক উপযোগী হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ আল্লাহ পাক কোন অবস্থায়ই অনুপস্থিত নন। সর্বত্রই তিনি বিরাজমান, তিনি চিরঞ্জীব, তিনি মৃত্যু হতে মুক্ত ও পবিত্র এবং তিনি তাঁর পদ ও দায়িত্ব পালনে মোটেই অপারগ নন, অক্ষম নন, তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বকৌশলী। সুতরাং তাঁর প্রতিনিধি নিয়োগের একটি পন্থাই হতে পারে, তা হল স্থলভিত্তিক্তকে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা। তাফসীরে রূহুল মাআনীর লিখক মুফতী আলুসী (রহ:) কুরআনে পাকের যেসব আয়াতে খলীফা শব্দটি ব্যবহার করেছেন এর উপরোল্লিখিত তিনটি অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ও অভিভাষণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নিজে কোন সমাধানসুলভ অভিমত ব্যক্ত করেননি, যা দ্বারা এটা সুস্পষ্ট অনুমান করা সম্ভব যে, খলীফা শব্দ দ্বারা কি অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে? তবে একটি কথা সবার মনেই উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, যেখানে এটা সুস্পষ্ট বলে দেয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুক লোকের স্থলভিষিক্ত বা প্রতিনিধি। সেখানে প্রতিনিধি হওয়ার উপযুক্ততা সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথেই সম্পৃক্ত হবে। আর বক্তা যদি সুস্পষ্টরূপে কার প্রতিনিধি কথাটি বলে না দেয় তাহলে এক্ষেত্রে খলীফা বা প্রতিনিধি বলতে সেই বক্তার প্রতিনিধিই বুঝতে হবে। এই নিয়ম-নীতির আলোকে কুরআনে পাকের যেসব আয়াতে প্রতিনিধিত্বের বিষয়িিটর উল্লেখ আছে সেখানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা জাতির প্রতিনিধি বা খলীফা বুঝতে হবে। (চলবে)

 


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আহমেদাবাদে দুর্ঘটনার পর বোয়িংয়ের শেয়ারে বড় ধস

আহমেদাবাদে দুর্ঘটনার পর বোয়িংয়ের শেয়ারে বড় ধস

ইসরাইলকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে : আলী খামেনি

ইসরাইলকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে : আলী খামেনি

যুক্তরাজ্য সফরে পাচারের অর্থ পুনরুদ্ধার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে : প্রেস সচিব শফিকুল আলম

যুক্তরাজ্য সফরে পাচারের অর্থ পুনরুদ্ধার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে : প্রেস সচিব শফিকুল আলম

ইরানের পাল্টা হামলা হতে পারে ভয়াবহ-ব্যাপক

ইরানের পাল্টা হামলা হতে পারে ভয়াবহ-ব্যাপক

প্রধান উপদেষ্টার সাথে হাউস অব কমন্সের স্পিকারের বৈঠক

প্রধান উপদেষ্টার সাথে হাউস অব কমন্সের স্পিকারের বৈঠক

ইরানে ইসরাইলি হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নেই : দাবি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ইরানে ইসরাইলি হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নেই : দাবি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

চকরিয়ায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে মাদরাসা শিক্ষকের মৃত্যু

চকরিয়ায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে মাদরাসা শিক্ষকের মৃত্যু

এবার ইরানের রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা ইসরাইলের

এবার ইরানের রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা ইসরাইলের

মাগুরার গ্রামে সংঘর্ষে হাতবোমা বিস্ফোরণ বোমাবাজসহ তিনজন গ্রেফতার, আহত ১০ জন

মাগুরার গ্রামে সংঘর্ষে হাতবোমা বিস্ফোরণ বোমাবাজসহ তিনজন গ্রেফতার, আহত ১০ জন

সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মোদিকে মমতার চিঠি

সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় মোদিকে মমতার চিঠি

পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ বিমান হামলা

পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ বিমান হামলা

মারা গেছেন শিল্পপতি সঞ্জয় কাপুর

মারা গেছেন শিল্পপতি সঞ্জয় কাপুর

ভারতের বিমান দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করলেন ট্রাম্প

ভারতের বিমান দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করলেন ট্রাম্প

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ২ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ২ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত

বিদেশী জিহাদী কাফেলা আখ্যা দিয়ে ‘কাফেলাতুস সুমুদকে’ প্রতিরোধের ঘোষণা ইসরাইলের

বিদেশী জিহাদী কাফেলা আখ্যা দিয়ে ‘কাফেলাতুস সুমুদকে’ প্রতিরোধের ঘোষণা ইসরাইলের

ঈদের ছুটি শেষ : সরকারি-বেসরকারি কলেজ খুলবে রোববার

ঈদের ছুটি শেষ : সরকারি-বেসরকারি কলেজ খুলবে রোববার

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান নিহত

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান নিহত

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা, পাল্টা জবাবের আশঙ্কায় ইসরাইলজুড়ে সতর্কতা

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা, পাল্টা জবাবের আশঙ্কায় ইসরাইলজুড়ে সতর্কতা

অবাধে চলছে রেনু পোনা শিকার, ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীব বৈচিত্র্য

অবাধে চলছে রেনু পোনা শিকার, ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীব বৈচিত্র্য

তেহরানের আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল

তেহরানের আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল