প্রবাসী শ্রমিকরা এত অবহেলিত কেন?

Daily Inqilab রহমান মৃধা

০১ মে ২০২৫, ১২:৫০ এএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৫, ১২:৫০ এএম

যে মানুষটি একদিন দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁর চোখে ছিল একটি স্বপ্ন: পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা। আজ সেই স্বপ্ন বহন করে দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাঁদের রক্তঘামে আসে বছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রধান উৎস।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যুরো অফ ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (BMET)-এর তথ্য বলছে, এই অর্থে গড়ে উঠেছে গ্রামের অবকাঠামো, শিক্ষিত হয়েছে সন্তান, বদলে গেছে পরিবারের ভাগ্য। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে, দেশে ফিরে আসার পরে কি এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা পান?

প্রবাসীরা দিনের পর দিন উত্তাপে পুড়ে, ঠান্ডায় জমে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে অর্থ পাঠান, তা দেশের অর্থনীতির মেরুদ-। তাঁদের জীবনের বিসর্জনে তৈরি হয় গ্রামে নতুন ঘর, সন্তানরা পায় উচ্চশিক্ষা, শহরে গড়ে ওঠে ব্যবসা। কিন্তু এই শ্রমিকরা যে অবদানের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সেটি প্রায়শই রাজনৈতিক কৃতিত্বের মোড়কে হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন নকশায় তাঁদের জন্য কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়ে না।

বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক ২০-৩০ বছর কাজ করে দেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে ফিরে পান না কোনো স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোÑ না পেনশন, না সামাজিক বীমা, না মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা। বরং ফিরে পান অচেনা বাস্তবতা, অবহেলা ও একাকীত্ব।

বিশ্বের বহু দেশে যেমন ফিলিপিন্সে Workers Welfare Administration (OWWA)’-এর মতো প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা রয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সেখানে নীরব দর্শক। আমাদের দেশেও একটি কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা কি অসম্ভব?

বাংলাদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। তাঁরা দেশে ফিরে পড়েন প্রান্তিকতার ফাঁদে। ফলে, এই আত্মত্যাগী মানুষগুলো সমাজে হয়ে উঠেন ‘অপ্রয়োজনীয়’ এক শ্রেণি, যাদের সম্মান নেই, পরিচর্যা নেই, গর্ব নেই। এই রাষ্ট্রীয় অন্ধত্ব একদিন আমাদের সমগ্র অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, এই যোদ্ধাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা। এজন্য নি¤েœাক্ত প্রস্তাবনা বিবেচনায় নেয়া উচিত:
১. প্রবাসীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক পেনশন স্কিম চালু করতে হবে।
২. দেশে ফেরা প্রবাসীদের জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সহজশর্তে ঋণ ও তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. অভিবাসন-পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় বিশেষায়িত সেবা গড়ে তুলতে হবে।
৫. তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার জন্য একটি বার্ষিক জাতীয় সম্মাননা চালু করা যেতে পারে।

আজকের বাংলাদেশে, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মসম্মান এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করছি, সেখানে দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি এবং ভ-ামি আমাদের সর্বশ্রেণীর জনগণের ভবিষ্যৎকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী আজ বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ আমরা জানি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অদূরদর্শী প্রতিরোধ আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতির পথকে অস্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের অবস্থা এখন এমন, যে কেউ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, বরং বরাবরই আমাদের দুর্নীতির কারণে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে।

উন্নত রাষ্ট্রসমূহ থেকে যে ধরনের বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা আসার কথা, তা নির্ভর করে দেশীয় নীতির ওপর। আর সেই নীতি যখন দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ ও অদূরদর্শী, তখন আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে আমাদের দেশের মূল্যায়ন আশানুরূপ থাকে না। আমাদের দরকার নৈতিক, যোগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্ব, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী, জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। আমরা এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, যারা দুর্নীতির পথ পরিহার করবে এবং জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি পালন করবে।

এখানে স্পষ্টভাবে বলা দরকার, রাজনীতির নামে দুর্নীতি আর এদেশের মাটিতে চলবে না। মালিকদের অধিকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু এবং ন্যায়সংগত পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে কোনো ধরনের অপব্যবহার ও অশান্তি সহ্য করা হবে না। রাজনৈতিক তৎপরতা যদি জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করতে থাকে, তবে সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে এমন পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি হতে আমরা আর কোনোভাবেই অনুমতি দেব না।

রাষ্ট্রযন্ত্র যদি আজও অবহেলার কূপে বন্দি থাকে, তবে ইতিহাস একদিন এ রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য ন্যায়, রাষ্ট্রের জন্য আত্মশুদ্ধির ঘণ্টাধ্বনি পহেলা মে। এটি কেবল শ্রমিক দিবস নয়, এটি রাষ্ট্রের আত্মা জাগানোর দিন। আজকের এইদিনে আমরা যদি সেই পরিশ্রমী হাতগুলোর দিকে না তাকাই, যারা প্রিয়জন ছেড়ে বিদেশ-বিভূয়ে ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে, তাহলে আমাদের বিবেক মৃত।

পহেলা মে শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার দিন যেমন, তেমনি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পূর্ণ করার দিন। তাঁদের অবদানকে জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে না রাখলে উন্নয়ন শুধু ঢাকের বাদ্য হবেÑ গভীরতা থাকবে না। রাষ্ট্রের উচিত, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে প্রবাসী নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানো।

আমরা প্রবাসী শ্রমিকরা চাই না করুণা, চাই ন্যায্যতা। আমরা চাই না সংবর্ধনার ফুল, চাই সামাজিক নিরাপত্তার শিকড়। রাষ্ট্র যদি আজও এই শ্রেণীকে অবহেলা করি, তবে একদিন ইতিহাস তাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। এই লেখা একটি আবেগী বিষয় নয়Ñ এটি সময়ের গলায় চেপে বসা এক নৈতিক হুঁশিয়ারি।

লেখক: গবেষক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
ৎধযসধহ.সৎরফযধ@মসধরষ.পড়স


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান হবে কি?
মে দিবসের গোড়ার কথা
বৈশাখের কালো ঘোড়া
কালবৈশাখী
বৈশাখ
আরও
X
  

আরও পড়ুন

ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধানোর চেষ্টা করছে পশ্চিমা বিশ্ব : রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধানোর চেষ্টা করছে পশ্চিমা বিশ্ব : রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ভিডিও করার অভিযোগ, রাজবাড়িতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

ভিডিও করার অভিযোগ, রাজবাড়িতে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

সরকারি অফিস-ব্যাংক আজ খোলা

সরকারি অফিস-ব্যাংক আজ খোলা

ওড়িশায় বজ্রপাতে একদিনেই ৯ জনের মৃত্যু

ওড়িশায় বজ্রপাতে একদিনেই ৯ জনের মৃত্যু

বিবর্ণ ইউনাইটেডকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলে চতুর্থে চেলসি

বিবর্ণ ইউনাইটেডকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলে চতুর্থে চেলসি

পানিকে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ভারত

পানিকে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ভারত

আলোচিত শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় আজ

আলোচিত শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় আজ

এক হাজার বন্দি বিনিময়ে সম্মত রাশিয়া-ইউক্রেন, শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি

এক হাজার বন্দি বিনিময়ে সম্মত রাশিয়া-ইউক্রেন, শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি

জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা করা কর্মকর্তাদের শরয়ি দায়িত্ব : আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী

জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা করা কর্মকর্তাদের শরয়ি দায়িত্ব : আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী

আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে ৫টি চুক্তি স্বাক্ষর, নতুন যুগের সূচনা

আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে ৫টি চুক্তি স্বাক্ষর, নতুন যুগের সূচনা

যুক্তরাষ্ট্রে ঝড়ের তাণ্ডবে নিহত অন্তত ৪

যুক্তরাষ্ট্রে ঝড়ের তাণ্ডবে নিহত অন্তত ৪

ফের ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একদিনে নিহত ১১৫ ফিলিস্তিনি

ফের ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একদিনে নিহত ১১৫ ফিলিস্তিনি

সাভারে ছাত্র জনতা হত্যা মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার

সাভারে ছাত্র জনতা হত্যা মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার

‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সচিত্র দলিল

‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সচিত্র দলিল

এনসিপির ‘জাতীয় যুবশক্তি’র ১৩১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা

এনসিপির ‘জাতীয় যুবশক্তি’র ১৩১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা

ওড়ার পর খুলে পড়ল বিমানের চাকা, ঢাকায় জরুরি অবতরণ

ওড়ার পর খুলে পড়ল বিমানের চাকা, ঢাকায় জরুরি অবতরণ

ফারাক্কা বাঁধ এদেশে কারবালা তৈরি করেছে -উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

ফারাক্কা বাঁধ এদেশে কারবালা তৈরি করেছে -উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

মু’মিন হওয়ার জন্য শরিয়তের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরতে হবে : জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

মু’মিন হওয়ার জন্য শরিয়তের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরতে হবে : জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলো সরকার

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলো সরকার

বিপ্লবের পরে বাংলাদেশ : সংস্কারের পথে আশা, আন্দোলন ও আলোচনা

বিপ্লবের পরে বাংলাদেশ : সংস্কারের পথে আশা, আন্দোলন ও আলোচনা