বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক, না যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন উপযোগী?

Daily Inqilab সৈয়দ আবুল কাশেম

০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে এককেন্দ্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, যা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে ধীরগতির প্রধান কারণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার এই অতিরিক্ত কেন্দ্রায়ন শাসনব্যবস্থার দক্ষতা ও জবাবদিহিতা সীমিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও সম্ভাব্যতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট, বর্তমান এককেন্দ্রিক শাসন কাঠামো রাষ্ট্রীয় কার্যকারিতা ও টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা সাধারণত একটি কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ঘটায়, যেখানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো একটি সীমিত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত থাকে। এতে জনগণের মতামত এবং আঞ্চলিক চাহিদাগুলোর প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না, যা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং জনমতের ওপর অযাচিত প্রভাব পড়ে, যা গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে। এছাড়া, স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং সামাজিক উন্নয়নেও ভীষণভাবে বাধা সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে স্লো ব্যুরোক্রেটিক প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়, যা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নকে ধীর করে তোলে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড হার্ভি (David Harvey) Zvi A Brief History of Neoliberalism eB‡Z wj‡L‡Qb, In a centralized political system, the concentration of decision-making in a few hands leads to a disconnect between the state and the people, resulting in a lack of responsiveness to local needs and demands. This creates a political system where power becomes increasingly disconnected from the people, undermining democratic values and fostering instability.

(অর্থাৎ একটি কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার একটি ছোট দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া স্থানীয় চাহিদা এবং দাবিগুলির প্রতি অমঙ্গলমূলক মনোযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয় যেখানে ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।)

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক শ্রেণীর (বিশেষত, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী) দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের প্রয়োজনের দিকে অগ্রসর হয়নি। ফলে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায় এবং দেশের ভেতর রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায়।

এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সম্ভাবনা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা বিতরণের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের চাহিদার প্রতি সরাসরি জবাবদিহি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খতর চর্চার সুযোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, যেখানে প্রতিটি রাজ্য বা প্রদেশের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা এবং দায়িত্ব থাকে, রাজনৈতিক এককেন্দ্রিকতা হ্রাস করে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কার্যকরী করে। এটি বিভিন্ন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসম্পন্ন দেশে সামাজিক সংহতি বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরনাল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) Zvi A Studz of History গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন,The federal system, by distributing political power among different regions, helps to reduce centralized authority and creates a more responsive system of governance, where local needs and demands are better addressed. (অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, যা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বিতরণ করে, কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব কমাতে সহায়তা করে এবং একটি আরও কার্যকর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যেখানে স্থানীয় চাহিদা এবং দাবিগুলো ভালোভাবে পূর্ণ করা হয়)।

এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেখা যেতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ফলে স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজ্যগুলো তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সক্ষম হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিভিন্ন রাজ্যের চাহিদা এবং বৈচিত্র্যকে সম্মান জানাতে হয় এবং এটি রাজনৈতিক এককেন্দ্রিকতার তুলনায় একটি বহুমাত্রিক শাসন ব্যবস্থা গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য থাকলেও, তাদের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা এই বৈচিত্র্যগুলিকে সম্মান জানাতে সক্ষম হয়েছে, যা সামাজিক সংহতি বজায় রাখে এবং প্রতিটি রাজ্যের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে সাহায্য করে।

বেশ কয়েকটি দেশ সফলভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বাস্তবায়ন করেছে, যেমন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি। এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা জাতীয় সংহতি বজায় রাখার পাশাপাশি উন্নয়ন এবং স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। এই ধরনের কাঠামো গ্রহণের মাধ্যমে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, এবং অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে, রাজ্যগুলোর নিজস্ব আইন প্রণয়ন এবং উন্নয়ন নীতি গ্রহণের অধিকার থাকায়, তারা স্থানীয় চাহিদা অনুসারে বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই নয়, বরং অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্যও একটি অপরিহার্য ব্যবস্থা হতে পারে। বর্তমানে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আদায়, কর নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে নিজের হাতে রাখে, যা স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। যদি আঞ্চলিক সরকারগুলোর কাছে বাজেট ব্যবস্থাপনা, কর আদায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেওয়া যায়, তবে প্রতিটি অঞ্চল তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারবে। এটি জাতীয় অর্থনীতির ওপর চাপ কমানোর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আস্থা এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করবে।

অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা আরও সুস্পষ্ট হয় যখন জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং প্রশাসনিক চাপের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। ১৭ কোটি ৫০ লক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার এই দেশে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাত কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হওয়ার ফলে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের একটি মাত্র হাইকোর্ট বিভাগ রয়েছে, যা এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কার্যত অক্ষম হয়ে পড়েছে। মামলার জট দিন দিন বাড়ছে, বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার সময় দীর্ঘতর হচ্ছে এবং ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়ার ফলে সাধারণ জনগণের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বিচারব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোবিশিষ্ট দেশগুলোতে প্রতিটি রাজ্য বা প্রদেশে পৃথক হাইকোর্ট রয়েছে, যা স্থানীয় মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সাহায্য করে। বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘ ভ্রমণের কষ্ট এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়েছে। বাংলাদেশে যদি প্রতিটি বিভাগের জন্য পৃথক হাইকোর্ট বিভাগ স্থাপন করা হয়, তবে এটি বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ কমাবে এবং ন্যায়বিচার আরও সহজলভ্য হবে।

শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, প্রশাসনিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করতেও বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। বর্তমানে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করায় আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব দেখা যাচ্ছে। যদি প্রতিটি প্রদেশ বা অঞ্চলের নিজস্ব প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থাকে, তবে তা স্থানীয় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে পারবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে সক্ষম হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও বর্তমান এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রভাব লক্ষণীয়। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রশাসনিক অকার্যকারিতার জন্ম দিচ্ছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করা হলে, স্থানীয় অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে তা আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতেও একই রকম সমস্যার দেখা মেলে। রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতির ফলে গ্রাম ও মফস্বল এলাকার মানুষ উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকায় মাত্র কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল কেন্দ্রীভূত থাকায় গ্রামের জনগণ চিকিৎসার জন্য শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রতিটি প্রদেশ বা বিভাগের জন্য পৃথক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়, তবে প্রত্যেক অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারবে, যা সমগ্র দেশের জন্য স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করবে। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম বা কয়েকটি বড় শহরে কেন্দ্রীভূত, যা স্থানীয় পর্যায়ের ছাত্রদের মানসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ সীমিত করে ফেলেছে। একটি বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা গেলে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য কমবে এবং স্থানীয় উন্নয়নের পথ সুগম হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখানো হয়েছে যে, বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা সুশাসন নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন ম্যাকগার্ন তার Federalism and Governance: A Study of Decentralized Power MÖ‡š’ D‡jøL K‡i‡Qb, “Decentralized governance structures not only enhance political accountability but also ensure administrative efficiency and play a crucial role in safeguarding the fundamental rights of the general public.” (অর্থাৎ, বিকেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামো শুধু রাজনৈতিক জবাবদিহিতাই বৃদ্ধি করে না, এটি প্রশাসনিক কার্যকারিতাও নিশ্চিত করে এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।) তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে কেন্দ্রীয়করণ প্রশাসনিক অকার্যকারিতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণের মাধ্যমে বিচার, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। এটি কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন নয়, বরং গণতান্ত্রিক শাসনের মৌলিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার একটি কার্যকর পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট (ইরপধসবৎধষ) সংসদীয় ব্যবস্থা, যা এককেন্দ্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার তুলনায় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোবিশিষ্ট দেশগুলোর উচ্চকক্ষ (Upper House) রয়েছে, যা নিম্নকক্ষে (Lower House) গৃহীত আইনসমূহের একটি সংযত ও পুনর্বিবেচিত মূল্যায়ন নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে বর্তমানে একককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা থাকার ফলে সরকার যে কোনো আইন সহজেই পাস করিয়ে নিতে পারে, যা কখনো কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা করলেও সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করতে পারে। কিন্তু যদি একটি শক্তিশালী উচ্চকক্ষ গঠিত হয়, যেখানে প্রতিটি প্রদেশ বা অঞ্চলের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকে, তবে একক দলীয় আধিপত্য কমে আসবে এবং সংসদে পাসকৃত আইনসমূহ একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অধিকতর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে সরকার মৌলিক অধিকার বিরোধী আইন কিংবা ক্ষমতাসীন দলের বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা সংক্রান্ত আইন সহজে পাস করাতে পারবে না, কারণ এই কক্ষের সদস্যরা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক স্বাধীন থাকেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্রেও বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যেখানে উপকূলীয় অঞ্চল, নদীবাহিত এলাকা ও পাহাড়ি অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত পরিবেশনীতি স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিল না থাকায় জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যদি প্রতিটি প্রদেশ বা অঞ্চলের নিজস্ব পরিবেশগত নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা থাকে, তবে স্থানীয় সমস্যার জন্য বিশেষায়িত সমাধান বের করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ ও লবণাক্ততা প্রতিরোধে বিনিয়োগ বাড়ানো, নদীভাঙন রোধে স্থানীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজনকে কার্যকর করা সম্ভব হবে। যদি বাংলাদেশ ভবিষ্যতে টেকসই সুশাসন নিশ্চিত করতে চায়, তবে তাকে বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার দিকেই অগ্রসর হতে হবে।

বাংলাদেশের মতো বহুজাতিক, বহু-ভাষিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একদিকে, জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্েযর কারণে এটি বিচ্ছিন্নতাবাদের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার ফলে সাংবিধানিক পরিবর্তন কঠিন হয়ে ওঠে। ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এককেন্দ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছিল, ফলে নতুন কোনো কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে যদি পুনরায় প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্ম হয়, তবে তা জাতিগত সংঘাতকে উসকে দিতে পারে। ভারত, স্পেন এবং কানাডার অভিজ্ঞতা বলে যে, যথাযথ নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে জাতিগত ও আঞ্চলিক সংহতি বজায় রাখা সম্ভব, যেমন কানাডার কুইবেক প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করা হয়েছে এবং সুইজারল্যান্ডের ২৬টি ক্যান্টনের মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, একটি সীমিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কার্যকর হতে পারে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু স্থানীয় সরকারগুলোকে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। জার্মানির ফেডারেল কাউন্সিলের মতো একটি সমন্বয় কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে, যা কেন্দ্র ও অঞ্চলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে। তবে, রাজনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারতের অভিজ্ঞতা বলে যে, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ কার্যকর করা সম্ভব। একইভাবে, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলকে নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দিলে উন্নয়ন কার্যক্রম আরও কার্যকর হবে, তবে কেন্দ্র ও অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে জাতীয় সংহতির সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হবে, যেমনটি নেপাল তার নতুন সংবিধানের মাধ্যমে করেছে। সুতরাং, জাতীয় সংহতি বজায় রেখে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সুগঠিত সাংবিধানিক কাঠামোর প্রয়োজন, যা প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে।

সাংবিধানিক সংস্কার ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এজন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতা তৈরি এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। এ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা উচিত, যাতে একটি দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়।

অতএব, বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণ করা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে। এটি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় প্রশাসন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ত্বরান্বিত বাস্তবায়ন এবং জনগণের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির মাধ্যমে গণতন্ত্রের একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। কিন্তু এর জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অর্থনীতিতে কালো মেঘ

অর্থনীতিতে কালো মেঘ

ড. দেবাশীষ পাল বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন-এর সদস্য (ভৌত বিজ্ঞান) নিযুক্ত

ড. দেবাশীষ পাল বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন-এর সদস্য (ভৌত বিজ্ঞান) নিযুক্ত

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের অভিযান ও জরিমানা

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের অভিযান ও জরিমানা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হতে হবে : রাশেদ প্রধান

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হতে হবে : রাশেদ প্রধান

পুলিশকে ছুরিকাঘাত করা ও হত্যাসহ ১২ মামলার আসামি তানভীর আটক

পুলিশকে ছুরিকাঘাত করা ও হত্যাসহ ১২ মামলার আসামি তানভীর আটক

ঢাবি’র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলামের মৃত্যুতে ভিসি’র শোক প্রকাশ

ঢাবি’র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলামের মৃত্যুতে ভিসি’র শোক প্রকাশ

৫ আগস্টের পর ছাত্র রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে : এ্যানি

৫ আগস্টের পর ছাত্র রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে : এ্যানি

সোনারগাঁও পৌর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ

সোনারগাঁও পৌর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ

অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ছুটির দিনেও প্রতিবাদ সমাবেশ

অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ছুটির দিনেও প্রতিবাদ সমাবেশ

আদাবর ও মোহাম্মদপুরে ডাকাতি-ছিনতাইসহ কিশোর গ্যাংয়ের ২৭ জন গ্রেফতার

আদাবর ও মোহাম্মদপুরে ডাকাতি-ছিনতাইসহ কিশোর গ্যাংয়ের ২৭ জন গ্রেফতার

ময়মনসিংহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯, আহত ১৫

ময়মনসিংহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯, আহত ১৫

আগামীকাল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেবে এনসিপি

আগামীকাল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেবে এনসিপি

ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আ.লীগকে পুনর্বাসনে ষড়যন্ত্র করছে : রিজভী

ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আ.লীগকে পুনর্বাসনে ষড়যন্ত্র করছে : রিজভী

এক লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশি ২০২৪ সালেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন

এক লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশি ২০২৪ সালেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন

অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিভাগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট : সারজিস আলম

অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিভাগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট : সারজিস আলম

নয় বছরেও অধরা তনু হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা

নয় বছরেও অধরা তনু হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা

যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের দায়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীর ৫ বছর কারাদণ্ড

যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের দায়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীর ৫ বছর কারাদণ্ড

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদায়ী জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদায়ী জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

সিরাজগঞ্জ-৩ আসন : নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

সিরাজগঞ্জ-৩ আসন : নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

বিএনপির কাছে নিজেদের দলের লোকই নিরাপদ নয় -রংপুরে সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম

বিএনপির কাছে নিজেদের দলের লোকই নিরাপদ নয় -রংপুরে সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম