জুলাই বিপ্লবে মৌলভীবাজার
০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ১২:১৩ এএম

মৌলভীবাজারে চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র বাধায় শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামতে পারেনি। তবে সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে তেজদীপ্ত আন্দোলন করে তারা। তাদের একত্রিত হতে নানাভাবে বাধা দিতে শুরু করে ফ্যাসিস্ট সরকারের লালিত বা পালিত পুলিশরা। তারপরও শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন সড়কে খ- খ- বিক্ষোভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিয়ে বিএনপি, জামায়েতসহ সাধারণ মানুষ রাজপথে নামতে শুরু করে। এতে পুলিশ আরও বেশি মারমুখী হয়ে উঠে। কম বয়সী বা যে কাউকে দেখা মাত্র অকথ্যভাষায় গালিগালাজ, লাটিচার্জ করতে দ্বিধা ছিল না তাদের। এমনকি পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যেত থানায় কিংবা ডিবি কার্যালয়ে। তাদের প্রতি পুলিশী নির্যাতন কোনভাবে কমতি ছিল না। ওই সময় গণমাধ্যমকর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। তারা ছিল সবসময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের রোষানলে। তারপরও পেশাগত দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হয় কয়েকজন সাংবাদিক। ১৫ জুলাই থেকে বিএনপি ও জামাতের নেতাকর্মীদের ধর পাকড়ে মরিয়া হয়ে উঠে পেটুয়া বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি ও জামাতের অর্ধশত নেতাকর্মীকে। গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ নেতাকর্মীরা ঘরবাড়ি ছাড়া হয়।
১৬ জুলাই থেকে শহরের প্রধান সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সুসংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ করে। দুপুরে মৌলভীবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা শমসেরনগর সড়কে মিছিল নিয়ে বের হয়। এসময় প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীরা চৌমুহনা এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে পন্ড করে দেয়। এদিকে একই দাবিতে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হলে ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে মিছিলটি পন্ড হয়ে যায়। ঘটনায় অন্তত ৭ জন আহত হন। পরবর্তীতে প্রেসক্লাবে মোড়ে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে মিছিল সহকারে চৌমুহনায় পৌঁছলে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। ওই মামলায় ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিবাদে ১৭ জুলাই জেলা ছাত্রদল ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করে। ১৮ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মৌলভীবাজার সরকাররি কলেজ থেকে বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হলে কয়েক দফা ছাত্রলীগ ও পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। বাধা পেড়িয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের কোর্ট মার্কেট এলাকায় সড়ক অবরোধ করতে চাইলে ছাত্রলীগ এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। এতে পন্ড হয়ে যায় তাদের কর্মসূচি। এ ঘটনায় আহত হয় অন্তত ১০ জন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী। ঘটনাস্থল থেকে ২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ জুলাই বাদ যোহর আন্দোলনরত শহীদ শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা জেলা শহরের পশ্চিমবাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সর্বন্তরের নেতাকর্মীরা। ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারাদেশের ন্যায় মৌলভীবাজারে কারফিউ জারি হয়। ২০ জুলাই বিকেলে মাঠে নামে সেনা সদস্যরা। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনায় সময় বেঁধে দিয়ে থেমে থেমে চলে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কারফিউ। ওই সময়ে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ ও বিজিবি সড়কে টহল দেয় ও সড়কে চেক পোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি করতে দেখা যায়। তারপরও আন্দোলনে অনড় থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের গতিবিধিতে অনেকটা পেরেশানীতে থাকে হাসিনার মদদপুষ্ট বাহিনী। তবে ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে প্রতিহত করতে শহরের চৌমুহনাসহ বিভিন্ন স্থানে দেশীয় অস্ত্রসহ অবস্থান নেয় মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগ। ওই সময় প্রতিহতের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি নেছার আহমদ, মৌলভীবাজার-৩ আসনের এমপি জিল্লুর রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিছবাউর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. কামাল হোসেন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর আলী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালিক তরফদার ভিপি সোয়েব, যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ রেজাউল করিম সুমন, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা জেরিন হক, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
শনিবার ৩ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে জুড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচি পালনের সময় শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এ হামলায় আহত হয় ৩ শিক্ষার্থী। ৪ আগস্ট দুপুরের মৌলভীবাজার শহরের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র অবস্থান নিয়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ওই সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ১৫০ জন। দুপুরের সোয়া ১২টার দিকে দিকে পূর্ব ঘোষণানুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের সামনে জড়ো হয়। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আদালত এলাকায় সাকুরা মার্কেটের সামনে আসা মাত্র শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ। ওখান থেকে বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে আগাতে থাকে প্রায় ৪ শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী। তারা মিছিল সহকারে শহরের চৌমুহনায় এলাকার দেওয়ানী মসজিদ সম্মুখে পৌঁছালে তাদের উপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অংঙ্গ সংগঠন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ও ব্যাপক মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে। এ সময় অন্তত ৫০ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়। এর মধ্যে গুরুত্বর আহত হয় আরিফ ও মাহফুজ। এ সময় ৪ জন যুবলীগ নেতা আগ্নেয়াঅস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে। আহতরা নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। গুরুত্বর আহত আরিফ ও মাহফুজ প্রায় ২ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরে। ঘটনার সময় ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও তারা ছিল নিরব। এর আগে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও ৪ আগস্ট চালু ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষার্থীদের মারধরের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুনরায় সংগঠিত হয়। তাদের সাথে যোগ দেয় বিএনপি, জামায়েত ও সাধারণ মানুষ।
দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী ৩ সাংবাদিক যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়। আহত হয় সিনিয়র সাংবাদিক ও ইনকিলাবের জেলা সংবাদদাতা এস এম উমেদ আলী। আহত হওয়ার পাশাপাশি ভাংচুর করা হয় মটর সাইকেল। আহত হন এখন টিভির প্রতিনিধি এম হামিদ, ভাংচুর করা হয় তার ক্যামেরা। এশিয়ান টিভির প্রতিনিধি মো. মাহবুবুর রহমান রাহেলের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় তার মুঠোফোন।
পরে দুপুর ১টার দিকে একত্রিত হয়ে কয়েকটি সড়ক দিয়ে শহরের চৌমুহনা এলাকায় অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উপর পাল্টা হামলা চালায়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। সংঘর্ষ চলে আড়াইটা পর্যন্ত। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক আহত হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা শহরের চৌমুহনা এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবিতে মিছিল করে। উড়ানো হয় লাল-সবুজ পতাকা। এসময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের হঠাতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্টগ্রেনেড ছুড়তে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পুলিশের ছুড়া রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড উপেক্ষা করে জড়ো হতে থাকেন সর্বস্তরের মানুষ। এক পর্যায়ে এর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার। শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ছাত্র-জনতা। ৪ আগস্ট রাতেই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অনেক নেতা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও ৫ আগস্ট সকাল থেকে পুলিশ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। ওদিন সেনাবাহিনী ও বিজিবির অবস্থান ছিল স্বাভাবিক। দুপুর ২টার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর ছড়িয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে মৌলভীবাজার।
লেখক : জেলা সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

অর্থনীতিতে কালো মেঘ

ড. দেবাশীষ পাল বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন-এর সদস্য (ভৌত বিজ্ঞান) নিযুক্ত

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের অভিযান ও জরিমানা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হতে হবে : রাশেদ প্রধান

পুলিশকে ছুরিকাঘাত করা ও হত্যাসহ ১২ মামলার আসামি তানভীর আটক

ঢাবি’র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলামের মৃত্যুতে ভিসি’র শোক প্রকাশ

৫ আগস্টের পর ছাত্র রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে : এ্যানি

সোনারগাঁও পৌর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ

অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ছুটির দিনেও প্রতিবাদ সমাবেশ

আদাবর ও মোহাম্মদপুরে ডাকাতি-ছিনতাইসহ কিশোর গ্যাংয়ের ২৭ জন গ্রেফতার

ময়মনসিংহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯, আহত ১৫

আগামীকাল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেবে এনসিপি

ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আ.লীগকে পুনর্বাসনে ষড়যন্ত্র করছে : রিজভী

এক লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশি ২০২৪ সালেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন

অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিভাগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট : সারজিস আলম

নয় বছরেও অধরা তনু হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা

যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের দায়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীর ৫ বছর কারাদণ্ড

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিদায়ী জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

সিরাজগঞ্জ-৩ আসন : নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

বিএনপির কাছে নিজেদের দলের লোকই নিরাপদ নয় -রংপুরে সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম