জনবহুল অনেক দেশের মতো আমাদেরও অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে। গত কয়েক দশকের ধারাবাহিকতায় তা এখনো চলমান। অন্যান্য জেলা উপজেলায়ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ একইভাবে চলছে। এতে উপেক্ষিত হচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষারমত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। যেনতেন উন্নয়নের শ্রোতধারায় পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষ করে বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ গোটা জনগোষ্ঠিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

সর্বগ্রাসী দূষণের ভয়বহতা থেকে রক্ষায় যুগোপযুগী আইন প্রণয়ণ, প্রচলিত আইনের প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত বাস্তবায়ন জরুরী। এ জন্য প্রয়োজন দূষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ। স্বাস্থ্য কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বরাদ্দ থাকেলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে বা পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দের নজির নেই। গুরুত্ব বিবেচনায় কাল বিলম্ব না করে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে দূষণবিরোধী টেকসই বরাদ্দ এখন সময়ের দাবী। পরিবেশ ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা দেশের প্রধান প্রধান বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।

অনেক শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা আমাদের দেশে কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে আমাদের পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়ানক রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষা পারদর্শিতা বিষয়ক সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬২তম। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে আমরা এগিয়ে রয়েছি। যা উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেবে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই এক কোটির উপর বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের দূষণে আক্রান্ত। ছোট আয়তনের দেশে বেশি জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা বিশেষ করে দূষণ রোধে বহুমুখী উদ্যোগের সাথে সাথে গুরুত্ব বিবেচনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী বাস্তবায়নে নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

সরকারী হিসেবে, তিন বছরে করোনা ভাইরাসে দেশে ৩০ হাজার মানুষ মারা গেছে। সে হিসেবে গড়ে এ ভাইরাসে মারা গেছে ১০ হাজার মানুষ। তবে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীন গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনার চেয়েও ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি মানুষ প্রতি বছর মারা যাচ্ছে দূষণের (বায়ু, পানি ও মাটি) কারণে। গড়ে দূষনে মারা যায় ৯০ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের সব শেষ এক সেমিনারে দেয়া তথ্যানুযায়ী, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় জাতীয় বাজেট থেকে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ সে বিবেচনায় দূষণ কিংবা পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় বাজেট থেকে ব্যয়ের হিসাব করলে তা তলানিতে নামবে।

চলতি অর্থ বছরের (২০২২-২৩) জাতীয় বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, অল্যোচ্য বছরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। আর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ চলতি বছরের জন্য যে অংকে প্রদর্শিত হয়েছে তার কত কিয়দংশ দেশের পরিবেশ দূষণ ও স্থাস্থ্যঝুঁকি কমাতে ব্যয় হবে তার কিছুই নির্দিষ্ট নয়। এমনকি নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও। বাজেটে খোদ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আগের পাঁচ বছরের বরাদ্দ চিত্র খুবই নেতিবাচক। গত কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরারদ্দ ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছওে ছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বছর বছর পরিবেশের জন্য বরাদ্দ কমার সমালোচনা করে পরিবেশবিদরা বলেছেন, দূষণ বাড়লেও বাজেট কমে পরিবেশের। আর এতে করে পরিবেশ সুরক্ষার সুফল মিলছে না।

২০২২ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সারাবিশ্বের দূষণের তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। এতে দেখানো হয়েছে, মানুষের মৃত্যু বাদে কেবল বায়ূদূষণেই বাংলাদেশের বছরে ক্ষতি এক লাখ ১৭ হাজার ৬শ কোটি টাকা। এ ক্ষতির পরিমান জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে এ বাবদ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতির অংক অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে আরো কয়েক শতাংশ যোগ হবে। একই সাথে সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এবং গ্রিণপিসের গবেষণায় বলা হয়েছে, দূষণে বিশ্বে প্রতি দিনের ক্ষতি ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর পরিবেশ দূষণের ক্ষতি ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, পরিবেশ, দূষণ ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিয়ে কাজ করা স্থানীয় গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) বলেছে, পরিবেশের সঙ্গে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির সুনির্দিস্ট ১৭টি অভিষ্টের মধ্যে ৪টি অভিষ্ট সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তার মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা, শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিশুদ্ধ পানির আওতায় আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানী নিশ্চিতকরণ ও সমুদ্র দূষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্র অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখে এসডিজি অর্জন অসম্ভব। তাই লক্ষ্য অর্জনে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপশি মিল্পমন্ত্রণালয়কেও এ তৎপরতায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
এসডোর মহাসচিব বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. শাহরিয়ার হোসেনের মতে, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য একে অপরের পরিপূরক। যত পরিবেশের ক্ষতি হবে ততই স্বাস্থ্য খাতের উপর চাপ বাড়ে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে। এ খাতে ক্রমাগত ভর্তুকী বাড়াতে হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে গিয়ে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ভর্তুকী দেয় তা শেষ পর্যন্ত জাতীয় ব্যয়ে পরিনত হয়।

দূষণ, অপরিকল্পিত নগর ও শিল্পায়ন এবং সুশাসন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে সাংবাদিকদের নিয়ে বেসরকারি সংস্থা নিউজ নেটওয়াকের এক কর্মশালয় বলা হয়েছে, সরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিলেও দূষণরোধ, পরিবেশ রক্ষা, রোগ প্রতিরোধ বা বিস্তার ঠেকাতে কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখছে না। ইউএসএইডের সহায়তায় আয়োজিত এ কর্মশালায় আরো বলা হয়, নগর ও নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাজেটে সুনির্দিস্ট বরাদ্দ দিয়ে দূষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরী করা গেলে পরিবেশের যেমন সুরক্ষা হবে, তেমনি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমলে সার্বিক অর্থনীতির ওপরও চাপ কমে আসবে।

দেশের অন্যতম প্রধান বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগও (সিপিডি) দূষণ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করেছে। আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটের জন্য এ খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় গত সোমবার সিপিডি তাদের বাজেট প্রস্তাবনায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। বাজেটের বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে গিয়ে ‘এক নিঃশ্বাসের তাজা বাতাসের জন্য বাজেট’ শিরোনামে বলেছে, বাংলাদেশের বাতাসে বিশ্ব নিরাপদ বায়ুর গুণগতমান নির্দেশিকার চেয়ে ১৩ দশমিক ২ গুণ ঘনত্ব বেশি। এ পিরিস্থিতির উত্তরণে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আমদানি পণ্যে কর আরোপের প্রস্তাব করেছে। একই সাথে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিশেষ করে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জামের উপর ভ্যাট অব্যহতির প্রস্তাব করেছে। সংস্থাটি পরিবেশ দূষণকারী শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের উপর ১ শতাংশ হারে সারচার্জ অরোপের পরামর্শ দিয়েছে।

সরকারের বাজেট সহায়তা ও যথাযথ নীতি কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দূষণ রোধ করা গেলে নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটবে। মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বাড়বে জিডিপি।
[email protected]